খুব শীঘ্রই বিজ্ঞানীরা জানতে চলেছেন নিউট্রিনোর ভর

কণা পদার্থবিজ্ঞানের আদর্শ মডেল হচ্ছে পদার্থবিজ্ঞান জগতের অন্যতম সুন্দর এবং বিস্ময়ে পরিপূর্ণ এক শাখা। কারণ এর আদর্শ মডেল দ্বারাই মহাবিশ্বের ৪ টি মৌলিক বলের মধ্যে তিনটিই খুব পরিপূর্ণভাবে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করা যায়। তাড়িতচৌম্বক বল, দুর্বল নিউক্লিয় বল এবং সবল নিউক্লিয় বল। মহাকর্ষ বলকে এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি কারণ কণা পদার্থবিজ্ঞানের আদর্শ মডেল দিয়ে তা ব্যাখ্যা করা চ্যালেঞ্জিং বটে। কিন্তু এই আদর্শ মডেলের রয়েছে কিছু সীমাবদ্ধতা যার একটা হলো নিউট্রিনোর ভর।

নিউট্রিনোর অস্তিত্ব সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা প্রথমে জানতে পারেন ১৯৩০ সালে। পরবর্তীতে তা ডিটেক্টরে ধরা পড়ে ১৯৫৬ সালের দিকে। তখন বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন তিন ধরনের নিউট্রিনো রয়েছে। তাঁদের পরিমাণও অনেক বেশি এবং একধরনের ছলনাময়ী! অর্থাৎ এই নিউট্রিনো গুলোকে ডিটেক্ট করার জন্য প্রয়োজন বিশেষ ধরনের ডিটেক্টর এবং সরঞ্জাম কারণ তাঁরা খুব কমই অন্য বস্তুর সাথে মিথস্ক্রিয়ার সম্পর্কে লিপ্ত হয়। বেশিরভাগ নিউট্রিনোই পৃথিবীতে আসে সূর্য থেকে।

মডেল আমাদেরকে জ্ঞাত করে যে নিউট্রিনোর আসলে কোনো ভর নেই, ফোটনের মতোই অনেকটা। কিন্তু পদার্থবিদরা এখন গবেষণা থেকে পেয়েছেন যে তিন ধরনের নিউট্রিনো এক হয়ে যায় যখন তারা চলাচল করে। পদার্থবিদদের মতে এরকম তখনই হওয়া সম্ভব যদি তাঁদের ভর থেকে থাকে। কিন্তু ভরের পরিমাণটা কত? এই প্রশ্নটাই কণা পদার্থবিদদের প্রতিনিয়তই ঘুরিয়ে বেড়াচ্ছে। উত্তর পাওয়ার জন্য বিজ্ঞানীরা যে পরীক্ষা করছেন সেটা হচ্ছে KATRIN (Karlsruhe Tritium Neutrino Experiment.)

KATRIN

একদল বিজ্ঞানী উত্তরের একটা অংশ হিসেবে তুলে ধরেছেন যে নিউট্রিনোর ভর ১.১ ইলেক্ট্রন ভোল্টের চেয়ে বেশি হওয়ার কথা না। এটা হচ্ছে হ্রাসকৃত একটা মান যা প্রথমে ছিল ১ ইলেক্ট্রন ভোল্ট তারপর ২ এবং পরবর্তীতে ১.১। আগের পরীক্ষাগুলোতে নিউট্রিনোর ভরের ন্যূনতম সীমা স্থির করা হয়েছিল ০.০২ ইলেক্ট্রন ভোল্টে। এখন নতুন যে সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে সেটা হচ্ছে ইলেকট্রনের ভরের ৫ লক্ষ ভাগের এক ভাগ থেকেও কম! আদর্শ মডেলের অগ্রগতির জন্য এট অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

এখানে গবেষকরা এসেছেন বিশ্বের ২০ টি ভিন্ন গবেষণা সংস্থা থেকে। তারা কাজ করছেন জার্মানির Karlsruhe Institute of Technology তে। KATRIN এক্সপেরিমেন্ট যে সুবিধাটি এখানে প্রদান করছে সেটি হচ্ছে ১০ মিটার উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন স্পেক্ট্রোমিটার যা ইলেক্ট্রনের শক্তি খুবই নিঁখুতভাবে পরিমাপ করতে পারে। এই গবেষক দল তাদের গবেষণার নথি গত ১৩ সেপ্টেম্বর জাপানের  2019 Topics in Astroparticle and Underground Physics কনফারেন্সে প্রকাশ করে।

নিউট্রিনোর ভর জানার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা সৃষ্টিতত্ত্ব ও পদার্থবিজ্ঞানের জটিল সব প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম হবেন। আরও জানা যাবে মহাবিশ্ব কীভাবে বিবর্তিত হয়েছে এবং আদর্শ মডেলের দূরদর্শিতা।

বলেন Hamish Robertson যিনি KATRIN প্রজেক্টের একজন বিজ্ঞানী অ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের এমিরেটাস অধ্যাপক। 

নিউট্রিনো ডিটেক্ট করা খুবই কঠিন এবং খুব বেশি সূক্ষ্ম পরীক্ষার প্রয়োজন হয়। যদিও তাদের পরিমাণ এতটাই বেশি। তবুও নাম যে কথা বলে, অর্থাৎ তাঁরা নিষ্ক্রিয় বা নিউট্রাল যা কোনো তড়িতক্ষেত্রের সাথে সহজে মিথস্ক্রিয়া করেনা। এজন্যই এরা একরকম ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এন্টার্কটিকা এবং বিভিন্ন গভীর সুড়ঙ্গে স্থাপন করা হয়েছে নিউট্রিনো মানমন্দির। সেগুলো প্রায়ই “ভারী পানি” ব্যবহারের মাধ্যমে নিউট্রিনোকে নিজেদের সাথে মিথস্ক্রিয়া করতে প্রলুব্ধ করে। যখন এই ঘটনা ঘটে তখন উৎপন্ন হয়  Cherenkov radiation এবং তা পরিমাপ করা সম্ভব।

আপনি যদি সম্পূর্ণ সৌরজগৎকে এমনি প্লুটোর কক্ষপথ থেকেও ৫০ গুণ বেশি দূর পর্যন্ত সীসা দিয়ে ঢেকে দেন তারপরও সূর্য থেকে বিকিরিত অর্ধেক নিউট্রিনো তা ভেদ করে যাবে।

বলেন Robertson।

নিউট্রিনোর ভর নিয়ে গবেষণা চলছে অনেক আগে থেকেই। কিন্তু ২০০১ সালে দুটো ডিটেক্টর দেখায় যে নিউট্রিনোর ভর একেবারে শূন্য নয়। ২০১৫ সালে নোবেল পুরষ্কার দেয়ার হয় দুজন বিজ্ঞানীকে যারা দেখান নিউট্রিনোর প্রকারভেদ রয়েছে এবং ভর থাকা সম্ভব।

KATRIN ফ্যাসিলিটি নিউট্রিনোর ভর সরাসরি না মাপলেও তা ট্রিটিয়ামের ক্ষয় পর্যবেক্ষণ করে একটা ফলাফল তৈরি করে। ট্রিটিয়ামের যখন ক্ষয় হয় তখন তা একজোড়া কণা তৈরি করে। একটি ইলেক্ট্রন এবং একটি এন্টি নিউট্রিনো। একসাথে তাঁরা 18,560 eV  শক্তি ভাগ করে নেয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা সমান শক্তি ভাগ করে নেয়। কিন্তু ঝামেলা টা হয় তখন যখন কিছু বিরল মুহূর্তে ইলেক্ট্রন বেশি শক্তি গ্রহণ করে কিন্তু নিউট্রিনোর ভাগে থাকে খুবই অল্প পরিমাণ শক্তি। এটা কেন হয় বিজ্ঞানীরা মূলত এই রহস্য উন্মোচনেই ছুটছেন।

How KATRIN works

E=mc2  অনুযায়ী যে পরিমাণ শক্তি নিউট্রিনোর মধ্যে থাকে এই বিরল ঘটনায় তা অবশ্যই এর ভরের সমান হতে হবে। কারণ KATRIN এর এই ক্ষমতা রয়েছে ইলেক্ট্রনের শক্তির হিসাব করা এবং নিউট্রিনোর ভর বের করার।

হয়ত নিউট্রিনোর ভর বের করার মাধ্যমে ডার্ক ম্যাটারের দুনিয়া সম্পর্কে জানার এক নতুন দরজা খুলে যাবে, রচিত হবে নতুন এক আদর্শ মডেল। ডার্ক ম্যাটারের কথা আসল কারণ খুব সম্ভব একদিন চতুর্থ ধরনের নিউট্রিনো যাকে বলা হয় sterile neutrino আবিষ্কৃত হবে। এটি ডার্ক ম্যাটার না হলেও এর সম পর্যায়ের। নিউট্রিনোর ভর আছে এবং একটা সীমাও রয়েছে, এখন বিজ্ঞানীদের কাজ হচ্ছে খুঁজে বের করা কীভাবে সে ভরটা তাঁরা অর্জন করে। প্রতিদিনই গবেষণা চলছে এবং আমরা এক ধাপ করে এগোচ্ছি মহাবিশ্বের অপার রহস্য উদঘাটনের দিকে।

Comments are closed.