স্ট্রেঞ্জ ম্যাটারঃ মহাবিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক বস্তু

স্ট্রেঞ্জ ম্যাটার? It’s sounds strange, right? ম্যাটারের নামটা অদ্ভুত শোনালেও, আদতে এটা কিন্তু আমাদের জন্য বেশ বিপদজনক। কারণ স্ট্রেঞ্জ ম্যাটারের ব্যাপারে বলতে গেলে আমরা তেমন কিছুই জানি না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুনির্দিষ্ট কিছু শর্ত ঠিক থাকলে, স্ট্রেঞ্জ ম্যাটার আমাদের গ্রহকে জীবন্ত গ্রাস করে নিতে পারবে। কী ভয়ংকর ব্যাপার!

স্ট্রেঞ্জ ম্যাটারকে বুঝতে গেলে প্রথমেই জানতে হবে প্রোটন, নিউট্রন আর নিউট্রন স্টারের ব্যাপারে। মৌলিক পদার্থের যে ক্ষুদ্রতম কণা (unit) যা ঐ পদার্থের ধর্ম অক্ষুণ্ণ রেখে স্বাধীন ভাবে বিরাজ করতে পারে, সেটা হচ্ছে পরমাণু। এর আকার অত্যন্ত ক্ষুদ্র। খালি চোখে দেখা যায় না। এই পরমাণু তিন-ধরণের কণার সমন্বয়ে গঠিত। ইলেকট্রন, প্রোটন আর নিউট্রন। প্রোটন আর নিউট্রন থাকে পরমাণুর কেন্দ্রে, নিউক্লিয়াসে। আর ইলেকট্রন নির্দিষ্ট কক্ষপথে নিউক্লিয়াসে চারপাশে ঘুরতে থাকে।

গঠন দেখে মনে হতেই পারে, অনেক চাপাচাপি করে এরা একে অপরের গায়ে লেগে আছে। কিন্তু সেরকম নয়। যদি আরও কাছ থেকে দেখা যায়, তাহলে এই ফাঁকা স্থান বোঝা যায়। প্রশ্ন আসতে পারে ,যদি ফাঁকা স্থান থেকেই থাকে তবে আমাদের হাতকে এত শক্ত লাগে কেন? হাতে আঙ্গুল দিয়ে চাপ দিলে আঙ্গুল তো হাতের ভেতরে ঢুকে যায় না। যতই আপনি আঙ্গুলে চাপ প্রয়োগ করবেন হাতের অণুগুলো ততই বাধা দিতে থাকবে। কী হবে যদি অনেক চাপ প্রয়োগ করে হয়? তখন এই অত্যধিক ফোর্স বা চাপের কারণে নিউক্লিয়াস গুলো একে অপরের সাথে যুক্ত হয়ে যাবে, এবং নতুন মৌল তৈরি করবে।

হাতের উপর এই এক্সপেরিমেন্ট চালানো না গেলেও এরকম টা ঘটে নিউট্রন স্টারের সাথে। তাহলে এবার নিউট্রন স্টারের ব্যাপারে জানা যাক। আমরা জানি যে নক্ষত্রে বিস্ফোরণের ফলে ব্ল্যাক হোলের জন্ম। কিন্তু নক্ষত্রটি যদি অতো বড় না হয় ( সূর্যের ১.৪ গুণ বড়) তবে সেই বিস্ফোরণের ফলে নিউট্রন স্টারের জন্ম হয়। পরমাণুর গঠন থেকে আমরা জানি যে একটি পরমাণুর বেশির ভাগ ভরই এক কেন্দ্রে রয়েছে। একইভাবে যখন একটা বৃহদাকৃতির মৃতপ্রায় নক্ষত্রের বিস্ফোরণ হয় তখন এর বাইরের অংশ বিস্ফোরিত হয়ে শুধুমাত্র কেন্দ্র বা কোর অবশিষ্ট থাকে। পরমাণুর সাথে এর পার্থক্য হল এই যে, নিউট্রন স্টারের ক্ষেত্রে অবশিষ্ট থাকে শুধুমাত্র নিউট্রন। যে কারণে এর ওজন হয় অস্বাভাবিক বেশি। প্রায় ১০ মাইল দীর্ঘ যা কিনা নক্ষত্রের তুলনায় ছোট এক বিন্দু। এক-চামচ নিউট্রন স্টারের ওজন দাঁড়ায় প্রায় ১০ মিলিয়ন টন। বোঝাই যাচ্ছে যে , এই নিউট্রন স্টারের নিউট্রন গুলো কত ঘনভাবে পাশাপাশি অবস্থান করে। তাদের মাঝে দূরত্ব থাকে নগণ্য।

বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, একসময় নিউট্রনগুলো এই ভর কেন্দ্রীভূত করে রাখতে পারবেনা। যে স্ট্রাকচারটা এই পুরো নিউট্রন স্টারকে ধরে রেখেছে সেটা ভেঙ্গে যাবে। এতে করে গঠিত হবে Quark স্টার। কোয়ার্ক স্টার, নিউট্রন স্টারের থেকে আকারে ছোট কিন্তু অনেক বেশি ঘন। এর ভেতরকার প্রেশার বাড়তে থাকলে এর কোরে “স্ট্রেঞ্জ কোয়ার্ক” এর আবির্ভাব হবে। এদেরকে স্ট্রেঞ্জ বলা হচ্ছে কারণ এরা সাধারণ কোয়ার্কের মতন আচরণ করে না। যদি এই স্ট্রেঞ্জ কোয়ার্কের সংখ্যা অনেক বেশি হয় তবে এরা স্ট্রেঞ্জ ম্যাটার তৈরি করে। এই স্ট্রেঞ্জ ম্যাটার হচ্ছে অন্য যেকোনো ম্যাটার থেকে অনন্য এবং আলাদা। আর এটা পৃথিবীর জন্য ক্ষতিকারক।এই স্ট্রেঞ্জ ম্যাটার হচ্ছে অন্য যেকোনো ম্যাটার থেকে অনন্য এবং আলাদা। আর এটা পৃথিবীর জন্য ক্ষতিকারক।

বুঝতে কঠিন লাগছে? তবে একটা সোজা উদাহরণ দিয়ে গোটা বিষয়টাকে আরেকবার ব্যাখ্যা করা যাক। যদি কোনও লোহার টুকরোকে অস্বাভাবিক বেশি প্রেশার দেওয়া হয় , তবে অচিরেই এই লোহার টুকরোর পরমাণুর নিউট্রন,প্রোটন বিস্ফোরিত হয়ে কোয়ার্কে পরিণত হবে। আরও বেশি প্রেশারের পরিমাণ বাড়ালে কিছু কোয়ার্কের ওজন বেড়ে গিয়ে স্ট্রেঞ্জ কোয়ার্কে পরিণত হবে। এরফলে লোহার টুকরোটা আগের অবস্থায় না থেকে স্ট্রেঞ্জলেট ( Strangelet ) এ পরিণত হবে। যা কিনা স্ট্রেঞ্জ ম্যাটারের ক্ষুদ্র একটি অংশ।

স্ট্রেঞ্জ ম্যাটার আমাদের পরিচিত ম্যাটারের তুলনায় অনেক বেশী ভারী। এছাড়াও আমাদের পরিচিত ম্যাটারের গঠন বেশ গোছানো এবং অনুমেয়। কিন্তু স্ট্রেঞ্জ ম্যাটার ঠিক এর উল্টোটা। স্ট্রেঞ্জ ম্যাটারের কোয়ার্কগুলোর কোনও সীমা নেই। তারা ইচ্ছামতন ছুটে বেড়ায়। এতো বিশৃঙ্খলার পরেও স্ট্রেঞ্জ ম্যাটার স্থিতিশীল, অনেক ঘন অবস্থায় থাকতে পারে। কিন্তু এই স্থিতিশীলতাই বিপদজনক। স্ট্রেঞ্জ ম্যাটার মহাবিশ্বের যেকোনো জায়গায় স্থিতি বজায় রাখতে পারবে। এমনকি নিউট্রন স্টারের বাইরেও এমন স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পারবে। সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হচ্ছে স্ট্রেঞ্জ ম্যাটার সংক্রামক অর্থাৎ ছড়িয়ে পড়তে পারে। যদি কোনও স্ট্রেঞ্জ ম্যাটার এরকম ঘুরে বেরায় তবে আশেপাশের সব কিছুকে গ্রাস করে নিতে পারে, এমনকি গোটা মহাবিশ্বকেও। এটা যাকেই স্পর্শ করবে তা স্ট্রেঞ্জ ম্যাটারে পরিণত হবে।

আপাতত স্ট্রেঞ্জ ম্যাটার নিয়ে চিন্তার কিছু নেই, কারণ নিউট্রন স্টার এখনও কয়েক হাজার আলোকবর্ষ দূরে। যদি দুটো নিউট্রন স্টার একে অপরের সাথে ধাক্কা খায় কিংবা একটি নিউট্রন স্টারর কোনও ব্ল্যাক হোলের উপর আছড়ে পরে তবেই স্ট্রেঞ্জলেট গুলো ছাড়া পাবে ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়ানোর জন্য। তখন এই স্ট্রেঞ্জলেট গুলো Millions Per Mile বেগে ছুটে আসতে থাকবে। যতক্ষণ না তাদের গতিপথে গ্রাস করে নেওয়ার মতো কিছু পড়ছে ততক্ষণ তারা কয়েক বিলিয়ন বছর এভাবে বিনা বাধায় ছুটে চলতে পারবে। স্ট্রেঞ্জ ম্যাটার সামনে যা-ই পাবে তাকেই গ্রাস করে নেবে। হোক সেটা কোনও জড় পদার্থ কিংবা পৃথিবী। এবং সবকিছুকে স্ট্রেঞ্জ ম্যাটারে পরিণত করবে।

স্ট্রেঞ্জ ম্যাটাররের হাত থেকে বাঁচার উপায় কী?

স্ট্রেঞ্জ ম্যাটারকে রুখে দেওয়ার জন্য একটা উপায় আছে, কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে তা অসম্ভব। স্ট্রেঞ্জ ম্যাটারকে ব্ল্যাক হোলে ছুড়ে ফেলে দিতে হবে। কিন্তু যা দিয়ে স্ট্রেঞ্জ ম্যাটারকে ছুড়ে ফেলবো,  সেটাও তো নিমিষে স্ট্রেঞ্জ ম্যাটারে পরিণত হবে। আরেকটা কিন্তু হচ্ছে ব্ল্যাক হোলের কাছে পৌছাবে কিভাবে? যেখানে ব্ল্যাক হোল আলোকেও আটকে ফেলে, বের হতে পারে না এর অত্যাধিক গ্রাভিটেশনাল ফোর্সের কারণে।

স্ট্রেঞ্জ ম্যাটারের অস্তিত্ব তাত্ত্বিকভাবে থাকলেও, এখনো বাস্তবে এর দেখা মেলেনি। পদার্থবিদেরা পার্টিকেল এক্সেলেটরের মাধ্যমে স্ট্রেঞ্জ ম্যাটার তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছেন। পরবর্তীতে তারা সিদ্ধান্তে এলেন যে, পার্টিকেল এক্সেলেটর স্ট্রেঞ্জলেটের সংস্পর্শে এলে অত্যধিক গরম হয়ে যাবে , যাতে আর স্ট্রেঞ্জ ম্যাটার তৈরি করা সম্ভব নয়। যদি কোনভাবে স্ট্রেঞ্জ ম্যাটার ল্যাবে তৈরি করা যায়-ও তবু তা পজিটিভ চার্জে থাকবে এবং শুধুমাত্র কাছের ইলেকট্রনগুলোকেই আকর্ষণ করবে। এধরণের স্ট্রেঞ্জলেট আমাদের জন্য হুমকির নয়। এছাড়াও আশার কথা এই যে, পৃথীবীর জন্মলগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত কোনও স্ট্রেঞ্জ ম্যাটার পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসেনি। তাই এর অদূর সম্ভাবনা একদম নেই বললেই চলে।

তথ্যসুত্র – Bright Side

Comments are closed.