রাতের আকাশে তাকালেই আমরা শত-সহস্র তারাকে মিটিমিটি জ্বলতে দেখি। শহর থেকে এই অসম্ভব সৌন্দর্য সেভাবে উপভােগ করা যায় না। কিন্তু এই প্রবল আলােকদূষণের হাত পেরিয়ে গ্রামমতন কোনাে জায়গা থেকে আকাশে চোখ রাখলেই বুকের গভীরে অন্য রকম এক অনুভূতি টের পাওয়া যায়। তবে বিজ্ঞানীদের কেবল রােমাঞ্চ অনুভব করে বসে থাকলে চলে না। তারা জানতে চান, এই যে এত তারা আকাশে, এরা সবাই কি একই রকম? এই প্রশ্নের জবাব পেতে মানুষকে দীর্ঘদিন গবেষণা করতে হয়েছে। একসময় এ প্রশ্নের জবাব মিলেছে। জানা গেছে, এই সব রহস্যের চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে নক্ষত্রের বর্ণালির মধ্যে। বর্ণালি মানে আলাে। নক্ষত্রের বুক থেকে পৃথিবীতে যে আলাে আসে, সেটাকে বিশ্লেষণ করে তারাদের গঠন এবং এর মধ্যকার রাসায়নিক পদার্থগুলাের ব্যাপারে জানা যায়। জানা যায়, তারাটির তাপমাত্রা কেমন, কেমন এর আকারআকৃতি। বিজ্ঞানীরা এভাবে অনেক অনেক তারার বর্ণালি বিশ্লেষণ করার পরে দেখলেন, মহাবিশ্বের আর সবকিছুর মতােই তারাদেরও কয়েকটি ভাগে ভাগ করে ফেলা যায়। করা হলাে শ্রেণিবিন্যাস। মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকে আমরা জীবের শ্রেণিবিন্যাস পড়েছি। অনেক অনেক ভাগ, উপভাগ—শ্রেণি, বর্গ, গণ, প্রজাতি—সব মনে রাখতে গিয়ে একেবারে হিমশিম খেয়ে যাওয়ার দশা! তারাদের শ্রেণিবিন্যাসেও এ রকম কিছু ভাগ আছে, তবে এত এত উপভাগ নেই। আর এই ভাগগুলাে বুঝে নেওয়া বেশ সহজ।
বর্তমানে নক্ষদের মরগ্যান-কিনান (MK) সিস্টেমে বিন্যস্ত করা হয়। এই সিস্টেমে প্রতিটি তারাকে হার্ভার্ড স্পেকট্রাল ক্ল্যাসিফিকেশন বা বর্ণালিভিত্তিক শ্রেণিবিন্যাস ব্যবস্থার কোনাে একটি শ্রেণিতে ফেলা হয়। সঙ্গে রােমান সংখ্যা ব্যবহার করে এর দীপ্তি বা পরম উজ্জ্বলতার পরিমাণ বােঝানাে হয়। ১৮৭৫ সাল। হার্ভার্ড কলেজ অবজারভেটরিতে তারাদের শ্রেণিবিন্যাস করার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। এই কাজে তারা বেশ কয়েকজন নারী জ্যোতির্বিদকে নিয়ােগ দিয়েছিল। এর উদ্দেশ্য অবশ্য নারীর ক্ষমতায়ন ছিল না। ছেলেদের চেয়ে মেয়েদেরকে তখন কম টাকায় কাজ করিয়ে নেওয়া যেত, এই হচ্ছে কথা। যা-ই হােক, নক্ষত্রের শ্রেণিবিন্যাস করার জন্য প্রচুর পরিমাণে তারা-বর্ণালির ছবি তােলা হয়। সেই ছবি বিশ্লেষণ করে উইলিয়ামিনা ফ্লেমিং প্রথম তারাদের শ্রেণিবিন্যাস করে একটি তালিকা করেন। এর নাম হেনরি ড্রেপার ক্যাটালগ। নিজের করা তালিকা সাধারণত আরেকজনের নামে নামকরণ করা হয় না। এ ক্ষেত্রে হয়েছিল, কারণ, প্রকল্পে ডাক্তার হেনরি ড্রেপারের বিধবা স্ত্রী মােটা অংকের টাকা সাহায্য দিয়েছিলেন। তালিকাটিকে পরে আরও কিছুটা গুছিয়ে পাঁচ লক্ষের বেশি তারার শ্রেণিবিন্যাসের একটি তালিকা করেন অ্যানি জাম্প ক্যানন। দুই ভদ্রমহিলাই জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসে এ জন্য অমর হয়ে আছেন।
হার্ভার্ড বর্ণালিভিত্তিক শ্রেণিবিন্যাস ব্যবস্থায় ইংরেজি অক্ষর O, B, A, F, G, K এবং M নামে কিছু শ্রেণি আছে। 0 হলাে সবচেয়ে উত্তপ্ত তারাদের শ্রেণি, আর M হলাে সবচেয়ে শীতল তারাদের শ্রেণি। যেসব তারার তাপমাত্রা ২,800-৩,৭০০ কেলভিনের মধ্যে, এরা M শ্রেণির তারা। আবার, যাদের তাপমাত্রা ৩০,০০০ কেলভিনের সমান বা বেশি, এরা () শ্রেণির তারা। সমস্যা হলাে, একই শ্রেণির মধ্যেও তাে তাপমাত্রার অনেক পার্থক্য আছে। এই সমস্যা সমাধানে আনা হলাে উপশ্রেণি 0-9। ০ হলাে একটা শ্রেণির মধ্যে সবচেয়ে উত্তপ্ত তারা, আর 9 হলাে সবচেয়ে শীতল। যেমন, A0 দিয়ে A শ্রেণির সবচেয়ে উত্তপ্ত তারাদের বােঝায়, আর A9 দিয়ে একই শ্রেণির সবচেয়ে কম উত্তপ্ত তারাদের বােঝায়। পরে এর সঙ্গে লুমিনােসিটি ক্লাস বা দীপ্তির শ্রেণিবিভাগ যুক্ত করা হয় (তালিকা-২)। যেমন, ০ বা la+ দিয়ে হাইপারজায়ান্ট বা অতি অতিকায় দানব তারা (এখানে একটা মজার ব্যাপার হলাে, রােমান সংখ্যা পদ্ধতিতে I মানে এক। la+ দিয়ে আসলে এ ক্ষেত্রে শূন্যকেই বােঝানাে হচ্ছে; এটি কোনাে রােমান সংখ্যা নয়), I দিয়ে সুপারজায়ান্ট বা অতিদানব তারা ইত্যাদি বােঝায়। ক্রমানুসারে সবচেয়ে অনুজ্জ্বল হলাে ক্লাস ডি বা VII শ্রেণির হােয়াইট ডােয়ার্ফ বা সাদা বামন নক্ষত্র।
বর্তমানে যেকোনাে তারাকে চেনার জন্য MK ব্যবস্থায় এই তিনটি জিনিসকে একত্রে ব্যবহার করা হয়। যেমন সূর্য। একটি G2V শ্রেণির তারা। যেকোনাে নক্ষত্রবিজ্ঞানী এটুকু শুনলেই বুঝবেন, এটি মূল সিকোয়েন্স বা মূল ধারার মধ্যকার একটি নক্ষত্র, যার তাপমাত্রা ৫,৮০০ কেলভিনের কাছাকাছি। কথা হলাে, এই ‘মূল ধারা’ জিনিসটা কী?
আসলে বিজ্ঞানের মূল লক্ষ্যগুলাের একটি হলাে সবকিছুকে যথাসম্ভব এক সুতােয় গাঁথা। তাহলে সব কিছুর মধ্যকার সম্পর্কটুকু যেমন বােঝা যায়, তেমনি এদের কাজকর্মের একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যাও পাওয়া যায়। একটু লক্ষ্য করলে বিজ্ঞানের সব শাখাতেই এই ব্যাপার চোখে পড়বে। যেমন রসায়নের পর্যায় সারণি কিংবা পদার্থবিজ্ঞানের সবকিছুর তত্ত্ব। তবে পদার্থবিজ্ঞানীদের আজন্ম সাধ এই সবকিছুর তত্ত্বের খোজ এখনাে মেলেনি। চারটি মূল বলের তিনটি–শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বল, দুর্বল নিউক্লিয়ার বল ও তড়িৎচুম্বক বলকে এক সুতােয় গাঁথা গেলেও মহাকর্ষ আজও জালে ধরা দেয়নি।
সে যা-ই হােক, প্রসঙ্গে ফিরি। নক্ষত্রদের শ্রেণিবিভাগের জন্য ব্যবহৃত সব তথ্যকে এক সুতােয় গাঁথার কাজ করেছে হার্থাং -রাসেল রেখাচিত্র, সংক্ষেপে এইচ-আর রেখাচিত্র (H-R Diagram)। হেনরি নরিস রাসেল এবং এজনার হার্থপ্রাং তারার দীপ্তি আর নক্ষত্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রার সম্পর্ক নিয়ে চিন্তা করছিলেন। এ জন্য তারা হার্ভার্ড কলেজের অ্যান্টনিয়া মাউরি নামের আরেক জ্যোতির্বিদের সংগৃহীত তথ্যের সাহায্য নিয়েছিলেন। মাউরির কাজের বিশেষত্ব ছিল –কোন বর্ণালিরেখা কোথায় আছে, শুধু তা-ই নয়, এরা কতটুকু চওড়া–সেটাও তিনি দেখিয়েছিলেন। একই তাপমাত্রার দুটো নক্ষত্রের বর্ণালিরেখা ভিন্ন হওয়ার অর্থ তাদের দীপ্তি বা উজ্জ্বলতা ভিন্ন। এটা হতেই পারে। অনেক ভেবেচিন্তে তাঁরা এই তথ্য একই গ্রাফ বা রেখাচিত্রে বসালেন। তৈরি হলাে এইচ-আর রেখাচিত্র। এই রেখাচিত্রের আনুভূমিক অক্ষে থাকে তারার শ্রেণি, আর লম্ব বরাবর থাকে পরম উজ্জ্বলতা। রেখাচিত্রে তারাদের বসালে দেখা যায়, বেশির ভাগ তারা রেখাচিত্রের এক কর্ণ বরাবর একটি বক্ররেখায় অবস্থান করছে। এই বক্ররেখাই হলাে নক্ষত্রের মূল ধারা। সূর্যসহ প্রায় ৯০ শতাংশ তারাই মূল ধারার তারা। এদিকে কিছু তারা ওপরের দিকের ডান কোনায় আছে। তাপমাত্রা একদম কম হলেও এদের উজ্জ্বলতা প্রচণ্ড। এদের নাম রেড জায়ান্ট বা লাল দানব তারা। আবার, নিচের বা কোনার কাছাকাছি আছে কিছু সাদা তারা। তাপমাত্রা বেশি হলেও এই তারাদের উজ্জ্বলতা কম। এরা হলাে হােয়াইট ডােয়ার্ফ বা সাদা বামন নক্ষত্র। এইচ-আর রেখাচিত্র থেকে আমরা নক্ষত্রদের ব্যাপারে বেশ কিছু তথ্য সরাসরি জানতে পারি। যেমন হার্ভার্ড বর্ণালিভিত্তিক শ্রেণিবিন্যাস থেকে তাপমাত্রা এবং অন্যান্য নক্ষত্রের মধ্যে তার অবস্থান কোথায়—এটা জানা যায়। আবার রােমান সংখ্যা থেকে তার দীপ্তি বুঝতে পারি। এ ক্ষেত্রে সূর্যের দীপ্তিকে ১ ধরে নিয়ে হিসাব করা হয়। রেখাচিত্র দেখে বােঝা যায়, মূল সিকোয়েন্সে যে তারার উজ্জ্বলতা বেশি, তার আকার বড় এবং ভর বেশি। এর কারণটা খুবই সােজা। যার আকার যত বড়, তার ভর তত বেশি। আবার ভর বেশি হওয়ার অর্থ সেই নক্ষত্রের মহাকর্ষ বলের মান বা টান বেশি।