দখিনা হাওয়ার বয়ে যাওয়া,সকালের হালকা হালকা কুয়াশা জানিয়ে দিচ্ছে শীতের আগমন বার্তা। শীত আসি আসি করে চলেই এলো বলে! শীতে পাতা ঝরে পড়ে গাছপালা যেমন রুক্ষ নিষ্প্রাণ হয়ে যায় তেমনি এই আবহাওয়ায় মানুষের স্কিনও শুষ্ক, রুক্ষ, নিষ্প্রাণ হয়ে যায়। এ সময় দরকার চুল ও ত্বকের বিশেষ যত্ন সেই খাবারের তালিকায়ও কিছুটা বৈচিত্র্য আনাও একান্ত দরকার। চলুন তাহলে আজকে জেনে নেয়া যাক কিভাবে শীতের প্রকোপ থেকে স্কিন ও হেয়ারকে প্রটেক্ট করা যায়।
স্কিন মূলত ৪ প্রকার:
- নরমাল স্কিন : এই টাইপ স্কিনে সব কিছু অতি সহজেই স্যুট করে যায়। তাই এদেরকে নিজের স্কিনের যত্নের ব্যাপারে খুব একটা বিড়ম্বনা পোহাতে হয় না।
- ড্রাই স্কিন : এই টাইপ স্কিনে পর্যাপ্ত পানি আর স্কিনের ন্যাচারাল ওয়েলের অভাব থাক। সারাবছর স্কিন শুষ্ক থাকে, এমনকি চামড়া উঠে। র্যাশ হয়।
- অয়েলি স্কিন : এই টাইপের স্কিনের মানুষগুলো ঘুম থেকে উঠে আয়নার সামনে দাঁড়ালে মনে হবে তেলের সাগর থেকে ডুব দিয়ে উঠেছে।
- কম্বিনেশন স্কিন : এদের T জোন অয়েল থাকে অর্থাৎ কপাল থেকে নাক হয়ে থুতনি পর্যন্ত ওয়েলি থাকে। মানে ওয়েলি এরিয়া T শেপ হয়ে থাকে। সবচেয়ে বেশি বিড়ম্বনা পোহাতে হয় এই স্কিনের মানুষদের।কখন কি ইউজ করবে, এই জিনিস কিছু দিন স্যুট করলে আবার পরে স্যুট করতে চায় না।
কিন্তু শীত এমন একটা সিজন এই সময়ে ৮ থেকে ৮০ সব বয়সের সব টাইপের স্কিনের মানুষদেরই স্কিন ড্রাই থাকে।
ত্বকের যত্ন :
১.ক্লিঞ্জার :
সকালে ঘুম থেকে উঠে ফেসওয়াশ বা ক্লিনজার দিয়ে ফেস ভালোভাবে ক্লিন করে নিতে হবে। কিন্তু ফেসওয়াশ বা ক্লিনজার ইউজ করার আগে দেখে নিতে হবে সেটা আপনার স্কিনের প্রয়োজনীয় ন্যাচারাল ওয়েল বের করে দিচ্ছে না তো! তাহলে আপনার স্কিনের কোন উপকার তো হবেই না উলটো আরও ক্ষতি হবে।
২.টোনার :
ভালো একটা টোনার ইউজ করতে হবে। এর জন্য বাসায় বানানো টোনারই বেস্ট। বাজারের টোনারে কেমিক্যাল ও ক্ষতিকর উপাদান থাকে যা স্কিন নিষ্প্রাণ করে দেয়। টোনার স্কিনটাকে প্রাণবন্ত রাখে।
- এক্ষেত্রে শসার রসের সাথে অ্যালোভেরা জেল ১ চামচ মিশিয়ে একটা স্প্রে বোতলে স্টোর করে ৭-১০ দিন ইউজ করতে পারবে। অ্যালোভেরা জেল অবশ্যই কেনাটা ইউজ করতে হবে।কারণ অনেকেরই অ্যালোভেরা জেলে অ্যালার্জি থাকে।
- গোলাপের পাপড়ি বেশি করে নিয়ে ধুয়ে পরিমাণ মত পানিতে পাপড়িগুলো নিয়ে চুলায় জাল দিতে হবে। পানি রঙ ধারণ করলে চুলা থেকে নামিয়ে ছেকে ঠান্ডা করে স্প্রে বোতল বা নরমাল পরিষ্কার বোতলে স্টোর করা যাবে। ৭-১০ দিন নরমাল টেম্পারেচার এ ভালো থাকবে। এক্ষেত্রে যতটা সম্ভব দেশি গোলাপ ব্যবহার করতে হবে।দেশি গোলাপ আকারে ছোট হয়।
৩.সিরাম :
ক্লিনজার টোনারের পর আসে সিরাম। সিরাম ইউজ করা না করা নিজের ব্যাপার। তবে ইউজ করাটাই বেটার। অ্যালোভেরা জেলের সাথে ৫-৭টা জাফরান মিক্স করে বানিয়ে নিতে পারেন জাফরান সিরাম।
৪.ময়েশ্চরাইজার :
এরপর আসে ময়েশ্চরাইজার। শীতে যেহেতু সবার স্কিনই কম বেশী ড্রাই থাকে তাই ঘরে বানানো কোকোনাট ওয়েল হালকা গরম করে স্কিনে ম্যাসাজ করলে রক্ত চলাচল সচল হয়। স্কিনের ড্রাইনেস দূর হয়ে স্কিন গ্লোয়িং হয়। কিংবা বাজারের ভালো ব্র্যান্ডের অ্যালভেরা জেলও ভালো ময়েশ্চরাইজার হিসেবে কাজ করে।
৫.সানস্ক্রিন :
বাহিরে যাওয়ার আগে অবশ্যই নিজের রেগুলার সানস্ক্রিন লাগাতে হবে। অনেকেই মনে করে উইন্টারে যেহেতু সূর্যের খুব একটা দেখা মিলে না তাই সানস্ক্রিন না লাগালেও হবে। এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। এই টাইমে সূর্যের ক্ষতিকর বেগুনী রশ্মি স্কিনের আরো বেশি ক্ষতি করে। তাই সানস্ক্রিন অবশ্যই ইউজ করতে হবে। ঘর থেকে বের হওয়ার কমপক্ষে ১৫-৩০মিনিট আগে সানস্ক্রিন লাগাতে হবে।
সানস্ক্রিন ব্যবহার করার আগে এর ইনগ্রেডিয়েন্টস গুলো ভালো ভাবে চেক করে নিতে হবে। সবসময় “প্যারাফিন,অ্যালকোহল” ফ্রী সানস্ক্রিন ইউজ করতে হবে। কেননা প্যারফিনের কারণে স্কিন ক্যান্সারও হতে পারে। আর যতটা সম্ভব সুগন্ধিহীন ক্রিম ইউজ করতে হবে।
*অনেকের মনে করেন কেন সানস্ক্রিন ইউজ করা খুব প্রয়োজন?
সানস্ক্রিন স্কিনের উপর একটা প্রটেক্টর হিসেবে কাজ করে। এটা ত্বককে সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি UVA, UVB থেকে প্রটেক্ট করে। স্কিন ক্যান্সার হওয়া থেকে বাঁচায়।
৬.ডেইলি ক্রিম :
এর পর নিজের ডেইলি ক্রিম লাগাতে হবে। এমন একটা ক্রিম ইউজ করতে হবে যা ত্বককে ভিতর থেকে হাইড্রেটেড এবং ময়েশ্চরাইজড রাখবে।
ঘরে ফিরে অবশ্যই ফেস ভালোভাবে ক্লিন করে একটা ভালো মানের ময়েশ্চরাইজার লাগাতে হবে।
হাত-পা ও ফুল বডির যত্ন :
এক্ষেত্রে ভালো লোশন ইউজ করা যেতে পারে। অনেকের ক্ষেত্রে লোশন ইউজ করা সম্ভব হয় না। তারা ভার্জিন কোকোনাট ওয়েল কিংবা ভার্জিন অলিভ ওয়েল ইউজ করতে পারেন। অলিভ ওয়েল স্কিনের জন্য কতটা ভালো তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাছাড়া ৩০% গ্লিসারিনের সাথে ৬০% পানি মিশিয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে। গ্লিসারিন স্কিনকে সফট রাখে।
শীতে পা ফাটা খুবই কমন ব্যাপার। এক্ষেত্রে রাতে ঘুমাতে যাবার আগে লোশন, অয়েল বা গ্লিসারিন যে যেটা ইউজ করেন সেটা লাগিয়ে হাত মোজা পা মোজা পরে ঘুমাতে পারেন। এতে স্কিন খুবই সফট হয় আর ময়েশ্চরাইজড থাকে।
ঠোঁটের যত্ন :
পরিচিত কারো সাথে দেখা করলে আমরা প্রথমেই একটা প্রাণবন্ত হাসি দিয়ে তাকে আপ্যায়ন করি। কিন্তু হাসি দেওয়ার সেই ঠোঁটটাই যদি নিষ্প্রাণ, শুষ্ক, ফাটা হয় তাহলে কেমন লাগে বলুন তো।
শীতে এক টুকরো লেবুতে একটু ব্রাউন শ্যুগার কিংবা নরমাল শ্যুগার লাগিয়ে এতে মধু দিয়ে ঠোঁটে হালকা ঘষে ঠোঁটের মরা কোষগুলো তুলে ফেলতে হবে। এর পর কুসুম গরম পানি দিয়ে ঠোঁট ধুয়ে ভালো একটা লিপ বাম কিংবা ভ্যাসলিন লাগাতে হবে।
বাসায় লিপ বাম বানানোর নিয়ম :
উপকরণসমূহ :
i. ১/৪ কাপ ওয়েল ( কোকোনাট বা সুইট আলমন্ড ওয়েল কিংবা গ্রেপসীড)
ii. ১/৪কাপ বাটার (শিআ বা ম্যাঙ্গো কিংবা কোকোয়া বাটার)
iii. পরিমাণ মত বিস ওয়াক্স [বিস ওয়াক্স হচ্ছে মৌমাছির মোম]
iv. এসেনশিয়াল ওয়েল ঘ্রাণের জন্য(অপশনাল)
উপকরণগুলো ভালোভাবে মিক্স করে বানিয়ে ফেলা যাবে লিম বাম। ন্যাচারাল উপাদান বলে স্কিনের ক্ষতি হওয়ার সম্ভবনা নেই।
*লিপবাম বানানোর উপকরণগুলো যেকোন সুপারশপ কিংবা অনলাইনেও কিনতে পাওয়া যাবে।
চুলের যত্ন :
উইন্টারে সপ্তাহে কমপক্ষে ৩দিন শ্যাম্পু করা উচিত। কারণ এই সময় অন্যান্য সিজনের তুলনায় চুল আরও বেশি রাফ হয়ে যায় আর চুল ভেঙে পড়ে। শীতে চুলে প্রচুর খুশকি হয়। তাই সম্ভব হলে জিঞ্জার(আদা) শ্যাম্পু ব্যবহার করতে পারেন। আর শ্যাম্পুর সাথে চিনি মিক্স করে চুলে হালকা ঘষে লাগাতে হবে। শ্যাম্পুর সাথে চিনি মিক্স করে লাগালে খুশকি দূর হয়। জিঞ্জার অ্যান্টি হেয়ারফল হিসেবে কাজ করে।
*ঘর থেকে বের হওয়ার আগে চুল কভার করে বের হওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস :
- আমাদের অনেকেরই ঘরে কোন প্রোডাক্ট বানিয়ে ইউজ করতে আলসেমি লাগে। তাই বাজার থেকে রেডিমেড জিনিস এনে ইউজ করি। কিন্তু বর্তমান বাজারে এতো এতো ভেজালের মধ্যে আসল জিনিস খুঁজে বের করা কঠিন। তাই কোনো জিনিস কেনার আগে অবশ্যই জিনিসটার বারকোড স্ক্যান করে প্রডাক্টটা নেটে সার্চ করে দেখতে হবে।
- শীতে পানির পিপাসা কম লাগে তাই পানি কম পান করা হয়। যার হলে স্কিন,চুল নিষ্প্রাণ হয়ে যায়। বেশি বেশি পানি পান করতে হবে।
- বাহির থেকে আসার পর আলসেমির কারণে ত্বকের যত্ন নেওয়া হয় না। এমনটা করা যাবে না। রাতে ঘুমাবার আগে অবশ্যই একটা ভালো ময়েশ্চরাইজার ইউজ করতে হবে।
- যেহেতু শীতে ত্বক শুষ্ক থাকে তাই মেয়েরা ফেসপ্যাক এ কোকানাট ওয়েল বা সুইট আলমন্ড ওয়েল কিংবা গ্লিসারিন অ্যাড করতে পারেন।এতে ত্বক হাইড্রেটেড থাকবে।
- ব্যাগে অবশ্যই একটা পকেট ভ্যাসলি রাখার চেষ্টা করতে হবে।
- সিজনাল ভেজিটেবল, ফ্রুট খেতে হবে।
- গাজরের জুস(রস) স্কিন, চুল ভালো রাখে। ক্যান্সারের প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে।
তথ্যসুত্রঃ www.healthline.com www.health.clevilandclinic.org www.buymeonce.com