বর্তমান সময় ভেদ করে আমরা এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলছি। কোভিড- ১৯ মহামারীতে বিপর্যস্ত পুরো বিশ্ব। এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখের বেশি মারা গেছে এবং এই সংখ্যা কততে গিয়ে থামবে আমাদের ধারণা নেই। প্রতিদিন বাড়ছে এবং রেকর্ড করছে আক্রান্তের সংখ্যা। জীবন আটকে আছে এক হুমকির নিগড়ে। ঠিক এই সময় বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানালেন ভবিষ্যতে হয়ত আসতে যাচ্ছে আরো একটি মহামারী যা কোভিড-১৯ থেকেও ভয়াবহ হতে পারে! কেউ কখনোই এরকম সংবাদ আশা করতে চাইবেনা। আমার উদ্দেশ্য নয় এই লিখাটির দ্বারা আপনাদের মনে ভীতি ঢুকিয়ে দেয়া, কিন্তু আমাদের জানা উচিত আসন্ন সবরকম বিপদ সম্পর্কে এবং কাজে লাগানো উচিত বর্তমান মহামারীর শিক্ষা গুলো।
সম্প্রতি একটি গবেষণা দেখায় যে ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসকে আমরা যত হালকাভাবে নিই সেটি অনেক বেশি শক্তিশালী। দেখা যায় চীনে এমন একটি সোয়াইন ফ্লু ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে যার মধ্যে মহামারী ঘটানোর মতো শক্তি রয়েছে! খুব ভয়ংকর শোনাচ্ছে তাই তো? তাহলে আমাদের কতটুকু সচেতন হতে হবে? প্রতিবছর আমরা দেখি মিলিওনের বেশি ফ্লু কেইস যেখানে মারা যায় প্রায় হাজারের মতো মানুষ। এগুলোকে বলা হয়ে থাকে সিজনাল ফ্লু বা টাইপ ‘বি’ ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস। অন্যান্য প্রজাতির ফ্লু ভাইরাসও আছে যেগুল পশুপাখি দ্বারা সংক্রমিত হয়, এরা টাইপ ‘এ’ ভাইরাস নামে পরিচিত। এগুলোর বেশিরভাগই মানবদেহে খুব কম প্রভাব ফেলে। কিন্তু টাইপ ‘এ’ ভাইরাস গুলো সিজনাল ফ্লু থেকে আলাদা। মানবদেহে এই টাইপের ভাইরাসের জন্য ইমিউনতন্ত্র মোটেও সুগঠিত নয়। বলা যায় যে টাইপ ‘এ’ ভাইরাস অতি সহজেই সার্স- কোভ-২ এর মতো মহামারী ঘটিয়ে দিতে সক্ষম। ১৯১৮ সালে সংঘটিত হওয়া স্পেনিশ ফ্লু এর কারণে মারা যায় ৫০ মিলিওন মানুষ, শুধুমাত্র একটা ফ্লু ছিল! এই কারণেই ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস নিয়ে বিশ্বের বড় বড় স্বাস্থ্য সংস্থা এবং সরকার খুবই চিন্তিত।

ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস সাধারণত মানুষের শ্বসনতন্ত্রে সংক্রমণ ঘটায় কিছু নির্দিষ্ট কোষকে আক্রমণের মাধ্যমে। পশুপাখি এবং মানুষে এই সেল রিসেপ্টর কোষ খুবই আলাদা। মানুষে খুব দুর্বল্ভাবে ভাইরাসটি আক্রমণ করে। কিন্তু এই ফ্লু তখনই খুব শক্তিশালী হয়ে পড়বে যখন দুটি ভিন্ন ভাইরাস একই কোষকে আক্রমণ করতে যাবে। তারা নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন জিনগত বৈশিষ্ট্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে লাভ করে নতুন বৈশিষ্ট্য যা হয় খুবই শক্তিশালী। নোভেল ফ্লু ভাইরাস গুলো এভাবেই গঠিত হয়ে থাকে নিজেদের জিনগত বস্তু আদানপ্রদানের মাধ্যমে। এই অনুষঙ্গী ভাইরাস যখন পশু পাখির মাধ্যমে মানবদেহে ছড়ায় তা হয় খুবই ভয়ংকর এবং শূকরের মাধ্যমে জিনিসটা কত সহজে ঘটতে পারে তা গবেষণায় দেখিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। শূকরের শাসনালীতে দুই ধরনের রিসিপ্টর সেল রয়েছে যেখানে অতি সহজেই একাধিক ভাইরাস আক্রমণ করে উপরে বর্ণিত ঘটনার জন্ম দিতে পারে। উল্লিখিত গবেষণা পত্রটি এটাই দেখায় যে চীনে প্রাপ্ত সেই সোয়াইন ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের জিনোমে সেই বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা দ্বারা ঘটে যেতে পারে একটি মহামারী!

২০১১ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত চীনে শূকরদের দেহ থেকে ৬ টি ভিন্ন ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস আলাদা করা হয়। ২০১১ সালে প্রাপ্ত ভাইরাসটি ছিল ২০০৯ এর সোয়াইন ফ্লু (H1N1) ভাইরাসের ভ্যারিয়েন্ট। ধীরে ধীরে নতুন ভাইরাস গুলো পূর্ববর্তী ভাইরাসের সাথে মিলে অনুষঙ্গী গঠন করতে থাকে এবং ২০১৩ সালে G4 টাইপ ভাইরাস ধরা পড়ে যা ছিল অন্য সবগুলোর চেয়ে আলাদা। ২০১৮ সালে শেষ পরীক্ষায় দেখা যায় এটিই সবচেয়ে শক্তিশালী অনুষঙ্গী ভাইরাস! শূকরদের বিভিন্ন ফুসফুসীয় সমস্যা ও শ্বাসকষ্ট দেখা দেয় এবং বুঝা যায় যে চীনে G4 ভাইরাস অন্য সব সোয়াইন ফ্লু ভাইরাসকে প্রতিস্থাপিত করে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। এই শক্তিশালী G4 ভাইরাস সমগ্র চীনেই সোয়াইন ফ্লু হিসেবে আবর্তন করছে!
ইউরোপিয়ান Polecat দের শ্বসনতন্ত্রের সেল রিসিপ্টর মানুষের শ্বসনের ন্যায় হওয়ায় G4 এর প্রভাব গবেষণা করতে সুবিধা হচ্ছে বিজ্ঞানীদের। গবেষণা দেখায় যে ভাইরাসটির প্রভাব মেছো বিড়ালের উপর অন্য সোয়াইন ফ্লু ভাইরাসের চেয়ে বেশি আঘাত হেনেছে। সংস্পর্শ এবং বাতাস দুভাবেই এটি ছড়াতে পারে। আমরা ধারণা পাই যে মানুষের জন্য এটি কতটা মারাত্মক হতে পারে! বিজ্ঞানীরা তারপর গবেষণা করেন মানুষের এন্টিবডি ভাইরাসটিকে কতটুকু প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়। তারা দেখেন পূর্ববর্তী কোনো ফ্লু ভাইরাসের সাথে এই টাইপ মিলে যায় কীনা, দূর্ভাগ্যবশত পরীক্ষার ফলাফল আসে হতাশাজনক। মানব প্রজাতির ইমিউনতন্ত্রের নিকট এই ভাইরাসটি একেবারেই নতুন এবং আমাদের নিজস্ব কোনো প্রতিরোধ ব্যবস্থাই নেই এর বিরুদ্ধে মোকাবেলার।

এতকিছুর পর প্রশ্ন আসে আমাদের কতটুকু চিন্তিত হওয়া উচিত। যেসব মানুষরা সোয়াইন ফার্ম বা শূকরের খামারে কাজ করেন এবং সেগুলোর সাথে নিত্য সংস্পর্শে আসেন তাদের রক্ত নমুনা হিসেবে নেয়া হয় পরীক্ষার জন্য। এখানে পরীক্ষা করা হয় এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে কত শতাংশ মানুষের এন্টিবডি রয়েছে সেটা দেখার জন্য। মাত্র ১০ শতাংশ খামারের কর্মী এবং ৪ শতাংশ জনগণের রয়েছে এই এন্টিবডি যা মোকাবেলা করতে পারবে ভাইরাসকে! ধীরে ধীরে মানুষকে আক্রান্ত করছে ভাইরাসটি এবং ক্রমেই আরও শক্তিশালী হচ্ছে জিনের বৈশিষ্ট্য বদলের মাধ্যমে যা আমাদের গভীরভাবে এখন ভাবতে বাধ্য করছে।
স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে G4 সোয়াইন ফ্লু ভাইরাসের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ শক্তি রয়েছে মহামারী ঘটানোর। যদিও এটি এখনও খুব ধীরে ধীরে ছড়াচ্ছে , কিন্তু আমরা যদি বিষয়টিকে পাত্তা না দিই তাহলে তা ভয়াবহ রূপ নিতে বেশি সময় নিবেনা। আগেই বলা হয়েছে যে ভাইরাসটির অনুষঙ্গী গঠনের শক্তি প্রবল এবং ডিএনএতে খুব ক্ষুদ্র প্রতিলিপনের মাধ্যমেই যেকোনো পরিবেশ এবং প্রাণির দেহে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। সার্স, মার্স, সোয়াইন ফ্লু এবং সর্বশেষ কোভিড- ১৯ আমাদের বিশাল শিক্ষা দিয়েছে, চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে সামান্য ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস কতটা ক্ষমতাধর হতে পারে। এই মহামারী কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আসেনা। মহামারী একদিনে হয়না। যদি আমরা গবেষণা, উপযুক্ত সতর্কতা উপেক্ষা করি তবে এগুলো বিভিন্ন রূপে বারবার এসে মানবজাতিকে জর্জরিত করতে থাকবে।
সূত্রঃ science alert, forbes