আমরা জানি এই মহাবিশ্বে আমাদের স্থান অতি নগন্য। পৃথিবী, সৌরজগত ইত্যাদি মহাবিশ্বের সীমার হিসাবে অতি ক্ষুদ্র মাপকাঠিতে পড়ে। কিন্তু আমাদের সাপেক্ষে সবই বিশাল বিস্তৃত, সৌন্দর্যে ভরপুর এবং রহস্যে বেষ্টিত। নিজেদের বাসভূমি এবং প্রতিবেশী গ্রহগুলো সম্পর্কেই বা কতটুকু জানি আমরা! আজকে থেকে শুরু হওয়া এই সিরিজে আমরা এক এক করে প্রত্যেক গ্রহ সম্পর্কে জানব। সমস্ত লিখা জুড়ে থাকবে তাঁদের চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্যসমূহ ও বিভিন্ন সম্ভাবনার গল্প!

বুধ বা Mercury শুনলে প্রথমেই আমাদের মাথায় আসে সূর্যের সবচেয়ে নিকটবর্তী গ্রহটির কথা। তাছাড়া প্রায়শই সন্ধ্যার পশ্চিম আকাশে আমরা শুক্রের পাশাপাশি গ্রহটিকে জ্বলজ্বল করতে দেখি। আবার ভোরেও একে দেখা যায়! যেহেতু এটি সূর্যকে সবচেয়ে দ্রুত প্রদক্ষিণ করে অন্য গ্রহদের তুলনায় তাই রোমানরা তাঁদের দ্রুতগামী বাহক দেবতার নামানুসারে গ্রহটির নামকরণ করে। প্রথমেই বলা হয়েছে বুধ হচ্ছে সূর্যের নিকটতম গ্রহ, স্বাভাবিকভাবেই এর তাপমাত্রা প্রায় ৮৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠে। বিস্ময়কর ভাবে রাতের বেলা তাপমাত্রা নেমে আসে -১৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে! এর মূল কারণ হচ্ছে বুধের উপযুক্ত কোনো বায়ুমণ্ডল নেই যা তাপকে ধরে রাখতে পারে। এটাও বলে রাখা ভালো যে সৌরজগতের সবচেয়ে ছোটো গ্রহটি হলো আমাদের বুধ এবং এতটাই ছোটো যে এর ভর পৃথিবীর চাঁদের চেয়ে সামান্য বেশি। ও হ্যাঁ বুধের নিজস্ব কোনো উপগ্রহ নেই।

যেহেতু বুধের কোনো বায়ুমণ্ডল নেই তাই বড় বড় উল্কা যখন আঘাত করে এর পৃষ্ঠে প্রায় বিনা বাধায়ই বিভিন্ন ছোটো বড় গিরিখাত তৈরি করতে সক্ষম হয়। প্রায় ৪ বিলিয়ন বছর আগে ১০০ কিলোমিটার ব্যাসের একটা গ্রহাণু আঘাত করে বুধের পৃষ্ঠে যার শক্তি ছিল প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ১ মেগাটন বোমের সমান এবং ১৫৫০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে তৈরি হয়েছিল বিশাল গিরিখাত! এটাকে বলা হয় Caloris Basin।
২০১২ সালে নাসার মহাকাশযান MESSENGER(Mercury Surface, Space, ENvironment, GEochemistry and Ranging) বুধের উত্তর মেরুর গিরিখাতে বরফের অস্তিত্ব শনাক্ত করে। ধারণা করা হয় সেই স্থানের এলাকা গুলো সূর্যের আলো থেকে চিরতরে বঞ্চিত। এমনও হতে পারে যে ধূমকেতুর মাধ্যমে সেই গিরিখাত গুলোতে বরফ পৌঁছেছে অথবা গ্রহের অভ্যন্তরীণ থেকে পানি বাষ্পাকারে বেরিয়ে মেরুতে বরফাকারে জমা হয়েছে। বুধ গ্রহ ছোটো আমরা জানি কিন্তু দিন দিন আরো ছোটো হচ্ছে! এর কারণ হলো, গ্রহটি অনেকগুলো প্লেটের উপর নির্মিত যার কেন্দ্র অত্যন্ত ঠান্ডা লোহা দ্বারা তৈরি! সেই কেন্দ্রের লৌহ যখনই তাপ অপসারণ করে ঠান্ডা হচ্ছে তখনই গ্রহের আয়তন কমানোর মাধ্যমে আকৃতিরও সংকোচন ঘটাচ্ছে। বুধে প্রতিনিয়িতই ভূমিকম্প হতে দেখা যায়। এটা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে শুধুমাত্র পৃথিবীই টেকটনিক প্লেট দ্বারা নির্মিত গ্রহ নয়।

বুধ হচ্ছে পৃথিবীর পরে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা সবচেয়ে ঘন গ্রহ! এর ধাতব কেন্দ্র প্রায় ৩৮০০ কিলোমিটার গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত এবং গ্রহের ব্যাসের প্রায় ৭৫% যেখানে এর বাহিরের আবরণ মাত্র ৫০০-৬০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। সবচেয়ে উদ্ভট আবিষ্কার করে Mariner 10 মহাকাশযান। বুধের রয়েছে চৌম্বকীয় ক্ষেত্র! এটা এই কারণে উদ্ভট যে কোনো গ্রহের চৌম্বক্ষেত্র তৈরি হওয়ার জন্য প্রয়োজন নিজ অক্ষে অনেক দ্রুত ঘূর্ণন গতি এবং গলিত কেন্দ্র। বুধ প্রায় ৫৯ দিন সময় নেয় নিজের অক্ষে প্রদক্ষিণ করতে(যেটাকে পৃথিবীর হিসাবে আমরা ১ দিন বলি) এবং আকারে পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ! MESSENGER থেকে প্রাপ্ত ছবি এবং তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা যায় বুধের চৌম্বকক্ষেত্র উত্তর মেরুতে তিনগুণ বেশি শক্তিশালী দক্ষিণমেরু থেকে। গবেষকরা এমনটা ধারণা করছেন যে বুধের কেন্দ্রের বাহিরের আবরণ হয়ত তরল থেকে কঠিনে পরিণত হচ্ছে কিন্তু ভেতর ঠিকই গলিত। ২০০৭ সালে অনুসন্ধানটি করা হয় এবং এখনও ধারণা করা হচ্ছে বুধের কেন্দ্র গলিত অবস্থায় আছে যা গ্রহটির চৌম্বকক্ষেত্র গঠনে সহয়ায়তা করছে। এই চৌম্বকক্ষেত্র অত্যন্ত সক্রিয়। এততাই সক্রিয় যে সূর্য থেকে আগত কণা যখন বুধের ভূমি স্পর্শ করে, চৌম্বকত্বের কারণে শক্তিশালী প্লাজমা টর্নেডো তৈরি হয়! গ্রহটিতে বায়ুমণ্ডল না থাকলেও সৌর বিকিরণে, সৌর বায়ু এবং সূক্ষ্ম উল্কাপিণ্ডের আঘাতের কারণে অতি পাতলা একটি স্তর তৈরি হয় যা খুব সহজেই মহাকাশে দীর্ঘ লেজ বিশিষ্ট কণা হিসেবে মিলিয়ে যায়!

বুধ প্রতি ৮৮ দিনে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে প্রায় ১৮০০০০ কিলোমিটার/ঘন্টা গতিতে; অন্য যেকোনো গ্রহ থেকে দ্রুততর। সূর্য থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৫৭,৯০৯,১৭৫ কিলোমিটার। বুধের কক্ষপথ ডিম্বাকৃতির এবং সর্বোচ্চ উপবৃত্তীয় আকারে রয়েছে। এই আকৃতির কারণে বুধ প্রদক্ষিণের সময় সূর্যের সর্বোচ্চ নিকটবর্তী প্রায় ৪৭ মিলিয়ন কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আবর্তন করে(অনূসুর) এবং সর্বোচ্চ দূরবর্তী(অপসুর) প্রায় ৭০ মিলিয়ন কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে থাকে। সূর্যের সবচেয়ে নিকটবর্তী থাকাকালীন কেউ যদি বুধে অবস্থান করে তাহলে পৃথিবী থেকে সূর্যকে যেরকম বড় দেখা যায় তা থেকেও সে সূর্যকে তিনগুণ বড় দেখবে! অতি উপবৃত্তীয় কক্ষপথের কারণে বুধ ৫৯ দিন সময় নেয় নিজের কক্ষপথে আবর্তন করতে অথবা সহজ বাংলায় পৃথিবীর একদিন বুধের ৫৯ দিন। এবং মজার ব্যাপার হলো এই দীর্ঘ “একদিন” এর কারণে একদিনেই বেশ কয়েকবার সূর্য উদিত হয় এবং অস্ত যায়!
নাসা’র মতে বুধের বায়ুমণ্ডল না থাকলেও উপরে যে পাতলা বায়ুমণ্ডলস্বরূপ স্তরের কথা বলেছি সেটিতে রয়েছে প্রায় ৪২ ভাগ অক্সিজেন, ২৯ ভাগ সোডিয়াম, ২২ ভাগ হাইড্রোজেন, ৬ ভাগ হিলিয়াম এবং দশমিক ৫ ভাগ অন্যান্য গ্যাসীয় পদার্থ। বুধের চৌম্বকক্ষেত্রের শক্তি পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের প্রায় ১ শতাংশ বা টার চেয়েও কম।

পৃথিবী থেকে যতগুলো মহাকাশযান পাঠানো হয়েছে এর মধ্যে মেরিনার ১০ হচ্ছে প্রথম যেটি কিনা বুধের ৪৫ ভাগ পৃষ্ঠের ছবি তুলে এবং সাহায্য করে এর চৌম্বকক্ষেত্রে সম্পর্কে জানার। নাসার MESSENGER ছিল দ্বিতীয় মহাকাশযান যা পাঠানো হয়েছিল ২০১১ সালে। এটি ছিল আবার প্রথম মহাকাশযান যা বুধকে প্রদক্ষিণ করে। ২০১৫ সালে যখন মহাকাশযানটির জ্বালানি ফুরিয়ে আসে তখন তা বুধের পৃষ্ঠে পতিত হয়। ২০১২ সালে বিজ্ঞানীরা মরক্কোতে কিছু উল্কাপিণ্ড পান এবং পরীক্ষার পর ধারণা করা হয় তা বুধ থেকে এসেছে। যদি এটা হয়ে থাকে তবে তা হবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রাপ্তি। কারণ পৃথিবীতে শুধুমাত্র চন্দ্র, মঙ্গল এবং ‘এস্ট্রয়েড বেল্ট’ থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন ধ্বংসাবশেষ শনাক্ত করা গেছে। ২০১৬ সালে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং ছবি একত্র করে বুধের প্রথম ডিজিটালাইজড মডেল তৈরি করেন। সেখান থেকে দেখা যায় বুধের সর্বোচ্চ উচু জায়গার দূরত্ব ভূমি থেকে প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার এবং নিচু স্থানের দূরত্ব প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। গত মার্চেই একটা গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় যাতে বলা হয়েছে হয়ত বুধের কিছু কিছু অঞ্চল জীবের বসবাস উপযোগী। মাটি পরীক্ষা করে জানা যায় এখানে একসময় অণুজীবের অস্তিত্ব ছিল এবং এখনও হয়ত আছে। এখন অপেক্ষা শুধু সঠিক সময় এবং ভবিষ্যত প্রযুক্তির, অচিরেই বুধের মতো নির্মম গ্রহে মানুষ কোনো একদিন পাড়ি জমাবে!
তথ্যসূত্রঃ space.com, NASA Solar System Exploration, ESA