আলোর চেয়েও দ্রুত

পদার্থবিজ্ঞানে আলোর দ্রুতি অত্যন্ত মজার একটি বিষয়। গুরুত্বপূর্ণও বটে। আলোর দ্রুতি বলতে আমরা বুঝে থাকি আলো কোন মাধ্যম দিয়ে যাওয়ার সময় যে দ্রুতিতে যায়, তার মান। অনেকেই আলোর দ্রুতির সাথে কয়েকটা জিনিসের গোলমাল পাকিয়ে ফেলে। যেমন- মনে রাখতে হবে যে, আলোর দ্রুতি ও আলোর বেগ কখনোই এক বিষয় নয়। বেগের কথা এলেই দিকের কথা আসবে আর বেগ না বলে দ্রুতি বললে কোন দিকের কথা আসবে না। উদাহরণস্বরূপ কারো বেগ উত্তর দিকে প্রতি সেকেন্ডে ৫ মিটার হতে পারে। উত্তর দিক না বলে শুধু প্রতি সেকেন্ডে ৫ মিটার বললে সেটা তার দ্রুতি। হবে আবার অনেকে আলোর দ্রুতিকে ধ্রুবক মনে করে। এখানেও একটা বড় ত্রুটি রয়ে গেছে।

এক অর্থে আলোর দ্রুতি কোন ধ্রুবক বা পরম জিনিস নয়। মাধ্যমভেদে আলোর দ্রুতির পরিবর্তন হতে পারে। যেমন বাতাসের মধ্যে দিয়ে আলোর দ্রুতি যত, পানির মধ্য দিয়ে আলোর দ্রুতি তার থেকে অনেক কম। আবার শূন্যস্থান তথা যেখানে সাধারণত কোন কিছুই নেই সেখানে আলোর দ্রুতি সর্বাধিক। তবে হ্যাঁ একটি নির্দিষ্ট সুষম মাধ্যমে আলোর দ্রুতি সর্বদা একই থাকবে অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট মাধ্যমে আলোর দ্রুতি ধ্রুবক। এক মাধ্যমে আলোর দ্রুতি যা, মহাবিশ্বের যেকোনো স্থানে সেই মাধ্যমে আলোর দ্রুতি ততই থাকে। যেকোনো পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষেই। চাই কি পর্যবেক্ষক স্থির হোন বা গতিশীল। এজন্যে মূলত “আলোর দ্রুতি ধ্রুবক” না বলে বলা উচিত শূন্য মাধ্যমে আলোর দ্রুতি ধ্রুব।

আপনার বাসায় বৈদ্যুতিক বাল্ব থেকে পড়ার টেবিলে আলো যে দ্রুতিতে আসবে আপনার বন্ধুর বাসায় আলো একই দ্রুতিতে চলাচল করবে। কেননা যেহেতু উভয় ক্ষেত্রেই মাধ্যম হলো বাতাস। তবে খেয়াল রাখতে হবে যে আপনার আর আপনার বন্ধুর বাসার বাতাস একই রকম হতে হবে। কারো বাতাস বেশি ঘনত্বের আর কারো বাতাস কম ঘনত্বের হলে চলবে না। তেমনি ভাবে পর্দা কিংবা মেঘনা নদী, সব নদীর পানিতে আলোর দ্রুতি একই।

আগেই বলেছি শূন্য মাধ্যমে আলোর দ্রুতি সর্বাধিক। এই মাধ্যমে প্রতি সেকেন্ডে ২৯৯৭৯২৪৫৮ মিটার দূরত্ব অতিক্রম করে। এমন কোন মাধ্যম নেই যেখানে শূন্যস্থান এর চাইতেও বেশি দ্রুতিতে আলো চলতে পারে। মহা বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন তার বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে মেনে নিলেন যে আলোর বেগ এর উপর আপেক্ষিক বেগ এর কোনো প্রভাব নেই। শূন্য মাধ্যমের সকল কাঠামোতেই আলোর ধ্রুবক একি। আর এই স্বীকার্যের ভিত্তিতে তৈরি আপেক্ষিকতা তত্ত্ব থেকে বেরিয়ে এলো আর একটি কথা। আলোর দ্রুতই হোল এই মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ দ্রুতি। এর চেয়ে বেশি দ্রুতি অর্জন করতে চাইলে তত্ত্বের মাঝে অসীম পরিমাণ গতিশক্তি কাল্পনিক ভর ইত্যাদি অস্বাভাবিক রাশির আগমন ঘটে। তাই এটা মেনে নেয়া হয়েছে আলোর দ্রুতি হলো মহাবিশ্বের সর্বজনীন দ্রুতি সীমা।

এবার চলুন দেখা যাক এই আলোর দ্রুতি সীমা লঙ্ঘন করতে পারে এমন কিছুর অস্তিত্ব আছে কিনা।

সত্তরের দশকে ২ জন বিজ্ঞানী দেখান যে, এমন কিছু জিনিস এর অস্তিত্ব থাকতে পারে যাদের দ্রুতি সর্বদাই আলোর চেয়ে বেশি। এদের বলে ট্যাকিওন। মজার ব্যাপার হলো এই ধরনের কিছুর অস্তিত্ব আধুনিক বিজ্ঞান অস্বীকার করে না। সকল নিয়ম নীতির ভেতরে থেকে আলোর চেয়েও বেশি দ্রুত সম্পন্ন কণাদের কথা কল্পনা করা যায়। ট্যাকিওন এর অস্তিত্ব দেখাতে শুধু স্থান-কালের জ্যামিতিতে একটু খেলা করা হয় এই যা। তবে ট্যাকিওনকে এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। পাওয়া যাবে কিভাবে? যে কণা আলোর চেয়ে দ্রুত চলে তাকে তো আর দেখতে পারার কথা না। তাহলে বিজ্ঞানীরা কিভাবে খুঁজবেন ট্যাকিওনকে? আসলে কোন কণা ট্যাকিওন ধর্ম দেখালে তার গতিপথ এর উল্টো দিকে একটা তরঙ্গ তৈরি হয়। এই তরঙ্গ দেখেই ট্যাকিওন শনাক্ত করার কাজ চলছে। তবে শূন্যস্থানে আলোর দ্রুতি দ্রুতি সম্পন্ন না পাওয়া গেলেও অন্য মাধ্যমে পাওয়া গেছে।

যেমন পানিতে আলোর দ্রুতি শূন্যস্থানে আলোর দ্রুতির প্রায় ৭৫%। কিন্তু একটা ইলেকট্রনকে প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে শূন্যস্থানে আলোর দ্রুতির ৯৯% দ্রুতি সম্পন্ন করা যায়। সেই ইলেকট্রনটিকে যদি পানিতে রাখা যায় তবে কি হবে? পানিতে আলোর দ্রুতির চেয়ে ইলেকট্রনের দ্রুতি বেশি হয়ে যাবে। তখন পানি থেকে নীলাভ একটি বিকিরণ তৈরি হবে, যাকে আমরা বলি চেরেনকভ বিকিরণ। পারমাণবিক চুল্লি বা ওই ধরণের নিউক্লিয় গবেষণাগারে চেরেনকভ বিকিরণ খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করা যায়।

ট্যাকিওন কণারা কি তাহলে শুধুই কাল্পনিক?

না এরা পুরোপুরি কাল্পনিক নয়। হিগস-বোসন কণা যেমন ২০১২ সাল পর্যন্ত কাল্পনিক ছিল তারপর পর্যবেক্ষণ করা গেছে তেমনি বিজ্ঞানীদের দাবি এক্স-প্ল্যানেট তথা বাইরের গ্রহগুলোতে ট্যাকিওন পর্যবেক্ষণের সম্ভাবনা আছে। পৃথিবীতে চেরেনকভ বিকিরণ দেখা গেলেও ট্যাকিওনইক কোন কণার সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। এটা তৈরি করা খুবই সহজ। কোন চার্জপ্রাপ্ত কণাকে তরক যন্ত্রে নিয়ে আলোর অনেক কাছাকাছি দ্রুতি দেয়া সম্ভব হয়। আগেও বলেছি, মাধ্যম পরিবর্তন করলে তথা পানি বা কাঁচ মাধ্যমে আলোর দ্রুতিও কমে যায়। এ কারণে ওই মাধ্যমে চার্জিত কণা মাধ্যমের আলোর দ্রুতির থেকেও বেশি দ্রুত গতিতে চলাচল করতে পারে। তখন কণাটির রেখে যাওয়া পদ চিহ্ন হিসেবে নীল তরঙ্গ দেখা যায়। এ ঘটনাকে বলে চেরেনকভ বিকিরণ। এক সময় মনে করা হতো নিউট্রিনো ও টাউ কণা বোধ হয় ট্যাকিওন শ্রেণীর কণা। পরে তা ভুল প্রমাণিত হয়। এই ধরনের কণা আবিষ্কার করা সম্ভব হলে পৃথিবীর জীবনমানের তিনি একদিনেই শতভাগ বেড়ে যাবে বলে মত দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তবে যেহেতু কণাটি আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের মত প্রতিষ্ঠিত একটি তত্ত্বকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়, তাই অনেক বিজ্ঞানী একে নিছক উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা বলে উড়িয়ে দেন। তবে ট্যাকিওন কণা কি নিছক কল্পনা নাকি এক উন্নত মানের বিজ্ঞান, তা জানার জন্য আমাদেরকে আরো অনেক বছর অপেক্ষা করা লাগতে পারে।

Comments are closed.