সাপ প্রাণীটাই অদ্ভুত। হাত নেই, পা নেই, কেমন সরসর করে একেবেকে এগিয়ে চলে! শুধু যে এগিয়ে চলে তা না খানাখন্দ, জমি, জল, উঁচুনিচু পথ, গাছগাছড়া বেয়েও অনায়াসে উঠে যেতে পারে। উঠে যেতে পারে ঘরের ছাদ, টিনের চালে। ঢুকে এতে পারে পরার জুতো বা ব্যবহারের ব্যাগের মাঝে।
সাপকে বিভিন্ন ধর্মেও বিভিন্নভাবে দেখানো হয়েছে। কেউ “শয়তান” বলে মারে তো কেউ দেবতুল্য মনে করে পুজো করে।
তবে যা’ই হোক না কেনো, সাপ নিয়ে যে জিনিষটা সচরাচর মানুষের মনে কাজ করে তা হচ্ছে ভীতি। আর এই ভীতিটা মূলত তাদের বিষ নিয়েই। আর যেহেতু সাপের হরেক প্রজাতিই আছে আর আমরা জানিনা কোন প্রজাতির বিষ আছে আর কোন প্রজাতির নেই তাই আমাদের মাঝে সাপ দেখলেই ভীতি কাজ করে। এমনকি তা সামান্য লার্ভাভূক দুমুখো সাপ দেখলেও করে। আমরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে সেগুলোকে মেরে পুড়িয়ে দিই। অথচ অত ছোট মুখে বিষের কিছুই নাই।
তবে যাইহোক, কোনো সাপের বিষ থাকুক বা না থাকুক সাপের বিষ জিনিষটা কিন্তু বরাবরই আমাদের জন্যে ক্ষতিকর। কেবল লাউডগা, কালনাগিনী এগুলার বিষ স্রেফ তাদের ক্ষুদে ক্ষুদে শিকারগুলোকে অবশ করার কাজে আসলেও অন্যান্য বিষাক্ত গোত্র, যেমন গোখুরা, কেউটে, বোড়া, ঝুনঝুনি সাপ (rattle snakes) এদের বিষ কিন্তু মারাত্মক ক্ষতিকর! এমনকি কিছু সাপের মাত্র একটা ফোঁটা বিষ কেড়ে নিতে পারে একাধিক মানুষের প্রাণ।
আজকের আলোচনা হবে বিষধর সাপদের সেইসব বিষ, সেগুলোর ধরণ ও কর্মপ্রক্রিয়া, প্রাথমিক চিকিৎসা ও প্রতিকার ইত্যাদি নিয়ে। সাথে থাকছি আমি মুহাম্মদ শাহেদ রাইয়ান আপনাদের সাথে আজকের আলোচনা জুড়ে।
সাপের বিষ কি?
সাপের বিষ বা Snake Venom সম্বন্ধে বিস্তারিত বা বৈজ্ঞানিকভাবে জানতে গেলে প্রথমেই যে প্রশ্নটা আসবে মনে তা হচ্ছে সাপের বিষ কি? মানে এর গঠন উপাদান কি।
প্রথমত, সাপের বিষ হচ্ছে একধরণের খুবই উচ্চপর্যায়ের বিশেষায়িত লালা (Saliva) যা মানুষসহ অন্যান্য স্তন্যপায়ীদেরও দেহে থাকা লালাগ্রন্থি (Salivary Gland) থেকে আসে যার নাম প্যারোটিড লালা গ্রন্থি (Parotid Salivary Gland)। যদিও সাপেরা স্তন্যপায়ী নয়, সরীসৃপ, তবু তাদের দেহে প্যারোটিড গ্রন্থি রয়েছে। সাপেদের বেলায় তাদের এই প্যারোটিড গ্রন্থিসমুহের অবস্থান থাকে প্রতি পাশে একটি করে মাথার উপরে, চোখের পেছনে বা নীচে। প্রতিটা গ্রন্থিতে থাকা ফাঁপা অংশ অ্যালভিওলাস (Alveolus) এ তাদের এই খুবই বিশেষ পর্যায়ের লালা জমা থাকে। সেখান থেকে স্যালিভারি ডাক্ট দিয়ে লালা যাবার পথ শেষ হয় তাদের বিষদাঁত বা Fang এর শেষপ্রান্তে।
লালা তো মানুষেরো থাকে, কিন্তু তাহলে সাপের বিষ বলে পরিচিত তাদের এই লালা এত বিষাক্ত কেন?
এর কারণ হচ্ছে এতে থাকা জু-টক্সিন (Zootoxin)। আর এটাই হলে সাপের বিষের মুল বিষাক্ত উপাদান। জু-টক্সিন হল প্রাণীদেহের বিষ, মানে যা কেবল প্রাণীদেহই উৎপন্ন করে। আর একেই আরেক নামে ভেনম (Venom) বলা হয়। সাপের বিষ মূলত উচ্চ প্রক্রিয়াশীল প্রোটিন বা আমিষ যৌগ। সাপের বিষের মূল উপাদানই হল প্রোটিন বা আমিষ। এছাড়াও এর সাথে থাকে বিভিন্ন ধরণের এনজাইম ও অন্যান্য উপাদানসমুহ। সাপের বিষের গড়নই এমন যে তার উদ্দেশ্য থাকে লোহিত রক্তকণিকা, স্নায়ুতন্ত্র ইত্যাদিতে আঘাত হানা। তাই সাপের বিষের কার্যকারিতার ধারক হচ্ছে রক্তসংবহন তন্ত্র। অর্থাৎ সাপের বিষ মূলত কাজ করে থাকে রক্ত ও অভ্যন্তরীণ টিস্যুর মধ্যে মিলে গিয়ে। আর যেহেতু এটি প্রোটিন ও এনজাইমসমুহের যৌগ, তাই এটি অক্ষত পরিপাকতন্ত্রের মধ্যে গিয়ে নিজের বিষক্রিয়া ঘটাতে পারেনা।
তবে থামুন, তাই বলে কখনোই, ভুলেও সাপের বিষ খেয়ে দেখার চেষ্টা করবেন না। কারণ আপনি জানেন না আপনার পরিপাকতন্ত্র কতটা অক্ষত!
বিষের মাত্রা
অন্যান্য ভেনমের (প্রাণিবিষ) মতই সাপের বিষেরও ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা ও এর রকমফের রয়েছে। সাপের তথা প্রাণীদের বিষ নিয়ে জীববিজ্ঞানের যে শাখা আলোচনা করে তার নাম বিষবিদ্যা বা Toxicology। এই বিষবিদ্যার নিয়মেই সাপের বিষের মাত্রা একটি নির্দিষ্ট ধাঁচে পরিমাণ করা হয়, যাক বলে Lethal Dose বা সংক্ষেপে LD। এই LD এর রকমফের দিয়েই মাপা হয় বিষের ধরণ, বিষের মাত্রা, ক্ষমতা ইত্যাদি। উদাহরণস্বরূপ, LD50 হচ্ছে ভেনমের মধ্যম প্রাণঘাতী মাত্রা বা Median Lethal Dose। এক থেকে একশোকে পরিসংখ্যানের সূচক ধরলে সেখানে 50 হবে মধ্যম শ্রেণি। তাই একে LD50 রূপে লেখা হয়। যার অর্থ কোনো একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য একটি নির্দিষ্ট প্রাণীর প্রজাতির (ল্যাব টেস্ট এ ইঁদুরের উপর করা) নির্দিষ্ট সংখ্যার উপর এই বিষ একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় প্রয়োগ করলে তা ঐ প্রাণিসংখ্যার অর্ধেককেই মেরে ফেলতে সক্ষম। উল্লেখ্য শেষের নির্দেশিত 50 সহগটির সংখ্যা যত কমবে, মানে যদি তা 40, 30 ইত্যাদি যায়, তাহলে সেটা আরো বেশি শক্তিশালী বিষ নির্দেশ করে। আর এভাবেই LD এর বিভিন্ন মাত্রা হিসেব করে বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকরা বিষ এর ক্ষমতা অনুযায়ী বিষ আলাদা করে থাকেন। এছাড়া কার্যপ্রক্রিয়ার ধরণ অনুযায়ী বিষসমুহকে আলাদা করা হয়। যেহেতু ভেনোম একটি জটিল যৌগ ও এটি ভিন্ন ভিন্ন প্রাণি, এমনকি ভিন্ন ভিন্ন বিষাক্ত সাপের ক্ষেত্রেও ভিন্ন ভিন্নভাবে কাজ করে তাই এক্ষেত্রে তাদের বিষ পৃথকীকরণে খুব সতর্ক থাকতে হয়।
কিভাবে কাজ করে সাপের বিষ?
আগেই বললাম সাপের বিষ মূলত রক্তসংবহনতন্ত্রে মিশে গিয়ে কাজ করে। যেহেতু রক্ত শরীরের একমাত্র অংশ যা সারাদেহেই পরিচালিত হয় এবং দেহের মুল মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রকে অক্সিজেন প্রদানের মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখে সেহেতু বিবর্তনের ধারায় সাপের বিষের গঠন এমনভাবে হয়েছে যে তা শিকার শরা বা আত্মরক্ষার জন্যে দেহের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোর একটাতে আঘাত হানতে পারে! এমন কিছু, যাতে সমস্যা হলে তা পুরো দেহকে অচল করে দিতে সক্ষম নিমেষে৷ আর যা হৃৎপিণ্ড বা ফুসফুসের মত দেহের ভেতরে নির্দিষ্ট জায়গাতেই অবস্থান করেনা। অর্থাৎ যেকোনো দিকে আঘাত করলেই যার মাধ্যমে শিকার বা প্রতিপক্ষকে বশে আনা সম্ভব! আর এরকম অংশ বলতে কেবল রক্তই আছে, যা দেহের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে, কি পায়ের পাতায়, কি মাথার ভেতরে, কি ফুসফুসে, কি হৃৎপিন্ডে, বা কি হাতে পায়ে, সব সবজায়গায় ঘুরে বেড়ায়। তাই আক্রমণ করার জন্যে মোক্ষম উপায় রক্তের চাইতে ভাল আর কিছু নেই! তবে রক্তে মিশে গিয়ে প্রভাব ফেললেও সাপের বিষগুলোতে প্রায় বিশটার মত এনজাইম (কতিপয় শারীরিক কর্মপ্রক্রিয়া ও বিক্রিয়াকে দ্রুততর করে দেয়ার রাসায়নিক উপাদান), এমাইনো এসিড আর অন্যান্য প্রোটিন থাকে। যার দরুন একেক বিষের কার্যপ্রক্রিয়াও হয় একেকরকমের। সাপের বিষে থাকা নানারকম এনজাইম ও প্রোটিনজাতীয় বিষাক্ত উপাদানগুলো হলঃ
Proteolytic enzymes
Phosphomonoesterase
Arginine ester hydrolase
Phosphodiesterase
Thrombin-like enzyme
Acetylcholinesterase
Collagenase
RNase
Hyaluronidase
DNase
Phospholipase A2 (A)
5′-Nucleotidase
Phospholipase B
L-Amino acid oxidase
Phospholipase C
Lactate dehydrogenase
Adenosine triphosphatase
এগুলো মানবদেহে রক্ত ও কোষসমুহের সাথে মিশে ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে কর্মপ্রক্রিয়া পরিচালনা করে থাকে। ভেনমগুলোতে থাকা নানারকম এনজাইম ও প্রোটিনের কোনোটা হজম ও পরিপাক ক্রিয়ায় আক্রমণ ঘটায় তো কোনোটা লোহিত রক্তকণিকাকে ভেঙে ফেলা শুরু করে। কোনো রক্তকে জমাট বাধিয়ে ফেলে তো কোনোটা শরীরের টিস্যুসমুহতে পচনের মত ধরিয়ে দেয়। আবার কোনোটা গিয়ে সোজাসুজি আঘাত হানে আমাদের স্নায়ুতন্ত্রে (Nervous System), একেবারে দুই স্নায়ুকোষ (Neuron) এর সংকেত আদানপ্রদানের জায়গাতে৷ ফলে শুরু হয় পেশির অস্বাভাবিক খিচুনি। হৃৎপিন্ডের সংকোচন। আবার কোনোটায় রক্ত জমাট বেধে আটকে যায় ফুসফুসের খাজে বা হৃৎপিন্ডের চলার পথে। কোনোটায় হাত পা ফেটে এমনি বীভৎস আকার ধারণ করে যা রোগী বেচে গেলেও পুরোপুরি ঠিক হয়ে ওঠা আর সম্ভব হয়না।
তো, মোদ্দাকথা হল, সাপের বিষ সচরাচর প্রাণীদেহের যোজক কলায় (Connective Tissue) গিয়ে ও এর মাধ্যমে প্রাথমিক আঘাতটা হানলেও এর পরবর্তী কর্মপ্রক্রিয়া ভিন্ন ভিন্ন হয়। আর ভিন্ন ভিন্ন কার্যপ্রক্রিয়ার উপর নির্ভর করেই সাপের বিষের শ্রেণিবিন্যাস করা হয়৷ যেগুলোর প্রতিটা এনজাইম ও প্রোটিনের সমন্বয়ে গঠিত হলেও এগুলোর একেকটার অন্যটার চাইতে ভিন্ন। ভিন্ন এদের তীব্রতাও। আর এই তীব্রতা বা Lethal Dose এর উপরই নির্ভর করে কোন সাপ কত বেশি বিষাক্ত।
সাপের বিষের প্রকারভেদ
আগেই বললাম সাপের বিষ একধরণের বিশেষ লালা যাতে খুবই উচ্চপর্যায়ের ভিন্ন ভিন্নভাবে কার্যকরী আলাদা আলাদা প্রোটিন ও এনজাইম উপাদান রয়েছে। যেগুলোর দরুন এদের রকম ও তীব্রতায় রয়েছে পার্থক্য। সেই অনুযায়ী বহু উপাদান আর কার্যকরণের প্রক্রিয়ার ভিত্তিতে সাপের বিষ মূলত ৩ প্রকারের হয়ে থাকে।
১. Neurotoxic Venom বা Neurotoxin, যা স্নায়বিক বিষ
২. Hemotoxic Venom বা Hemotoxin যা রক্তের উপর সরাসরি হামলাকারী বিষ
৩. Cytotoxic Venom বা Cytotoxin বা কোষঘাতি বিষ।
আর এসব বিষের মাঝে নানারকম উপাদানের মাত্রার তারতম্য অনুযায়ী ভিন্নতা হয়ে থাকে। যার দরুন কামড় খাওয়া রোগীর দেহে এগুলোর প্রতিক্রিয়াও হয় ভিন্ন ভিন্ন রকমের৷ যেমন নিউরোটক্সিন স্নায়বিক প্রক্রিয়াতেই আঘাত হানে। যার ফলে এর প্রভাব শরীরের অন্যান্য অঙ্গে পড়ে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু হেমোটক্সিন আবার তেমন না, এরা সাপের বিষের মাঝে সবচাইতে ভয়ানক বিষের খেতাব পাবার অধিকার রাখে। এরা সরাসরি রক্তকণিকাতেই আঘাত হানে। মুহূর্তে এলোমেলো করে দেয় রক্তের স্বাভাবিক রূপ। জমাট বাধায় জায়গায় জায়গায়। আর অন্যদিকে রইলো সাইটোটক্সিন, এরা আবার দংশিত স্থানের কোষকেই সরাসরি হামলা করে। এবং সেই প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে যেতে শুরু করে অনেকটা পচন ধরার মত করেই। যার ফলস্বরুপ, রোগী বেচে গেলেও দেহের তার আক্রান্ত অংশের ভয়াবহ ক্ষতিও হতে পারে।
বিষের এই ধরণগুলোর মধ্যে আছে আবার আরও বহু রকমফের। রয়েছে তাদের কর্মপ্রক্রিয়া। সেগুলো নিয়ে আবার আলোচনা করবো পরের পর্বে। এছাড়াও সাথে থাকবে সাপের বিষের প্রতিষেধক, সেগুলোর ধরণ, সেগুলো কিভাবে তৈরি হয় ইত্যাদি। এছাড়াও সাপে কামড়ালে প্রাথমিকভাবে সবচাইতে জরুরী করণীয় বিষয় কি, কিভাবেই বা বুঝবেন কামড়ানো সাপ বিষাক্ত কি না, সেসব বিষয়ে আলোচনা হবে আবার পরবর্তী পর্বে৷ ততক্ষণ সুস্থ থাকুন, ভাল থাকুন আর নিজের খেয়াল রাখুন।
আর হ্যাঁ, গ্রামেগঞ্জে, মাঠেঘাটে বা ঝোপঝাড়ের কাছে গেলে বিষাক্ত সাপ হতে সাবধানে থাকুন।
One Comment
বিভীষিকাময় সাপের বিষ - পর্ব ২ | বিজ্ঞানবর্তিকা
[…] বিভীষিকাময় সাপের বিষ (পর্ব ১) […]