ভয়ানক সূর্যের প্লাজমা। পর্ব-১

আপনারা কি জানেন, সূর্যের কেন্দ্রের তাপমাত্রা কত? এই তাপমাত্রায় পদার্থ কী অবস্থায় থাকে?  সূর্যের কেন্দ্রের তাপমাত্রা ১৫ মিলিয়ন ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। বুঝতেই পারছেন, কত গরম। আসলে অবিশ্বাস্য গরম। ভাবতে পারেন, এই তাপমাত্রায় আমাদের সুন্দর, সুশােভিত পৃথিবীকে নিয়ে গেলে কী ঘটবে?

কি? ভাবতে কষ্ট হচ্ছে নিশ্চয়ই?  তখন গােটা পৃথিবী প্লাজমায় পরিণত হবে। কিন্তু, প্লাজমাটা আসলে কী জিনিস? প্লাজমা হলাে পদার্থের একটি অবস্থা বা দশা। এই দশাই আছে সূর্য তথা তারকার গাঠনিক মূল উপাদান বা পদার্থ। আপনারা শুনে বিস্মিত হবেন যে, প্লাজমা হলাে আয়তন ও ভরে মহাবিশ্বে সবচেয়ে বেশী পদার্থের সাধারণ ভৌত অবস্থা। সকল নক্ষত্র, আন্তঃছায়াপথীয় এবং আন্তঃগ্রহীয় স্থান প্লাজমার পরিপূর্ণ। তাহলে জেনে নেই প্লাজমা কী?

প্লাজমা কী?

আচ্ছা, আপনি যদি বরফকে তাপ দেন তবে পানি পাবেন, আর পানিকে তাপ দিলে বাষ্প পাবেন নিশ্চয়ই। এখন বাম্পকে একটি আবদ্ধ পাত্রে রেখে প্রচণ্ড তাপ দিলে কী ঘটবে জানেন? প্রথমত, পানি গঠনকারী মৌলিক পদার্থ হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন আলাদা হয়ে যাবে। এখানেই শেষ নয়, হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস ও ইলেকট্রন পরস্পর আলাদা হয়ে মুক্তভাবে বিচরণ করবে। নিউক্লিয়াস ও ইলেকট্রনের মধ্যে কোনােই আকর্ষণ বল থাকবে না। এই অবস্থার নাম প্লাজমা।

কী! আঁচ করতে পেরেছেন, পৃথিবীকে ঐ তাপমাত্রায় নিয়ে গেলে কী ঘটবে? সুতরাং বুঝতেই পারছেন, প্লাজমা কঠিন, তরল ও গ্যাসের মতাে পরমাণুর একটি মিশ্রণ নয়। প্লাজমা হলাে ইলেকট্রন এবং আয়নের মিশ্রণ। সূর্যের কেন্দ্রে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম এবং সামান্য পরিমাণ অন্যান্য ভারী মৌল যে ভৌত অবস্থায় বিরাজ করে তার নামও প্লাজমা। আর যেখানে ফিউশন বিক্রিয়া ঘটে থাকে। প্লাজমার শক্তি গ্যাসীয় অবস্থার চাইতে অনেক বেশী।

সুতরাং বুঝতেই পারছেন, কঠিন বস্তু, তরল, গ্যাসের মতাে প্লাজমাও পদার্থের একটি অবস্থা। একে পদার্থের চতুর্থ অবস্থা বলা হয়।

একটি পরমাণুর এক বা একাধিক ইলেকট্রন স্থির তড়িৎ বন্ধন বলকে অতিক্রম করার মতাে যথেষ্ট শক্তি অর্জন করতে পারলে ঐ ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে। এই আয়নিত অবস্থার ফলাফল হল প্লাজমা। আয়নিত হওয়ার পর সিস্টেমের শক্তি কমে গেলে ইলেকট্রনের ঋণাত্মক চার্জ নিউক্লিয়াসের ধনাত্মকভাবে চার্জিত প্রােটনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে এবং আয়ন, ইলেকট্রন পুনর্মিলিত হয়ে তড়িৎ নিরপেক্ষ পরমাণুতে পরিণত হয়। একটি পরমাণু আংশিকভাবে আয়নিত (কিছু ইলেকট্রন হারিয়ে) বা সম্পূর্ণরূপে আয়নিত (সব ইলেকট্রন হারিয়ে) হতে পারে। আর এটা নির্ভর করবে পরমাণুর ইলেকট্রনের অর্জিত শক্তির উপর।

আচ্ছা, বলতে পারবেন কি, হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের মধ্যে কোনটির সম্পূর্ণরূপে আয়নিত হওয়া সহজ? নিশ্চয়ই হাইড্রোজেন। কিন্তু হিলিয়াম আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে আয়নিত হতে পারে, কারণ হিলিয়ামের একাধিক ইলেকট্রন রয়েছে। বৃহত্তর পরমাণুসমূহ এক, দুই, তিন বা আরও ইলেকট্রন হারিয়ে অধিকভাবে আংশিক আয়নিত হতে পারে।

পাঠকরা, একটি বিষয় মনে রাখতে হবে। প্লাজমায় আয়নিত নিউক্লিয়াস ও ইলেকট্রনের সংখ্যা সমান। একটি প্লাজমা মিশ্রনে প্রােটন ও মুক্ত ইলেকট্রনের সংখ্যা সমান থাকে। যে-কোনাে তড়িৎ নিরপেক্ষ পরমাণু আয়নিত হয়ে প্লাজমায় পরিণত হতে পারে। তাইতাে শুধু ইলেকট্রন বা অন্য কণার রশ্মি প্লাজমা নয়। প্রত্যেক পদার্থের মতাে প্লাজমা কিছু সমষ্টিগত আচরণ প্রদর্শন করে থাকে। যেমন প্লাজমার বৈদ্যুতিক এবং চৌম্বকীয় বৈশিষ্ট্য আছে। অধিকাংশ (কিন্তু সব না) গবেষক একটি মােমবাতি শিখাকে প্লাজমা হিসেবে বিবেচনা করেন না। কারণ এতে খুবই দুর্বল আয়নিত গ্যাস আছে, যা প্লাজমার সমষ্টিগত কিছু বিশেষ আচরণ প্রদর্শন করে না। আরেকটি ধর্ম হল, প্লাজমায় উচ্চ তাপমাত্রার গতিশীল ইলেকট্রন বহির্মুখী চাপ ও চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে। আবার প্লাজমা বিদ্যুৎ পরিবাহী কারণ তারা মুক্ত সঞ্চরণশীল ইলেকট্রন ধারণ করে বিভব পার্থক্য তৈরী করে নির্দিষ্ট দিকে তড়িৎ পরিবহন করে।

বিভিন্ন ধরনের প্লাজমা বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। যেমন, কোল্ড বা শীতল প্লাজমা, আলট্রা কোল্ড বা অতি শীতল প্লাজমা, তাপীয় প্লাজমা ইত্যাদি।

শীতল প্লাজমা খুব কম ঘনত্বের একটি গ্যাসে বৈদ্যুতিক প্রবাহ প্রয়ােগের মাধ্যমে এই ধরনের প্লাজমা তৈরি করা যেতে পারে। একটি গ্যাসে বৈদ্যুতিক শক্তি প্রয়ােগ করা হলে ইলেকট্রন আয়নের তুলনায় অনেক বেশী গতিশক্তি অর্জন করে, কারণ ইলেকট্রনের ভর অনেক কম। ইলেকট্রন এবং আয়ন পরস্পর থেকে দূরে সরে যায়। তাই তাদের মধ্যে বিরল সংঘর্ষ হয় বলেই উল্লেখযােগ্য শক্তি স্থানান্তর ঘটে না। তড়িৎশক্তি প্রবাহের ফলে ইলেকট্রন শক্তি শােষণ করে ও গরম হয়। তাই, যথেষ্ট গতিশক্তি অর্জন করে। কারণ গ্যাসের গতিশক্তি পরম তাপমাত্রার সমানুপাতিক। কিন্তু ঠান্ডা প্লাজমার ক্ষেত্রে পরমাণুর ভরের সব অংশ ধারণকারী আয়ন তাপমাত্রার অভাবে যথেষ্ট গতিশক্তি অর্জন করতে পারে না। তাই আয়নের গতিশক্তি অনেক কম। এর অর্থ এই যে সিস্টেমের গড় গতি শক্তি বা তাপমাত্রা তুলনামূলক কম থাকে। উদাহরণস্বরূপ একটি প্লাজমা টিভি বা একটি নিয়ন আলােতে আয়নিত গ্যাসের শক্তির তুলনায় সূর্যের কেন্দ্রের প্লাজমার শক্তি অনেক গুণে বেশি। প্লাজমা টিভি এক ধরনের ঠান্ডা প্লাজমার উদাহরণ। আপনারা পূর্বেই জেনেছেন, উচ্চ তাপমাত্রায় গতিশীল ইলেকট্রন বহির্মুখী চাপ ও চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরী করে। কিন্তু ঠান্ডা প্লাজমায় এ ধরনের কোনাে উপলব্ধি জনক বহির্চাপ ও চৌম্বক ক্ষেত্র উৎপন্ন হয় না। পৃথিবীর আয়ােনােস্ফিয়ার অঞ্চলের নাম নিশ্চয়ই জানেন, এটা ঠান্ডা প্লাজমার একটি বাস্তব উদাহরণ। আরও জানেন, এই অঞ্চল দিয়ে প্রায়ই সৌর ঝড় প্রবাহিত হয়।

আপনারা ভাবছেন নাকি, পৃথিবীর উপর আবার সূর্যের ঝড়! কতই না ভয়ঙ্কর! সৌর ঝড়ে প্রতি সেকেন্ডে মিলিয়ন মিলিয়ন সৌর কণা পৃথিবীতে আঘাত করছে। তবে ভয় নেই, পৃথিবীর শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্র সব কণার আঘাত থেকে ভূ-পৃষ্ঠকে রক্ষা করে। যাক, এ বিষয়ে অন্য পর্বে আলােচনা করা যাবে। এই অঞ্চলটি আয়নিত গ্যাস এবং উত্তেজিত গ্যাস পরমাণু দ্বারা হালকাভাবে পূর্ণ থাকে। আপনারা কি উত্তেজিত পরমাণু সম্পর্কে জানেন? উত্তেজিত পরমাণু হলাে, সেই সকল পরমাণু যারা এক বা একাধিক ইলেকট্রন নিম্ন শক্তির কক্ষপথ থেকে উচ্চ শক্তির কক্ষপথে নেওয়ার মত শক্তি যােগান দিতে পারে কিন্তু পরমাণুকে পুরাপুরি ত্যাগ করার জন্য যথেষ্ট শক্তি ইলেকট্রনকে যােগান দিতে পারে না। আয়ােনােস্ফিয়ার উত্তেজিত গ্যাসের পরমাণু আভা অরােরা তৈরি করে। অনেক ঠান্ডা প্লাজমাও বিভিন্ন পর্যায়ের উত্তেজিত নিরপেক্ষ পরমাণু ধারণ করতে পারে।

হাইড্রোজেনের মূলত অনেক উত্তেজিত অবস্থা রয়েছে, প্রত্যেক অবস্থায় একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈঘ্যর ফোটন নির্গত  হয়।

অতি শীতল প্লাজমা (ultra cold plasma).

পাঠকগণ, আপনারাতো বুঝলেন, কীভাবে ঠান্ডা প্লাজমা তৈরী করা হয়। আরও জানেন, আমরা অতি শীতল (ultracold) প্লাজমাও পেতে পারি, যা ১° সেন্টিগ্রেড থেকে পরম শূন্য তাপমাত্রা পর্যন্ত শীতল হতে পারে। কীভাবে সম্ভব? এত কম তাপমাত্রায় একটি পরমাণুকে কীভাবে আয়নিত করা সম্ভব?

কি? ভাবতে অবাক লাগছে? সম্ভব, আর সেটা সম্ভব লেজার রশ্মি ব্যবহার করে। লেজার রশ্মি হল একবর্ণী আলাের বিম। যেমন আমরা সূর্য থেকে আসা সাতটি রঙ কে একই সাথে সাদা আলাে হিসেবে দেখি। কিন্তু যদি শুধু একটি বর্ণের আলাে দিয়ে কাজ করি সেটা হলাে লেজার রশ্মি। এখানে লেজার আলােক রশ্মি দিয়ে পরমাণুর সর্ব বহিঃস্থ ইলেকট্রনকে যথেষ্ট শক্তি প্রদান করে নিউক্লিয়াস থেকে মুক্ত করা হয়। ফলে পরমাণু আয়নিত হয়ে অতি শীতল প্লাজমা তৈরি করে। প্লাজমা বৈদ্যুতিকভাবে পরিবাহী কারণ তারা মুক্ত সঞ্চরণশীল ইলেকট্রন ধারণ করে বিভব পার্থক্য তৈরি করে নির্দিষ্ট দিকে তড়িৎ পরিবহন করে। অধিকাংশ আলট্রা প্লাজমা ও ঠাণ্ডা প্লাজমা তড়িৎ অপরিবাহী। তবে কিছু কিছু ঠাণ্ডা প্লাজমা তড়িৎ পরিবহন করে, যখন হাজারাে পরমাণুর মধ্যে কিছু পরমাণু সর্ববহি:স্থ ইলেকট্রন হারিয়ে আয়নিত হয়। তাপীয় প্লাজমা গ্যাসে উচ্চ চাপ প্রয়ােগ করলে গরম বা তাপীয় প্লাজমার সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে আয়ন এবং ইলেকট্রনকে চাপ প্রয়ােগ করা হয় যাতে ঘন ঘন সংঘর্ষ ঘটে এবং তাপের স্থানান্তর ঘটে। ঠান্ডা জমার মতাে নয়, এখানে ইলেকট্রন ও আয়ন একে অপরের সঙ্গে তাপীয় সাম্যাবস্থায় বিরাজ করে। তাপীয় প্লাজমার তাপমাত্রা বৃদ্ধি মানে পরমাণুর আয়নিত হওয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি হওয়া।

এই প্লাজমার সব পরমাণু আয়নিত করতে চাইলে প্রচুর শক্তি প্রয়ােগ করতে হয়। অত্যন্ত উচ্চ চাপের অধীনে ১০০% আয়নিত খুবই উত্তপ্ত গরম প্লাজমা পাওয়া যায়। সূর্যের কেন্দ্রে হিলিয়াম / হাইড্রোজেন প্লাজমা সম্পূর্ণরূপে আয়নিত থাকে।

তথ্য সুত্রঃ Plasma-Universe, Quanta Magazin, PHYS ORG

Comments are closed.