এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ক্ষুদ্র কৃষ্ণগহ্বরের খোঁজ পেয়েছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা

এই সুবিশাল মহাবিশ্বে বালু কণার ন্যায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অগণিত বৈচিত্র্যময় সব বস্তু। মাঝে মাঝে কিছু বৈচিত্র্য আবার রূপ নেয় ধ্বংসাত্মকে। এই বৈচিত্র্যময় বস্তু গুলোকে যদি তালিকা ভুক্তের আওতায় আনতে চাই তবে তা নিরর্থক। আর আমরা মনুষ্য জাতিরা আবার ব্যকুল হয়ে উঠেছি সেই রহস্যেঘেরা এবং বৈচিত্র্যে ভরা বস্তুগুলোর মুখোশ উন্মোচনে। কখনো যেমন আমরা সফলতার মুখখানা দেখছি, তেমনি কখনো বা আবার আমাদের ছুঁয়ে যাচ্ছে ব্যর্থতার গ্লানি। তবে প্রতিনিয়তই সভ্যতা ও বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতার কারণে আমরা তাদের রহস্য উদঘাটনে সক্ষম হচ্ছি, তবে তা কিঞ্চিতই বটে। আর এই অসীম রহস্যময় বস্তুগুলোর বর্তমান রাজাধিরাজ বলে আখ্যায়িত করা হয় সেটি হলো Blackhole বা “কৃষ্ণগহ্বর”। কারণ এখন অবধি উন্মোচিত হওয়া যেকোনো রহস্যময় মহাজাগতিক বস্তুরা এর সামনে ম্রিয়মাণ প্রায়। তবে আমার ক্ষেত্রেও একই। এই বিশাল বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে কেবল একটি বস্তুই আমাকে সবসময় ভাবায় আর তাহলো এই “Blackhole” বা “কৃষ্ণগহ্বর”। তবে হ্যাঁ এমনো কিছু তাত্ত্বিক রহস্যজনক বস্তু রয়েছে যা হয়তো একসময় এই কৃষ্ণগহ্বরের রহস্যকেও ছাপিয়ে যাবে, তবে তা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার কারণ এগুলোর সত্যতা এখনো আমাদের কাছে অজানা। আপাতত আমরা কৃষ্ণগহ্বরের রহস্য নিয়েই না হয় মাতোয়ারা থাকি। এই Blackhole এর নাম শুনেনি এমন লোকজন খুঁজে পাওয়া ঢের। তবে আমি কিঞ্চিত অবাক হয়েছি এটি দেখে যে আমাদের দেশের অনেক শিক্ষার্থী এবং মানুষজনই এই কৃষ্ণগহ্বরের ব্যাপারে এখনো অজানা অবস্থাতেই রয়েছে।  তবে এখানে আমি উনাদের কোনো দোষ দিতে চাইনা কারণ দোষ হচ্ছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার। আমাদের দেশে কলেজ লেভেল এর আগ পর্যন্ত এই অসাধারণ আকর্ষণীয় বস্তুর ব্যাপারে যে কোনো ধারণাই দেয়া হয় না। যাইহোক আসল কথায় আসি। চলুন আসল কথায় যাওয়ার আগে আরেকবার জেনে আসা যাক কী এই কৃষ্ণগহ্বর এবং কেনোই বা তা এতো রহস্যেঘেরা।

Blackhole বা কৃষ্ণগহ্বর কীঃ

চিত্রঃ কৃষ্ণগহ্বরের সিমুলেশন

মহাবিশ্বের অস্তিত্ব ও প্রকৃতি বিষয়ক একটি বহুল প্রচলিত ধারণা হচ্ছে এই Blackhole বা কৃষ্ণগহ্বর। আর এই ধারণা অনুযায়ী কৃষ্ণগহ্বর হলো মহাবিশ্বের এমন একটি বস্তু যা অতি ঘন সন্নিবিষ্ট বা অতি ক্ষুদ্র আয়তনে এর ভর এতো বেশি যে এর মহাকর্ষীয় শক্তি (Gravitational Energy) কোনো কিছুকেই এর ভিতর থেকে বের হতে দেয় না এমনকি তাড়িতচৌম্বক বিকিরণকেও (যেমনঃ আলো) নয়। আলো পর্যন্ত একবার এই ব্ল্যাকহোলে ঢুকলে তা আর বের হয়ে আসতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে এই স্থানে সাধারণ মহাকর্ষীয় বলের মান এতো বেশি যে এটি মহাবিশ্বের অন্য সকল বলকে অতিক্রম করে। ফলে এর ভেতর থেকে কোনো কিছুই পালাতে পারে না। আইন্সটাইনের দেয়া “General Relativity” বা সাধারণ আপেক্ষিকতত্ত্ব অনুসারে, এই কৃষ্ণগহ্বর মহাকাশের এমন একটি বস্তু যেখান থেকে কখনোই কোনো কিছু আর ফিরে আসতে পারে না। এটা তৈরী হয় খুব বেশি পরিমাণ ঘনত্ববিশিষ্ট ভর থেকে। কোনো অল্প স্থানে খুব বেশি পরিমাণ ভর একত্রিত হলে সেটি সেটা আর কখনোই স্বাভাবিক অবস্থায় থাকতে পারে না। চলুন আমরা আমাদের এই মহাবিশ্বকে একটি সমতল পৃষ্ঠ হিসেবে কল্পনা করি। মহাবিশ্বকে ধরে নিন একটি বিশাল চাদরের টুকরো হিসেবে আর তারপর ঐ চাদরের উপর আপনি ভারী কোনো বস্তুকে রেখে দিন। তাহলে আমরা কী দেখতে পাবো? আমরা দেখতে পাবো যে চাদরের ভারী বস্তুটি রাখার দরুণ চাদরের যেই স্থানে ভারী বস্তুটি রাখা হয়েছে তার আশেপাশের চাদরটি গর্ত হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ এই অসামান্য ভর এক স্তানে কুন্ডলিত হয়ে স্থান-কাল বক্রতার (Space – Time Curvature) এর সৃষ্টি করে। ঠিক ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বরের ক্ষেত্রেও একই।

Blackhole বা কৃষ্ণগহ্বরের তোলা আসল ছবিঃ

চিত্রঃ “১০ই এপ্রিল, ২০১৮ সালে Event Horizon Telescope (EHT)
তোলা কৃষ্ণগহ্বরের  আসল ছবি”

মানবজাতির ইতিহাসে ১০ই এপ্রিল, ২০১৮ সালের দিনটি হলো একদিকে যেমন ঐতিহাসিক তেমনি অন্যদিকে মানবজাতির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সাফল্য। Blackhole বা কৃষ্ণগহ্বরের ছবি ধারণ করার জন্য বিশেষভাবে নির্মিত “Event Horizon Telescope (EHT)” এর প্রথম ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে অর্থাৎ এই প্রথম কৃষ্ণগহ্বরের ছবি প্রকাশিত হয়েছে এই দিনটিতে। ২০১৭ সালের এপ্রিলে বিশ্বজুড়ে ৮টি এর কম রেডিও টেলিস্কোপ বিক্ষিপ্তভাবে স্থাপন করা হয়। হাওয়াই, অ্যারিজোনা , স্পেন, ম্যাক্সিকো, চিলি এবং দক্ষিণ মেরুতে এই টেলিস্কোপগুলো বিভিন্ন দিক থেকে দুটি কৃষ্ণগহ্বরের তথ্য সংগ্রহের জন্য বিশেষভাবে নির্মিত হয়েছিলো। বিজ্ঞানীরা এই ছবিগুলো নিয়ে আরো বহু গবেষণা চালাবেন বলে জানিয়েছেন। দলটি তাঁদের ওয়েবসাইটে জানান যে,

“ব্ল্যাকহোলের পূর্ণাঙ্গ ছবি তৈরীর জন্য ইমেজিং অ্যালগরিদমের মাধ্যমে  যেই তথ্যগুলো মিলানো যাচ্ছিলো না, তার শূন্যস্থান পূরণের কাজ চলছে।“

Blackhole বা কৃষ্ণগহ্বরের সৃষ্টি হয় কিভাবে?

চিত্রঃ একটি Supermassive Blackhole সৃষ্টি হচ্ছে

যখন একটি নক্ষত্রের ভর সূর্যের ভরের তিনগুণ অপেক্ষা বেশি হয় তখনই তা কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হয়। সূর্যের ভরের তুলনায় বেশি ভরের নক্ষত্রগুলোর জ্বালানী শেষে সংকোচন অত্যন্ত তীব্র হয় এবং মূল অংশের ঘনত্ব এতোটাই বেড়ে যায় যে প্রচন্ড বিস্ফোরণের ঘটে যা “Supernovae” নামে পরিচিত। আর এই বিস্ফোরণের ফলে বহিরাবরণ ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায় এবং কেবল মূল অংশটি অবশিষ্ট থাকে। আর এই অবশিষ্ট অংশেই ভর সঞ্চিত হয়ে ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বরের সৃষ্টি হয়।

এবার তাহলে চলে যাওয়া যাক আসল কথায়।

সবচেয়ে ক্ষুদ্র কৃষ্ণগহ্বরের সন্ধান মিলেছেঃ  

চিত্রঃ “আর্টিস্টের আঁকা একটি কৃষ্ণগহ্বর এবং Binary System এর একটি বৃহৎ নক্ষত্র”

যেহেতু কৃষ্ণগহ্বর এই মহাবিশ্বের সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর বস্তু সেহেতু বিজ্ঞানীরা তৎপর হয়ে এর পেছনে নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমরা জানি যে প্রতিটি গ্যালাক্সিতেই একটি করে কৃষ্ণগহ্বরের উপস্থিতি রয়েছে এবং গ্যালাক্সিগুলো সেই কৃষ্ণগহ্বরকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণনরত। ঠিক তেমনি আমাদের “MilkyWay Galaxy” তে বিদ্যমান Sagittarius A* কৃষ্ণগহ্বরটি হলো একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল (Supermassive Blackhole) যার ভর আমাদের সূর্যের ভরের চেয়ে ৪ লক্ষ গুণ বেশি। এর ব্যাস হলো ১৪.৬ মিলিয়ন মাইল বা ২৩.৬ মিলিয়ন কিলোমিটার। এই কৃষ্ণগহ্বরকে নিয়েও চলছে বিজ্ঞানীদের নিরন্তর গবেষণা। আর এরই ধারাবাহিকতায় জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত সবেচেয়ে ক্ষুদ্র কৃষ্ণগহ্বরের সন্ধান পেয়েছেন যার ভর ৩ সৌরভরের চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশি। এটি নিয়ে “Science” নামক জার্নালে একটি গবেষণা পত্রও প্রকাশিত হয়েছে যার নাম হলো “A noninteracting low-mass blackhole-giant star binary system.” এই গবেষণাটি Ohio State University এবং অন্যান্য খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিদদের দ্বারা সম্পাদিত যেমন Harvard-Smithsonian Center for Astrophysics, The Observatories of the Carnegie Institution for Science, the Dark Cosmology Center সহ আরও অনেক। এছাড়াও একাধিক অবজারভেটরি এবং বিশ্ববিদ্যালয় গুলো এই চাঞ্চল্যকর গবেষণায় অংশ নিয়েছে। এই আবিষ্কার জ্যোতির্বিদদের কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ কারণ এতো ক্ষুদ্র কৃষ্ণগহ্বরের উপস্থিতি যে এই মহাবিশ্বে আছে তা তাঁদের আগে জানা ছিলো না। আর এই গবেষণার পর থেকে বিজ্ঞানীদের চিন্তাভাবনা পাল্টাতে বাধ্য হচ্ছেন। তাঁরা এই গবেষণার পূর্বে আমাদের গ্যালাক্সিতে বিদ্যমান কৃষ্ণগহ্বরের সংখ্যা নিয়ে তাঁরা যে অনুমান বা ধারণা করেছিলেন সেটি পাল্টাতে এখন বাধ্য হয়েছেন। এই গবেষণার প্রধান এবং Ohio State University এর Astronomy বিভাগের অধ্যাপক Todd Thompson বলেন,

“আমাদের এই গবেষণা একটি বিষয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, আমাদের এই মহাবিশ্বের অন্যত্র কোনো কিছু বিশাল পরিমাণে আছে যেটি আমাদের কৃষ্ণগহ্বর খোঁজার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করতে হবে। মানুষজন এখন বুঝতে চেষ্টা করছে যে Supernovae বিস্ফোরণ সম্পর্কে, কীভাবে সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের বিস্ফোরণ ঘটে, কীভাবে সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলে পদার্থগুলো গঠিত হয়েছে। এখন যদি আমরা কৃষ্ণগহ্বরের সংখ্যা প্রকাশ করি তাহলে সেটি আমাদেরকে বলে দিবে কোন নক্ষত্রটি বিস্ফোরিত হয়েছে, কোনটি বিস্ফোরিত হয় নি, কোনটি কৃষ্ণগহ্বর (Blackhole) তৈরী করে, কোনটি বা নিউট্রন তারকা (Neutron Star) তৈরী করে। এটি গবেষণার একটি নতুন দুয়ার উন্মোচিত করবে।“

Todd Thompson

জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের উৎসাহের কারণেই তাঁরা দীর্ঘদিন ব্যাপী এই কৃষ্ণগহ্বরের গবেষণা নিয়ে মত্ত্ব আছেন। তাঁরা দীর্ঘদিন ধরেই কৃষ্ণগহ্বর (Blackhole) এবং নিউট্রন তারকার (Neutron Star)  বিষদ জানার প্রচেষ্টায় রয়েছেন। যখন কোনো একটি নক্ষত্রের মৃত্যু ঘটে তখন তারা নক্ষত্রের জীবন চক্র (Life Cycle of a Star) এবং কীভাবে উপাদানগুলো গঠিত হয়েছে এই বিষয় আমাদেরকে আরও তথ্য প্রদান করে থাকে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের প্রথম কাজ হচ্ছে আমাদের গ্যালাক্সির ঠিক কোথায় কৃষ্ণগহ্বরগুলো অবস্থান করছে তা খুঁজে বের করা। আর তাদের খুঁজে পাওয়ার একটি অন্যতম উপায় হচ্ছে “বাইনারী সিস্টেম (Binary System)” কে খোঁজা যেখানে দুটি নক্ষত্র একে অপরের সাথে একটি কক্ষপথে আবদ্ধ থাকে তাদের পারস্পরিক মহাকর্ষীয় বলের (Gravitational Force) কারণে। এই নক্ষত্রগুলোর মধ্যে যেগুলো তার জীবনের শেষের দিকে মহাকর্ষের পতন ঘটায় সেগুলোই পরবর্তীতে একটি নিউট্রন তারকা (Neutron Star) বা  কৃষ্ণগহ্বরে (Blackhole) পরিণত হয়। সঙ্গী তারকা (Companion Star) যদি তার বিবর্তনের রেড ব্রাঞ্চ (Red Branch) বা RBP এ পৌঁছে যায় তবে তা যথেষ্ট প্রসারিত হবে।

চিত্রঃ ‘আর্টিস্টের আঁকা একটি কৃষ্ণগহ্বরকে কেন্দ্র করে একটি নক্ষত্র
ঘুরছে যা প্রচন্ড শক্তিশালী জেট উৎপাদন করে”

আর এই সম্প্রসারনের ফলে Red Giant বা লাল দৈত্যটি তার কৃষ্ণগহ্বর (Blackhole)  বা নিউট্রন তারকার (Neutron Star) সহযোগী হয়ে উঠবে। এটি পূর্বের পৃষ্ঠ থেকে উপাদানকে টেনে নেয় এবং ধীরে ধীরে পরবর্তীকালে গ্রাস করা দেখতে পাবে। এর থেকে প্রমাণিত হয় যে তাপ এবং এক্সরে দ্বারা যে উপাদান নির্গত হয় এটি তার কৃষ্ণগহ্বরের সহযোগী হিসেবে গৃহীত হয়েছে। এখন পর্যন্ত জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আমাদের গ্যালাক্সিতে যতগুলো কৃষ্ণগহ্বরকে শনাক্ত করেছেন তার সবই ৫ সৌরভর থেকে ১৫ সৌরভরের মাঝের। বিপরীতে, নিউট্রন তারকা (Neutron Star) সাধারণত প্রায় ২.১ সৌরভরের চেয়ে বড় হয় না, সেহেতু ২.৫ সৌরভরের চেয়ে বেশি যেকোনো কিছুই কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হয়। আমরা সবাই জানি যে, সম্প্রতি “LIGO” এবং “VIRGO” এর যৌথ গবেষণায় মহাকাশে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ (Gravitational Wave) কে শণাক্ত করেছে। আর এই তরঙ্গ এসেছে দুটি কৃষ্ণগহ্বরের মিলিত হওয়ার ফলে। তবে আমরা কী এটা জানি যে কৃষ্ণগহ্বর দুটির ভর কত ছিলো? না জানলে জেনে নিন। মিলিত হওয়া কৃষ্ণগহ্বর দুটির ভর ছিলো যথাক্রমে ৩১ সৌরভর এবং ২৫ সৌরভর। এর থেকে এটিই প্রমাণিত হয়েছে যে, জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা কৃষ্ণগহ্বরের সাধারণ পরিসীমার কথা চিন্তা করেছিলেন তার বাইরেও কৃষ্ণগহ্বরের থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। যেমনটি Thompson বলেছেন,

“তৎক্ষণাৎ সকলেই “WOW” বলে উঠেছিলো কারণ এটি এমন একটি দর্শনীয় জিনিস ছিলো যে কেবল এটিই প্রমাণ করেনি যে LIGO কাজ করছে বরং তাদের ভর ছিলো অনেক মাপের। কৃষ্ণগহ্বরের আকার যে একটি বড় ব্যাপার তা আগে আমরা দেখিনি।“

এই আবিষ্কারটি Thompson এবং তার সহকর্মীদের এই সম্ভাবনা বিবেচনা করতে অনুপ্রেরণা জাগিয়ে তোলে যে, বৃহৎ নিউট্রন তারকা এবং ক্ষুদ্রতম কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যে অনাবিষ্কৃত বস্তু থাকতে পারে। এটি তদন্ত করার লক্ষ্যে তারা “Apache Point Observatory Galactic Evolution Experiment (APOGEE)” থেকে আসা ডেটাগুলো সংযুক্ত করা শুরু করেন। এটি একটি জ্যোতির্বিজ্ঞান জরিপ যা ছারাপথ জুড়ে থাকা  প্রায় ১ লক্ষ নক্ষত্র থেকে Spectra বা বর্ণালী সংগ্রহ করে। Thompson এবং তার সহকর্মীরা পরিবর্তনের লক্ষণগুলির জন্য এই বর্ণালীটি পরীক্ষা করেছিলেন যা ইঙ্গিত দেয় যে হয়তো কোনো নক্ষত্র অন্য কোনো বস্তুর চারদিকে ঘুরছে। বিশেষত যদি কোনো নক্ষত্র “Doppler Shift” এর লক্ষণ দেখায় যেখানে

এর বর্ণালীটি নীল রঙের প্রান্তের দিকে অগ্রসর হবে এবং তারপরে তার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পরিবর্তন করে লাল রঙের দিকে অগ্রসর হবে। এই Doppler Shift কী এটি নিয়ে আমরা অন্য একটি আর্টিকেলে আলোচনা করবো। এটি কোনো একটি ইঙ্গিত হতে পারে যে, এটি কোনো অদেখা সঙ্গীর প্রদক্ষিণ করছে। এটি একটি নক্ষত্র কোনো গ্রহকে প্রদক্ষিণ করছে কিনা তা নির্ধারণের অন্যতম কার্যকর ও জনপ্রিয় একটি পদ্ধতি। গ্রহগুলো যখন একটি নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করে তারা এটিতে একটি মহাকর্ষীয় বল প্রয়োগ করে যার ফলে এটি পেছনের দিকে সরে যায়। APOGEE নক্ষত্র কোনো কৃষ্ণগহ্বরকে প্রদক্ষিণ করছে কিনা তা নিরধারণ করতে একই ধরণের শিফট টি জ্যোতির্বিজ্ঞানী Thompson এবং তার সহকর্মীরা ব্যবহার করেছিলেন।

চিত্রঃ “উপরের ডায়াগ্রামটি Radial Velocity কে ব্যাখ্যা করছে
যা Doppler Shift পদ্ধতি নামেও পরিচিত”

জ্যোতির্বিজ্ঞানী Thompson “APOGEE” থেকে প্রাপ্ত ডেটার ২০০ ক্যান্ডিডেটদের ডেটা ন্যারো করা শুরু করেছিলেন যা সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রমাণিত হয়েছিলো। তারপরে তিনি “Tharindu Jayasinghe (Ohio State University এর গ্র্যাজুয়েট রিসার্চ এসোসিয়েট)” কে ডেটাগুলো দিয়েছিলেন এবং তিনি তখন “All-Sky Automated Survey for Suparnovae (ASAS-SN)” জরিপের ডেটাগুলো সুপারনোভার জন্য ব্যবহার করেছিলেন যা OSU দ্বারা পরিচালিত এবং ১ হাজারেরও বেশি সুপারনোভাকে তারা শণাক্ত করেছেন হাজার হাজার সংকলন করতে প্রতিটি ছবি। এটি প্রকাশ করেছিল যে, একটি “Red Giant Star” বা লাল দৈত্য তারকাটি এমন একটি জিনিসকে প্রদক্ষিণ করছে যেটি যেকোনো পরিচিত কৃষ্ণগহ্বরের চেয়ে ছোটো তবে কোনো পরিচিত নিউট্রন তারকার চেয়ে বড় ছিলো।

“Tillinghast Reflector Echelle Spectrograph (TRES)” এবং “Gia Satellite” এর অতিরিক্ত ডেটাগুলো সংযুক্ত করার পরে তারা বুঝতে পেরেছিলো যে তারা একটি কৃষ্ণগহ্বরের সন্ধান পেয়েছে যা সূর্যের ভর থেকে প্রায় ৩.৩ গুণ বেশি। এই  গবেষণাটির ফলাফলটি কেবল নিম্নভর সম্পন্ন কৃষ্ণগহ্বরের একটি নতুন শ্রেণীর অস্তিত্বের নিশ্চয়তাই দেয় না বরং এটি আরও তথ্য দেয় যে এই ধরণের কৃষ্ণগহ্বরকে একটি নতুন পদ্ধতিতে শণাক্তও করা যায়। Thompson যেরকম ব্যাখ্যা করেছেন,

“আমরা এখানে যা করেছি তার ফলাফল হিসেবে কৃষ্ণগহ্বর গুলোর সন্ধানের জন্য একটি নতুন পদ্ধতি নিয়ে এসেছে। তবে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আগে জানতো না যে, নিম্নভর সম্পন্ন কৃষ্ণগহ্বর গুলোর একটি নতুন শ্রেণীর প্রথমটি আমরা সম্ভাব্যভাবে শণাক্ত করেছি। অনেকগুলো বিষয় তাদের গঠন ও বিবর্তন সম্পর্কে আমাদেরকে জানায় এবং সেগুলো তাদের প্রকৃতি সম্পর্কে বলে।“

Thompson

যেমনটি আমি আগেই বলেছি যে আমাদের এই মহাবিশ্বে এমন অনেক রহস্যময় বস্তু রয়েছে যেগুলো এখনো আবিষ্কৃত হওয়ার আশায় অপেক্ষা করছে আর তার মধ্যে শ্বেতগহ্বর (Whitehole), Wormhole ইত্যাদি হলো অন্যতম। যেকোনো কিছুর ক্ষেত্রে শুধু তাত্ত্বিকভাবে প্রমাণিত হলেই হবে না বরং তা বস্তুজগতেও প্রমাণিত হতে হবে অর্থাৎ এর সন্ধান মিলা আবশ্যক। ঠিক তেমনি এমন অনেক বস্তু আমাদের মহাকাশে তাদের রহস্যগুলো নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেকে আবার আসছে আমাদের সৌরজগতের বাইরে অন্য কোনো বাইরের জগত থেকে। আমরা হয়তো এতোসব বস্তুর মধ্যে কেবল কিঞ্চিৎ পরিমাণই এখনো অবধি আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছি। তবে এটি আশা করা বাঞ্ছনীয় যে দিনে দিনে যতোই সভ্যতা এবং বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশ ঘটবে, ততই আমাদের জন্য নতুন নতুন জিনিস আবিষ্কারের পথ উন্মোচিত হবে আর আমরা বিচরণ করতে পারবো পুরো মহাকাশ জুড়ে। হয়তো এমন একসময় আসবে যখন আমরা স্পেসশিপে চড়ে এক গ্রহ থেকে অন্য দূরের কোনো একটি গ্রহে ভ্রমণ করতে পারবো খুব অল্প সময়ে। হয়তো কখনো Wormhole এর সাহায্যে এক মহাবিশ্ব থেকে অন্য কোনো মহাবিশ্বে এক নিমিষেই যেতে সম্ভব হবে যদিও এসব এখনো নিছক কল্পনা চিত্র যদিও। এসবই এখন সময়ের ব্যাপার। তবে বিজ্ঞান যেই হারে উন্নতির চরম শিখরে উঠছে হয়তো সেই দিন আর বেশি দূরে নয় যেদিন মানুষ মঙ্গলে পাড়ি জমিয়ে নতুন এক ইতিহাসে পদার্পণ করবে আর মানবজাতি সুচনা করবে এক নতুন দিগন্তের। আর এই অপেক্ষাতেই বিজ্ঞানীরা করছেন নিরন্তর গবেষণা আর আমরা চেয়েছি সেই নক্ষত্রখচিত পথের পানে।  

Source : Curiosity, Universe Today, “Science” journal.

Comments are closed.