‘বোবায় ধরা’ কেন হয়? বা, হ্যালুসিনেশন কেন হয়? “যখন চিত হয়ে কেউ শুয়ে থাকে আর তার পায়ের দুই আঙ্গুল নাক বরাবর থাকে তখন তাকে বোবা ভূত এসে ভর করে”। ছোটবেলায় একবার এরকম অভিজ্ঞতা হলে দাদীর কাছে যখন জিজ্ঞেস করলাম তখন এরকম একটা উত্তরই পেয়েছিলাম। তারপর অনেকের কাছেই এরকম উত্তর বা কাছাকাছি উত্তর পেয়েছি। সবার কথার মর্মার্থ এই যে, “বোবা নামক ভূত যখন মানুষের উপর ভর করে তখন বোবায় ধরে”।
কিন্তু ব্যাপারটা কি আসলেই তাই? একজন বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষ হিসেবে এরকম উত্তর মেনে নেয়া কখনই সম্ভব না। যাই হোক, বোবায় ধরার ব্যবচ্ছেদ করার আগে বলে নেই আসলে ‘বোবায় ধরা কি?’ আর এতে হ্যালুসিনেশন কিভাবে হয়!
‘বোবায় ধরা’ কি?
অনেকেরই বোবায় ধরার অভিজ্ঞতা হয়েছে। ব্যাপারটা হচ্ছে, মাঝে মাঝে রাতের বেলা ঘুমের সময় দেখা যায় আমরা ঘুম থেকে জেগে উঠি। কিন্তু জেগে উঠলেও হাত পা নাড়াতে পারি না। চাইলেও পারি না। অনেক সময় ঘুম থেকে জেগে উঠে হাত পা নাড়ানো তো যায়ই না তার উপর অনেক অশ্বরীরি-অলৌকিক জিনিস পত্র দেখা যায়! এটাই মূলত ‘বোবায় ধরা’ বা ‘স্লিপিং প্যারালাইসিস‘।
আসুন এবার জানা যাক কেন বোবায় ধরে। মানুষ যখন ঘুমায় তখন ঘুমের মাঝে REM (rapid eye movements) সাইকেল চলতে থাকে। REM হচ্ছে মানুষ যখন স্বপ্ন দেখে সেই পর্যায়। মানুষ ঘুমের মাঝে এই সাইকেলে থাকাকালে মস্তিষ্ক দেহের কার্যকলাপ বন্ধ করে রাখে। কারণ, স্বপ্ন দেখে মানুষ সেসবের রি-অ্যাকশন হাত-পা নাড়িয়ে করতে পারে। আর এতে নিজের দেহের ক্ষতি হবার সম্ভাবনা থাকে। তাই স্বপ্নে আমরা হাটাহাটি দৌড়াদৌড়ি, মারামারি যাইই করি না কেন বাস্তবে ঘুমের সময় আমাদের দেহ কিন্তু স্থির হয়ে থাকে।
যদি কখনো REM সাইকেল চলাকালে দেহের কার্যকলাপ বন্ধ না থাকে তখন অনেকেই ঘুমের মাঝে চিল্লাফাল্লা করে, হাত পা ছোড়াছুড়ি করে। ঠিক তেমনি উল্টোভাবে অনেক সময় দেখা যায় যে মানুষ ঘুম থেকে ঠিকই জেগে উঠে কিন্তু তখনও দেহের কার্যকলাপ বন্ধ থাকে। দেহ বুঝতে পারে না যে সে জেগে উঠেছে। ঘুম থেকে জেগে উঠলেও একই সাথে দেহ যেমন বুঝতে পারে না ঠিক সেভাবেই REM সাইকেলও চলতে থাকে। যখন দুইটা একসাথে হয় সেই অবস্থাকেই বলে ‘বোবায় ধরা’! এই অবস্থা কয়েক সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।

REM সাইকেল যখন চলে মানুষ তখন তার অভিজ্ঞতা থেকে নানা জিনিস স্বপ্নে দেখে। কিন্তু মানুষ যদি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখে তাহলে ব্যাপারটা কেমন দাঁড়ায়? হ্যাঁ ঠিক তাই, মানুষ জেগে থাকলে বাস্তবে স্বপ্নের জিনিসগুলো দেখতে পায়। আর মানুষ যেহেতু স্বপ্নে তার বাস্তব অভিজ্ঞতার একটা মিশ্র রূপ দেখতে পায় তাই বাস্তবে সেসব আজগুবি-অলৌকিক জিনিসপত্র দেখতে পায়। যাকে ‘হ্যালুসিনেশন’ বলা হয়।
ধরুন আপনি স্বপ্ন দেখছেন। কি দেখছেন সেটা নির্ভর করে আপনার দৈনন্দিন কাজের উপর। আপনি বাস্তবে গরুও দেখেছেন, ছাগলও দেখেছেন। স্বপ্নে গরুর দেহে ছাগলের মাথা দেখাটা তাই অস্বাভাবিক কিছু না। কারণ স্বপ্নে বাস্তবের জিনিস হুবহু দেখার সাথে অনেক সময় একটা মিশ্র চিত্রও তৈরি করে। যাই হোক, স্বপ্নে গরুর দেহে ছাগলের মাথা মানা যায়। কিন্তু বাস্তবে যদি দেখেন, তখন? এমন সময়েই মানুষ অশ্বরীরি বা অলৌকিক বস্তুর অবতারণা করে। আর ঘুম থেকে জেগে উঠে যদি REM সাইকেল চলতে থাকে তাহলে এমন গরুর দেহে ছাগলের মাথা বাস্তবেও দেখা সম্ভব, যেহেতু স্বপ্ন দেখার পর্ব এখনো শেষ হয়নি।
তাহলে আমরা দেখলাম স্বাভাবিকভাবে স্বপ্ন দেখার সময় REM সাইকেল চলে আর কেউ যেন নিজের ক্ষতি না করে সেজন্য দেহের কার্যকলাপ বন্ধ রাখা হয়। কিন্তু এই সিস্টেমের ব্যাঘাত ঘটলেই বোবায় ধরে আর হতে পারে ‘হ্যালুসিনেশন’। এই হলো গিয়ে বোবায় ধরার পেছনের গল্প।
বোবায় ধরা নিয়ে নিচের এই ভিডিওটি দেখতে পারেন-
https://www.facebook.com/ScienceNaturePage/videos/1274994712632784/
বোবায় কেন ধরে?
মূলত ৫-২৫ বছর বয়সীদের বোবায় বেশি ধরে থাকে। বোবায় ধরার একটা প্রধান কারণ হচ্ছে অনিয়মিত ঘুম। মানুষ যখন চিন্তিত থাকে বা প্রেশারে থাকে তখনো বোবায় ধরতে পারে। দেখা গিয়েছে যারা নিয়মিত সময়ে ঘুমায় না এবং প্রয়োজনের চাইতে কম ঘুমায় তারাই হ্যালুসিনেশনে বেশি আক্রান্ত হয়। অনেক সময় দেখা যায় অতিরিক্ত ঘুমালেও বোবায় ধরার আশংকা তৈরি হয়।
হ্যালুসিনেশন বা বোবায় ধরার কোনো নির্ধারিত চিকিৎসা নেই। যদিও অনেক ডাক্তার বা সাইক্রিয়াটিস্ট কিছু কিছু ঔষধ প্রেস্ক্রাইব করে থাকেন। সেগুলো মূলত ঘুম ঠিকমত হবার ঔষধ।
বোবায় ধরা থেকে বাচার উপায়
তাই স্লিপিং প্যারালাইসিস বা বোবায় ধরা বা হ্যালুসিনেশন থেকে বাঁচতে হলে সময়মত এবং নিয়মিত ঠিকমত ঘুমাতে হবে এবং চিন্তা ভাবনা বা প্রেশার থেকে মুক্ত থাকতে হবে।
এসবই ঘুমের ব্যাঘাতের কারণে সৃষ্টি প্রতিক্রিয়া। বাস্তবে বোবায় ধরার পেছনে কোনো অলৌকিকতা বা অশ্বরীরি বা ভূত নেই। ঘুমের ব্যাঘাত হলে স্লিপিং প্যারালাইসিসের মাধ্যমে হ্যালুসিনেশন হতে পারে। এর থেকে মুক্তি পেতে ঠিকমত বাধ্যতামূলকভাবে ঘুমাতে হবে।
9 Comments
Shawon
interesting topic 🙂
Shawon
আমাকে প্রায়শই বোবায় ধরে :p
Anonymous
ভাই আপনি সিরিয়াস একটা বিষয় জানালেন ধন্যবাদ
kamruzzaman Emon
আর্টিকেল পড়ার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ।
kamruzzaman Emon
নিয়মিত ঘুমান আর চিন্তা মুক্ত থাকুন। তাহলে ঠিক হয়ে যাবে।
Abu Sufian Sakib
আগে ভাবতাম ভূত -_-
Anonymous
আমাকে কয়েক বার বোবায় ধরেছে, কিন্তু যেভাবে মুক্তি পেয়েছি তা আপনার লেখার সাথে মিলে না।
Anonymous
এর ব্যাখ্যা খুঁজে খুৃজে হয়রান হয়ে যাচ্ছিলাম।
অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে!??
Anonymous
ধন্যবাদ