আচ্ছা বল তো অনেক রকমেরই আছে। কখনো কি মনে প্রশ্ন জেগেছে যে জগতের এত বলগুলোর মধ্যে কোনটি সবচেয়ে শক্তিশালী? কণা পদার্থবিজ্ঞান বা পার্টিকেল ফিজিক্স নিয়ে যারা পড়াশোনা করেন তাঁদের নিতান্তই একখণ্ড শুকনো কাঠের টুকরোর মতো নিরস মনে হলেও এই জগতে রয়েছে অপরিমেয় বিস্ময় ও আনন্দ! মৌলিক নিউক্লিয়ার বল গুলোর প্রশ্ন যখন আসে তখনই আগমন ঘটে সবচেয়ে শক্তিশালী বল কোনটা সেটার। সহজ বাংলায় এটাই সবচেয়ে শক্তিশালী বল যেটা সম্পূর্ণ মহাবিশ্বকে একসাথে ধরে রেখেছে। অদ্ভুত না? চলুন বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়া যাক।
প্রাথমিক কণাগুলোর উপর আলোকপাত করি, সবচেয়ে শক্তিশালী বল কে খুঁজে বের করতে হলে আমাদের আগে প্রাথমিক কণাগুলো সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। ধরা যাক হিলিয়াম পরমাণুর কথা, এখানে দুটো ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। নিউক্লিয়াসে রয়েছে দুটো নিউট্রন, দুটো প্রোটন। আমাদের স্কুল কলেজ লেভেলে কণার ক্ষুদ্রতা নিয়ে এটুকুই ছিল জ্ঞান। কিন্তু আপনি আরো গভীরে ব্যাপারটিকে নিয়ে যেতে পারবেন। জুম করে তাকালে দেখতে পাবো, এই প্রোটন আর নিউট্রন হচ্ছে বিশেষ এক শ্রেণীর কণা যার নাম হচ্ছে হ্যাড্রন! এই হ্যাড্রন আবার আরো ক্ষুদ্র কণায় দ্বারা তৈরি যাদের বলা হয় কোয়ার্ক। এই কোয়ার্কই হচ্ছে সর্ব প্রাথমিক কণা, এদের আর ভাঙা যাবেনা। অর্থাৎ কোনো বস্তু কোয়ার্ক পর্যায়ে এলে এদের থেকে ছোটো আর কিছু পাওয়া যাবেনা। এই প্রাথমিক কণা বা এলিমেন্টারি পার্টিকেলের আরো একটি শ্রেণী রয়েছে যার নাম হচ্ছে লেপ্টন! লেপ্টনের রয়েছে ৬ টি আলাদা “ফ্লেভার” যাদের প্রত্যেকের এন্টিম্যাটার ভার্সন বা প্রতিপদার্থ রয়েছে। (আমাদের হিলিয়ামের ইলেকট্রন হচ্ছে লেপ্টনের একটি ফ্লেভার। যতটুকু সম্ভব আমরা জুম করে ক্ষুদ্র একটি জগতের বিশাল অংশ পরিভ্রমণ করলাম।) হারিয়ে যাচ্ছেন? নিচের ডায়াগ্রামটি দেখুন।

প্রকৃতির মধ্যস্থিত বলসমূহ:
এই ধাঁধাঁর আরো চারটি অংশ রয়েছে যাদেরকে আমরা বলি আদর্শ মডেল। এবং এটাই সব থিওরির মহা থিওরি যখন কণা পদার্থবিজ্ঞানের দিকে অগ্রসর হই। এই অংশগুলো হচ্ছে মহাবিশ্বের মৌলিক বলগুলো। এগুলোর কথা প্রায় সবাই-ই জানি। জড়তা সম্পন্ন দুটি বস্তুর মধ্যকার আকর্ষণ যে বলের কারণে হয় সেটি হচ্ছে মহাকর্ষ বল। আবার দুটি চার্জিত কণার মধ্যে যে আকর্ষণ বল সেটার নাম তড়িৎচৌম্বকীয় বল। অন্য যে দুটি বল সেগুলো হচ্ছে নিউক্লিয়ার বল। এই দুটি নিয়ে এত বেশি আমরা জানিনা কারণ উভয়েই সংঘটিত হয় আণবিক পর্যায়ে। একটি হচ্ছে দুর্বল নিউক্লিয় বল, আরেকটি হচ্ছে সবল নিউক্লিয় বল। দুর্বল নিউক্লিয় বল ইলেকট্রন আর নিউট্রিনোর(আরেক ধরনের লেপ্টন) মধ্যবর্তী বল হিসাবে কাজ করে। কিন্তু আমরা এখানে এসেছিই সবল বা এই শক্তিশালী বল নিয়ে আলোচনা করতে।

সবল বল হচ্ছে সেই শক্তিশালী বল যা কোয়ার্কের মতো কণাগুলো কে যুক্ত করে প্রোটন আর নিউট্রনের মতো হ্যাড্রন কণা সৃষ্টি করে। বিজ্ঞানীরা প্রথমেই এই শক্তিশালী বলটির অস্তিত্ব অনুমান করে ফেলেছিলেন, কারণ তখনও বুঝে উঠা সম্ভব হয়নি ঠিক কী কারণে একটি নিউক্লিয়াসে একাধিক পজেটিভ বা ধ্বনাত্মক চার্জযুক্ত প্রোটন একসাথে অবস্থান করে! কারণ আপনি স্বাভাবিক চিন্তা করুন, একটি চুম্বকের বেলায় আমরা দেখেছি সমমেরু পরস্পরকে বিকর্ষণ করে। সময়ের সাথে পদার্থবিজ্ঞানীরা বুঝতে পারলেন যে, এই শক্তি শুধুমাত্র প্রোটনকে যে নিউক্লিয়াসের মধ্যে রাখতে সাহায্য করে তা নয় বরং প্রোটন অভ্যন্তরে থাকা কোয়ার্ক গুলোকেও একীভূত রাখে। এই রহস্যময় শক্তিটা আসে বাহক কণা বা ক্যারিয়ার পার্টিকেল হিগস বোসন থেকে! (মনে আছে ২০১২ সালে আবিষ্কৃত হিগসের কথা?)। এই বলকে বলা হয় “গ্লুওন”। গ্লুওন এসেছে গ্ল্যুজ(Glues) থেকে কারণ সেটা নিউক্লিয়াসের এলিমেন্ট গুলোকে একসাথে রাখে!
তাড়িৎচৌম্বকীয় বলের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, চার্জিত কণা যতদূরে যায়, তাঁদের মধ্যে আকর্ষণ কমতে থাকে। কিন্তু যে বিষয়টি শক্তিশালী বলটিকে বিশেষত্ব দান করে সেটি হচ্ছে, এই বল ততই বাড়তে থাকে এবং শক্তিশালী হয় যখন কণা দূরে সরে যায়! দুটি কোয়ার্ক একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত পরস্পর দূরে যেতে পারে, যখনই সেই সীমানাটা অতিক্রম করে ফেলে, ম্যাজিক মুহূর্তটা তখনই তৈরি হয়। যে বিপুল পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন করে তাঁরা সেটি ভর হিসাবে রূপান্তরিত হয়। মানে আইন্সটাইনের বিখ্যাত E=mc^2 ফর্মুলা বাস্তবে রূপ নেয়। অর্থাৎ মহাবিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালি বল এতোটাই শক্তিশালী যে এটি শক্তিকে ভরে রূপান্তরিত করে ফেলতে পারে! এবং এই ভরটাই সকল অস্তিত্বের কারণ!
আমরা অনেকটুকু কণা পদার্থবিজ্ঞান শিখে ফেললাম আজ। কেউ হাঁপিয়ে যাননি তো?
Source: Curiosity.com