আমাদের পৃথিবী আমাদের ধারণার চেয়েও অনেক ভিন্ন। সাধারন মানুষের নিকট যেমন টা মনে হবে তা একজন বৈজ্ঞানিক বা বিজ্ঞানের সাথে জড়িত যে কোনো ব্যক্তির কাছে ভিন্ন হওয়া স্বাভাবিক। আমাদের চিন্তার জগৎ হয়ত একটা পর্যায়ে সীমিত হয়ে যায়। কিন্তু পৃথিবীর জ্ঞান গর্ভ অসীম। এর রহস্য ভেদে আমরা আজও অপারগ। এই বিশাল জ্ঞান আহরণ করা আমাদের পক্ষে হয়ত কোনো এক সময়ে সম্ভব হবে।
আমাদের জানা মতে বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত জীব মানুষ, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তারপর কে? ছোট থাকতে আমরা অনেকেই পড়েছিলাম যে পৃথিবীর ২য় বুদ্ধিমান জীব ডলফিন। তাহলে কি ডলফিন ২য় উন্নত পর্যায়ে পড়ে? নাকি তাদের মধ্যেও কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে? তারা কথা বলতে পারে, খেলতে পারে, এমনকি নাচতেও পারে যা হয়ত অনেক সময়ই আমাদের দৃষ্টি গোচর হয় নি। তাহলে আজকে চেষ্টা করবো এই সুন্দর জীব সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরতে।

ডলফিন
ডলফিন হচ্ছে “ম্যামালিয়া” শ্রেণীর, “সিটাসিয়ান” বর্গের প্রাণী। এই প্রাণীর নাম এসেছে গ্রীক শব্দ “উম্ব” থেকে। যার অর্থ “গর্ভ”। সিটাসিয়ান বর্গের প্রাণীরা তাদের শাবক কে গর্ভে ধারন করে। এই দিক দিয়ে ডলফিনের সাথে আরেকটি নাম চলে আসে তিমি।
কোনো একটা সময় ছিল যখন এদের মাছ মনে করা হতো। যদিও পরবর্তিতে জানা যায় তারাও মানুষের মতো মাতৃগর্ভে জীবন ধারন করতে পারে। এখন আপনি যদি মাছ সম্পর্কে জেনে থাকলে তাদের সাথে এদের তুলনা করে দেখতে পারেন কথাগুলোর যৌক্তিকতা কতটুকু।
এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠারই কথা যে, তিমি আর ডলফিন কি এক? সত্যি বলতে তারা এক না আবার তাদের মধ্যে অনেক মিলও পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে প্রধান অমিল হচ্ছে তাদের আকার। প্রাপ্ত বয়সে একটি ডলফিনের সর্বোচ্চ আকার হতে পারে ৩১ ফিট (ওরকা ডলফিন) আর যেখানে একটি তিমির সাধারণ আকার হয়ে থাকে ৮৮ ফিট (নীল তিমি)(তথ্যসূত্রঃ Encyclopedia of marine mammals, 2009)। তাদের চোয়ালের ধরন, দাত, চোখ সব কিছু ঠিকভাবে পর্যবেক্ষনে বুঝা যাবে আসলে তাদের মধ্যে অনেক অমিল রয়েছে। কিন্তু লেজ, শরীরে উপরিভাগের গঠন, তাদের ফ্লিপারগুলো (যা দিয়ে সাতার কাটে) অনেকটাই এক। বলা যেতে পারে ডলফিনরা হয়ত তিমির দূর সম্পর্কের ভাই।
ডলফিনের বিবর্তন

পৃথিবীতে সকল কিছুই কোনো না কোনো বিবর্তনের ধারায় ভেসে এসেছে। ডলফিনের ক্ষেত্রেও প্রায় একি ঘটনা ঘটে ছিল। আসি কিছু বিজ্ঞানীদের বিশ্লেষণে। কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন যে ডলফিনদের বর্তমান সময় পর্যন্ত আসার সময়ের যে পরিবর্তন ঘটেছিল আজ থেকে প্রায় ৪৫ মিলিয়ন বছর পূর্বে ঘটে। তাদের মতে ডলফিনরা ছিল “প্রোটোসিটাড” গোত্রের উত্তরসূরি। এই প্রাণীগুলোর বিভিন্ন পরিবর্তনের ধারায় আজকের ডলফিনের আবির্ভাব।
আবার বিজ্ঞানীদের এটাও বিশ্বাস যে ডলফিনদের আদি বসবাস ছিল ভূমির উপর। তাদের আদি বংশের প্রানীগুলো এক সময় ভূমির উপর বিচরণ করে সমুদ্রের পাড় থেকে খাবার সংগ্রহ করতো। এখানে আবার আসা যায় ডারউইন এর প্রাণীর বিবর্তনের মতবাদে তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে জীব জগতে যে সকল প্রাণী অবস্থা করছে তারা কোনো না কোনো ভাবে বিবর্তনের সম্মুখ হয়েছিল। ডলফিনদের ক্ষেত্রেও এমন কিছু ঘটতেই পারে।

কিছু কিছু লক্ষন প্রমাণ করে যে ডলফিনের আদি উৎস হচ্ছে স্থল। কয়েকটা উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা পরিষ্কার করা যাক। প্রথম, ডলফিন ফুসফুসের সাহায্যে শ্বাস-প্রশ্বাস পরিচালনা করে। যার জন্য তাদের কে উপরে, পানির উপরিভাগে উঠে আসতে হয়। দ্বিতীয়, স্থলভাগের প্রাণিদের বিভিন্ন অঙ্গের/হাড়ের সাথে তাদের হাড়ের অনেক সাদৃশ্য পাওয়া গিয়েছে। তৃতীয়, ডলফিনদের মেরুদণ্ড তাদের চলাচলের সময় উলম্বভাবে অবস্থান করে যা স্থলভাগের প্রানীদের সাথে মিলে যায়। যা মাছের ক্ষেত্রে অনুভূমিকভাবে অবস্থা করে।
সময়ের সাথে সাথে তাদের খুলির আকার আকৃতিরও পরিবর্তন ঘটেছে। তাদের চোয়ালের নিচে অবস্থিত “ফ্যাট প্যাড” ‘র বিকাশ এই পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। এটি তাদের মধ্য কর্ণ পর্যন্ত প্রসারিত। এটি তারা ইকোলোকেশন এবং ভালোভাবে শুনতে ব্যবহার করে থাকে।
আরেকটি আশ্চার্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, তারা তাদের খাদ্যাবাস পরিবর্তন করেনি। তারা তখনো মাংসাশি ছিল, আজও আছে।
এমনকি তাদের (ডলফিন) শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রক্রিয়ায় অনেক পরিবর্তন পরিলক্ষিত। স্থলভাগের প্রানীদের যে নাসা-রন্ধ্র রয়েছে তার পরিবর্তে তাদের শরীরের উপরিভাগের দিকে “ব্লোহোল” তৈরি হয়েছে যা তাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজ করে থাকে। এতে করে তাদের শরীরের অনেকটা শক্তি বেচে যায় বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। এর জন্য তাদেরকে পানির উপরিভাগে আসতে হয়। এই প্রক্রিয়া নিয়ে পরবর্তীতে আলোচনা করবো। এছাড়াও তাদের পিছনের দিকে যে দুইটি ছোট পেলভিক হাড় দেখা যায় তাও রূপান্তরিত হয়ে এসেছে। [ তথ্যসূত্রঃ (Dolphin evolution history:Dolphins-world, 2016),( The Ancestor’s Tale: A Pilgrimage to the Dawn of Evolution, Sept 6, 2016)]
এখন তাদের বিবর্তনের যে ধারার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হলোঃ

১। প্যাকিসিটাসঃ এই প্রাণীগুলো এখন থেকে প্রায় ৫০ মিলিয়ন বছর পূর্বে বেচে ছিলো। তারা বিভিন্ন নদী-নদীর মোহনার আশেপাশে বিচরণ করতো। খাদ্যের জন্য তারা ঐসব এলাকা বেশি পছন্দ করতো। তাদের আদি নিবাস মধ্য-প্রাচ্য।

তাদের ফসিলের ডিএনএ থেকে তিমি এবং ডলফিনের ডিএনএ ‘র মিল পাওয়া যায়।
২। এম্বুলোসিটাসঃ এই প্রানীগুলো প্রায় আজ থেকে ৪৮ মিলিয়ন বছর পূর্বে বেচে ছিল। তারা প্যাকিসিটাস থেকে আরো অনেক ভালো সাঁতারু ছিল কারণ তাদের পায়ের আঙ্গুলগুলো পাতলা চামড়া ধারা একে অন্যের সাথে লেগে থাকে যেমনটা হাঁস অথবা ডুবুরিদের পায়ের স্ল্যাবটা থাকে। তাদের পা অপেক্ষাকিত ছোট হয়ে যায় এবং তাদের মেরুদন্ডের কিছুটা পরিবর্তন ঘটে, এতে তারা পানিতে তাদের শরীরকে মানিয়ে নিতে পারে। তাদের নিম্ন চোয়াল এবং কানের পরিবর্তন ঘটে যা তাদের পানির নিচে শুনতে সাহায্য করতো।

৩। প্রোটোসিটিডঃ এই প্রানীগুলো আজ থেকে প্রায় ৪৫ মিলিয়ন বছর পূর্বে এই পৃথিবীতে ছিল। এই প্রানীগুলো পানিতে নিজেদের খুব ভালোভাবে মানিয়ে নিতে সক্ষম হয়। তারা তাদের প্রজনন এবং শাবক কে লালন পালনের জন্য সৈকতের আশেপাশে আসতে হতো বলে বিজ্ঞানীদের মতামত। এদের মধ্যে অনেক পরিবর্তন আসে। তাদের শরীরের চুল বিলুপ্ত হয়, পানির নিচে শোনার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। চোখ এবং বৃক্ক লবণ সহনীয় হয়ে উঠে। বায়ু প্রবেশের জায়গা গুলো পানির প্রবেশ রোধের জন্য তৈরি হয়ে উঠে। নাসা-রন্ধ্র (ব্লোহোল) মাথার পিছন দিকে চলে আসে যা পূর্বে অনেক সরু ছিলো।

৪। ডোরুডোন্টিডঃ এই প্রাণীগুলো প্রায় ৪০ মিলিয়ন বছর পূর্বে ছিল। ডোরুডোনটিডস কেবলমাত্র ফ্লুকই ছিল না তবে তাদের ছোট ছোট পেলভিক হাড়গুলি মেরুদণ্ডের সাথে সংযুক্ত ছিল এবং তাদের ছোট ছোট পায়ের অঙ্গগুলি দিয়ে কোনও সাঁতার কাটতে পারতো না। এগুলো ছোট পাখনা হিসেবেও আসতে পারে।

৫। স্কোয়ালোডন্টিডঃ এই প্রানীগুলোকে বর্তমান দাঁতযুক্ত তিমির প্রায় মিলানো সম্ভব। তাদের মাথার খুলির আকার-আকৃতি আমাদের জানায় যে তারা নিজের সামনের দিকে শব্দটি সরাসরি পরিচালনা করতে সক্ষম হয়েছিল যেটা ইকোলোকেশনের জন্য পূর্বশর্ত। পানির নিচে শ্রবণের পাসাপাশি তারা তাদের খাদ্য খোজার জন্য এর ব্যবহার বুঝতে পারে। এছাড়াও নিজেদের অবস্থান বুঝতে এবং শিকারিদের হাত থেকে বাঁচতে তারা শব্দের প্রতিধ্বনি ব্যবহার আয়ত্ব করে।

৬। কেন্ট্রিওডন্টিডঃ বিজ্ঞানীদের মতে, কেন্ট্রিওডন্টিড এর সদস্যদের সাথে বর্তমানের ডলফিনের প্রায় পুরোপুরি মিলে যায়। এদের আবির্ভাব ঘটে আজ থেকে ১৫ মিলিয়ন বছর পূর্বে। অতঃপর এদের থেকেই উন্নত প্রজাতির ডলফিনদের আবির্ভাব হয়েছে বলে ধারণা করা হয়ে থাকে (৫ মিলিয়ন বছর পূর্বে)। (তথ্যসূত্রঃ ডলফিন একাডেমী, বিবর্তন)
এই পর্বে শুধুমাত্র তার বিবর্তন নিয়ে কিছু তথ্য উল্লেখ করা হলো। এছাড়া তাদের চলাচল, সামাজিকতা, খাদ্য অভ্যাস, প্রজনন, মানুষের সাথে সম্পর্ক ইত্যাদি নিয়ে পরবর্তি পর্বে আসছে শীঘ্রই, ইনশাআল্লাহ।
চলবে ……………
One Comment
ডলফিন কথন-(পর্ব-০২) | বিজ্ঞানবর্তিকা
[…] ডলফিন কথন-(পর্ব-০১) […]