ভয়ানক সূর্যের প্লাজমা। পর্ব-২

১ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

প্লাজমার চরম রূপ

আমাদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে দর্শনীয় সকল পদার্থ কঠিন, তরল বা গ্যাসীয় অবস্থায় আছে। কিন্তু রাতের আকাশে তাকালে মিটমিট করা তারার গঠন সম্পর্কে আপনারা কি জানেন? তারকারাজি কি দিয়ে গঠিত?

এগুলাে কি পৃথিবীর পৃষ্ঠের মতই কঠিন পদার্থে গঠিত? না, এরা গঠিত প্লাজমা দিয়ে। সূর্যের প্লাজমা সকল তারকার প্লাজমার গঠনের প্রতিনিধিত্ব করে না। আমরা বিভিন্ন নক্ষত্রের ভিতরের প্লাজমার অন্বেষণ করলে একটি আভাস পাব। আর তা হলাে, যখন আমরা প্লাজমাতে শক্তি যােগ অবিরত ভাবে করতে থাকব, তখন আমরা পর্যায়ক্রমে পদার্থের চুড়ান্ত ক্ষুদ্রতম এককে তথা মৌলিক কণা খুঁজে বের করতে পারব। আমি এ পর্যন্ত সবচেয়ে সাধারণ প্লাজমার বর্ণনা করেছি। সাধারণ প্লাজমায় ইলেকট্রন অরবিটাল আংশিকভাবে ভেঙ্গে যায় কিন্তু পরমাণু তাদের ভেতরের কক্ষীয় ইলেকট্রন কিছু অরবিটাল ধরে রাখে। অবশ্য সূর্যের কেন্দ্রে থার্মোনিউক্লিয়ার প্লাজমায় পরমাণু সম্পূর্ণভাবে আয়নিত থাকে বলে পরমাণুর অরবিটাল বলতে কিছুই থাকে না। তখন ইলেকট্রন অরবিটালবিহীন পথে মুক্ত ভাবে চলাচল করে। আপনাদের কাছে, বিষয়টা অনেক মজাদার, তাই না? আমরা কিংবা আমাদের পৃথিবীকে ঐ তাপমাত্রায় নেওয়া হলে কোনাে পরমাণুই অবশিষ্ট থাকবে না। সব পরমাণু ভেঙ্গে গিয়ে মুক্ত আয়ন ও ইলেকট্রনে পরিণত হবে। তাহলে কি আমাদের পৃথিবীতে বিরাজমান কঠিন, তরল পদার্থের পরমাণুসমূহ কোনাে এক সময় প্লাজমা অবস্থায় ছিলাে এবং পরবর্তীতে তাপ হারিয়ে বর্তমান অবস্থায় এসেছে? সত্যি তাই।

পাঠকগণ আপনারা সুপারনােভার নাম নিশ্চয়ই জানেন? একটি বিস্ফোরিত সুপারনােভা প্লাজমা সূর্যের কেন্দ্রের প্লাজমা থেকে অনেক গরম ও চাপের মধ্যে থাকে। কিছু গবেষক একে নিউক্লিয়ন প্লাজমা বলে থাকেন। এই প্লাজমায় নিউক্লিয়াসের বন্ধন ভেঙ্গে যায়। সুতরাং এই প্ৰাজমা হলাে ইলেকট্রন, প্রােটন ও নিউট্রনের একটি মিশ্রণ । আর এই প্লাজমাই মহাবিশ্বের সব ভারী উপাদান তথা মৌল তৈরির বিশেষ সৃষ্টিশীল এলাকা (intensely creative zone)।

সুপারনোভা বিস্ফরণ

সুপারনােভা বিস্ফোরণ থেকে প্রাপ্ত এই প্লাজমাকে আরও চাপ প্রয়ােগ করা হলে এর মুক্ত প্রােটন সহজে মুক্ত ইলেকট্রন শােষণ করে নিউট্রনে পরিণত হয়ে অধিক ঘনত্বপূর্ণ (ultra-dense) অঞ্চল তৈরী করবে, যার নাম নিউট্রন তারকা (neutron star)। অর্থাৎ, প্রােটন ও ইলেকট্রন মিলে নিউট্রন তৈরী করে। ইলেকট্রন + প্রােটন = নিউট্রন ভাবতে অবাক লাগছে নাকি?? নিউট্রন তারার আরও অধিক উচ্চ শক্তির অবস্থার অধীনে চাপ প্রাপ্ত হলে চরম ঘনত্বপূর্ণ ভারী নিউট্রন তারকার মধ্যস্থ নিউট্রন ভেঙ্গে গিয়ে মুক্ত কোয়ার্কগ্রয়ন তৈরী করে। যার নাম, কোয়ার্ক- গুয়ন প্লাজমা। আপনারা জানেন, এই মহাবিশ্বে অনেক কোয়ার্ক স্টার আছে। পৃথিবীটা কত বিশাল, কিন্তু জেনে আশ্চর্য হবেন, আমাদের পৃথিবীর ভরের সমান একটি তারকা যদি কোয়ার্কে পরিণত হয় তবে এর আয়তন হবে এক চা চামচ পরিমাণ। চিন্তা করেছেন, কত ঘনত্বের অধিকারী হলে এটি সম্ভব? সুতরাং কোয়ার্ক – গ্ৰয়ন হলাে ইলেকট্রন, প্রােটন ও নিউট্রনের গাঠনিক ক্ষুদ্রতম কণা। যখন মহাবিশ্বের বয়স এক মিলিসেকেন্ডে ছিলাে, তখন কোয়ার্ক-গ্রয়ন পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা হিসেবে বিরাজ করে ছিলাে। গবেষকরা অনুমান করেন যে এই মহাবিশ্বে কোয়ার্ক ভেঙ্গে প্রিয়ন (Preon) নামক আরও এক ধরনের প্লাজমা থাকতে পারে। সুতরাং মহাবিশ্বের সৃষ্টিকালীন সময়ের মৌলিক কণা সম্পর্কে জানার জন্য প্লাজমা একটি সহায়ক মাধ্যম।

সৌর প্লাজমায় হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম থাকে। আপনারা জানেন যে, সূর্যের কেন্দ্রে মূলত সম্পূর্ণরূপে আয়নিত হিলিয়াম এবং হাইড্রোজেন গ্যাসের মিশ্রণ। এখন দেখা যাক, পরমাণু দুটি কিভাবে আয়নিত হয়। হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম এর আলাদা আলাদা হয়। বস্তুত, প্রত্যেক পরমাণুর নিজস্ব ভিন্ন আয়নীকরণ বিভব শক্তি রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, হাইড্রোজেনের শুধুমাত্র একটি আয়নীকরণ বিভব শক্তি আছে। যেমন আমরা আগে দেখেছি, যদিও এর অনেক উত্তেজিত অবস্থার শক্তি রয়েছে। যার মান প্রতি মােলে ১৩১২ কিলােজুল। তার একটি ইলেকট্রনকে অপসারণ করতে প্রতি মােলে ১৩১২ কিলােজুল শক্তি প্রয়ােজন হয়। হিলিয়ামের প্রথম আয়নীকরণ বিভব প্রতি মােলে ২৩৭২ কিলােজুল এবং দ্বিতীয় আয়নীকরণ বিভব প্রতি মােলে ৫২৫০ কিলােজুল। হিলিয়ামের প্রথম আয়নীকরণ বিভব, হাইড্রোজেনের প্রথম আয়নীকরণ বিভব থেকে দ্বিগুণ। আবার হিলিয়ামের দ্বিতীয় আয়নীকরণ বিভব, হিলিয়ামের প্রথম, আয়নীকরণ বিভব থেকে দ্বিগুণ। এবং আসলে প্রতি মােলে ৫২৫০ কিলােজুল, যা কোনাে উপাদান মৌলের সর্বোচ্চ আয়নিত হওয়ার শক্তি। তাই চিন্তার বিষয়, কেন হিলিয়াম আলাদা?

নিমােক্ত কয়েকটি কারণে হিলিয়ামের আয়নীকরণ বিভব সবচেয়ে বেশি।

১. হিলিয়ামের একটিমাত্র অরবিটাল বা উপস্তর 1s, যা সর্বোচ্চ দুটি ইলেকট্রন রাখতে পারে। হিলিয়ামের এই অরবিটালকে পূর্ণ করার মতাে দুটি ইলেকট্রন আছে। এই পূর্ণ অরবিটাল অনেক স্থিতিশীল।

২. হিলিয়ামের একটিমাত্র অরবিটাল হওয়ায় নিউক্লিয়াস ও ইলেকটনের মধ্যকার আকর্ষণ বল অনেক বেশী। যা হিলিয়াম পরমাণুর স্বতন্ত্র একটি বৈশিষ্ট্য। ফলে এই পরমাণু অনেক স্থিতিশীল।

৩. হিলিয়াম নিষ্ক্রিয় গ্যাস বলে এটি সহজে আয়নিত হয় না বা ইলেকট্রন দান করে না।

উপরােক্ত কয়েকটি কারণে হিলিয়ামের আয়নীকরণ বিভব অন্যান্য মৌল থেকে অনেক বেশী। হিলিয়াম এবং হাইড্রোজেনকে সম্পূর্ণরূপে আয়নিত করতে প্রয়ােজনীয় শক্তি সূর্যের কেন্দ্রে যথেষ্ট পরিমাণে রয়েছে। পৃথিবীর উপর অবস্থিত বায়ুমন্ডলে এই উপাদান গ্যাস দুটির পরিমাণ খুবই সামান্য। যদিও হিলিয়াম সবসময় একটি গ্যাস হিসাবে পাওয়া যায়, হাইড্রোজেন খুব প্রচুর পরিমাণে বিভিন্ন যৌগের মধ্যে বিরাজ করে। তুলনা করলে দেখা যায়, পৃথিবীতে সমুদ্রতলে ০° সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় হাইড্রোজেন গ্যাসের ঘনত্ব প্রতি ঘন সেন্টিমিটারে ০.০০০০৯ গ্রাম, কিন্তু সূর্যের কেন্দ্রে যার ঘনত্ব প্রতি ঘন সেন্টিমিটারে ১৫০ গ্রাম। যা প্রায় পৃথিবীর দুই মিলিয়ন গুণ বেশি।

প্লাজমায় পরিণত হতে প্রয়ােজনীয় শক্তির উৎস

আপনারা নিশ্চয়ই ভাবছেন, সূর্য হিলিয়াম ও হাইড্রোজেনকে আয়নিত করার মতাে এত শক্তি পায় কোথায়? জেনে অবাক হবেন, প্লাজমায় পরিণত হতে প্রয়ােজনীয় শক্তি বিভিন্ন মাধ্যম থেকে আসে। তাপ, ইলেকট্রোম্যাগনেটিক বিকিরণ এবং বৈদ্যুতিক চার্জ পরমাণুকে প্লাজমায় পরিণত হতে প্রয়ােজনীয় শক্তি সরবরাহ করে। যেমন, প্লাজমা টিভিতে বিদ্যুৎ এ শক্তি যােগান দেয় । ultracold প্লাজমার মioধ্যে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক বিকিরণ (একটি লেজার) এই শক্তির যােগান দেয়। পৃথিবীর আয়নােস্ফিয়ার অঞ্চলে দ্রুততম ইলেকট্রন সঙ্গে সংঘর্ষে বায়ুমণ্ডলীয় গ্যাসের কণা আয়নিত হয়। সূর্যের মধ্যে গ্যাস তাপ ও চাপের দ্বারা সম্পূর্ণরূপে আয়নিত হয়। সূর্যের প্লাজমার আচরণের জন্য শুধুমাত্র তাপ ও চাপ দায়ী নয়। নাক্ষত্রিক প্লাজমার ভৌত গঠন খুবই জটিল। বিকিরণ, চাপ, মাধ্যাকর্ষণ, বৈদ্যুতিক চার্জ এবং চুম্বকত্ব ইত্যাদি সূর্যের তথা নক্ষত্রের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণে সূক্ষ্ম ও বিরাট ভুমিকা রাখে।

আজ তাহলে এ পর্যন্তই, আবার ফিরে আসবো নতুন কোন টপিক নিয়ে।

তথ্য সুত্রঃ Plasma-Universe, Quanta Magazin, PHYS ORG

কী হতো যদি সূর্য পৃথিবী থেকে আকারে ছোটো হতো?

Comments are closed.