আমরা জানি, এই মহাকর্ষ বল নক্ষত্রপৃষ্ঠের সবকিছুকে নক্ষত্রের কেন্দ্রের দিকে টানে। এই টানের ফলে নক্ষত্রপৃষ্ঠের সবকিছু সংকুচিত হয়ে কেন্দ্রে এসে পড়ার কথা। সেটা যাতে না হয়, নিজের আকার যেন ঠিক থাকে, সে জন্য নক্ষত্র মহাকর্যের বিপরীত দিকে একটি বল প্রয়ােগ করতে চায়। এই বল সে পায় কোথায়? জ্বালানি পুড়িয়ে! নক্ষত্রের বুকে যে ফিউশন বিক্রিয়া হয়, তার ফলে তৈরি হয় প্রবল শক্তি। এই শক্তি নক্ষত্রের বাইরের দিকে, মানে কেন্দ্রের মহাকর্ষের বিপরীতে কাজ করে। বােঝাই যাচ্ছে, যার আকার যত বড়, মানে যার ভর যত বেশি, তাকে কেন্দ্রের মহাকর্ষের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য তত বেশি শক্তি উৎপন্ন করতে হবে। আর যে নক্ষত্র যত বেশি শক্তি তৈরি করে, তার উজ্জ্বলতাও তত বেশি হয়। ফলে ভর, আকার আর উজ্জ্বলতার মধ্যে একটা সম্পর্ক পাওয়া যায়।
আবার উজ্জ্বলতা বা উৎপন্ন শক্তির সঙ্গে কিন্তু তাপমাত্রারও সম্পর্ক আছে। এখানে একটা মজার ব্যাপার দেখুন, সাধারণত রেখাচিত্রের আনুভূমিক অক্ষ আর লম্বাক্ষ যে বিন্দুতে মেলে, সেই বিন্দুকে শূন্য বিন্দু (0,0) ধরা হয়। এইচ-আর রেখাচিত্রে কিন্তু তা নয়। বরং আনুভূমিক অক্ষ যে বিন্দুতে লক্ষের সঙ্গে মিলেছে, সেখানে আনুভূমিক অক্ষের মান সবচেয়ে বেশি। যদিও আনুভূমিক অক্ষে O, B, A, F, G, K, M শ্রেণিকে বসানাে হয়েছে, মনে রাখতে হবে এরা মূলত তাপমাত্রার কথা বলে। অর্থাৎ আনুভূমিক অক্ষের বাঁ দিকের তারাদের তাপমাত্রা ৩০,০০০ কেলভিনের সমান বা বেশি, আর ডানের তারাদের তাপমাত্রা ক্রমান্বয়ে কমেছে। ফলে দেখা যায়, যে তারার উজ্জ্বলতা যত বেশি, তার তাপমাত্রাও তত বেশি। কারণটা একটু আগেই বলেছি। উজ্জ্বলতা বেশি হওয়ার জন্য নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ায় বেশি শক্তি উৎপন্ন করতে হয়। আর বেশি শক্তি উৎপন্ন করলে তাপমাত্রা তাে সাধারণত বেশিই হবে, নাকি?
এদিক থেকে লাল দানব আর সাদা বামন নক্ষত্রেরা ব্যতিক্রম। সে জন্যই তারা মূল ধারায় জায়গা পায়নি। এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আছে। তারাদের এই যে শ্রেণিবিভাগ—এটি কিন্তু পরিবর্তিত হতে পারে। কোনাে তারার জ্বালানি পুড়ে পুড়ে অনেক কমে গেলে তার উজ্জ্বলতা এবং তাপমাত্রাও কমে যাবে। এই জিনিস অবশ্যই ৫-১০ বছরে হয় না। কাজেই চট করে এটা বােঝা যায় না। তবে এইচ-আর রেখাচিত্রের দিকে তাকিয়ে একটুখানি ভাবলেই কিন্তু এটা বােঝা সম্ভব। রেখাচিত্রে যার দীপ্তি বা পরম উজ্জ্বলতা এবং তাপমাত্রা যত বেশি, সে তত ওপরের বাঁ দিকে (বা বক্র রেখাটির ওপরে ও বায়ে) আছে নাকি? এখন উজ্জ্বলতা আর তাপমাত্রা অনেকটা কমে গেলে তারাটির পক্ষে কিন্তু রেখাচিত্রের আগের জায়গায় থাকা আর সম্ভব নয়। তবে উজ্জ্বলতা ও তাপমাত্রা কমতে কমতে বক্ররেখা ধরে কোনাে নক্ষত্র কিন্তু অনেক নিচে নেমে আসবে না। আসলে, জ্বালানি শেষ হয়ে এলে নক্ষত্রের কেন্দ্রের মহাকর্ষের টান আর জ্বালানি পুড়ে উৎপন্ন বাইরের দিকের বলের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। শুরু হয় নক্ষত্রের মৃত্যুপ্রক্রিয়া। সুপারনােভা বা অতিনব তারার বিস্ফোরণ কিংবা কৃষ্ণগহ্বরের মতাে আকস্মিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিপর্যয় যেমন নেমে আসতে পারে, তেমনি লাল দানবে পরিণত হওয়ার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে বৈচিত্র্যহীন মৃত্যু ঘটতে পারে নক্ষত্রের। তবে সে অন্য গল্প।
সংক্ষেপে পুরাে ব্যাপারটা এমন : মূল ধারায় তিন ধরনের তারা দেখা যায়—নীল, হলুদ এবং লাল। নীল তারারা আকারে বড়, প্রচণ্ড উত্তপ্ত এবং অনেক উজ্জ্বল। এদের ভর ২০০ সৌরভর পর্যন্ত হতে পারে। হলুদ তারারা সবকিছুতেই মাঝামাঝি অবস্থানে আছে। এদের ভর সূর্যের কাছাকাছি। আর লাল তারারা খুবই ছােট, অনুজ্জ্বল এবং তারাদের মধ্যে সবচেয়ে শীতল। এদের ভর সর্বনিম্ন ০.১ সৌরভরের মতাে হতে পারে।
মূল ধারার বাইরে আছে মূলত লাল দানব আর সাদা বামন নক্ষত্ররা। লাল এবং দানবাকৃতির হলেও এরা বেশ শীতল। ভর ০.৩ থেকে ০.৮ সৌরভরের মতাে। এদিকে সাদা বামনেরা ছােট হলেও এদের ঝাল (পড়ন উত্তাপ) বেশি। এদের ভর ০.২ থেকে ১.৩ সৌরভরের মতাে হতে পারে। দূর আকাশে মিটমিট করে চলা প্রতিটি নক্ষত্রের অনেক অনেক কিছু বলার আছে। আলাের চিরকুটে সে আমাদের এসব গল্পই বলে। ভাবতে অবাক লাগে না, এই পৃথিবীতে বসেই আমরা মহাবিশ্বের সব নক্ষত্রকে একটি ছােট্ট রেখাচিত্রে নিয়ে এসেছি? তাদের গল্পের সাধারণ কাঠামােটি ধরে ফেলেছি? ভাবলে বােঝা যায়, নক্ষত্রের মিটমিটি আলাের চেয়ে পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের কাজকর্ম আসলে কোনাে অংশেই কম বিস্ময়কর নয়!