আপনি যেমন টিভি উপভোগ করতে পারেন – তেমনি দর্শন বা শ্রবণে অক্ষম লোকেরা টিভি উপভোগ করতে পারে। কিন্তু যারা বধির এবং অন্ধ উভয়ই তাদের বিশেষ সাহায্য প্রয়োজন। এখন একটি নতুন উদ্ভাবনী প্রযুক্তি টিভি সিগনালের এমন একটি রূপ দিচ্ছে যাতে অন্ধ-বধির লোকেরা বুঝতে পারে।
বধির লোকেরা শুনতে পায় না । কিন্তু টিভিতে উচ্চারিত শব্দগুলির সাবটাইটেল পড়ার জন্য তারা ক্লোজড ক্যাপশনিং ব্যবহার করতে পারে। আবার অন্ধ লোকেরা দেখতে পায় না। কিন্তু তারা টিভির পর্দায় চলমান ঘটনার ধারাভাষ্য শুনে তা বুঝতে পারে। যাইহোক যারা একই সাথে অন্ধ-বধির তাদের ক্ষেত্রে দুটো পদ্ধতির কোনোটিই কাজ করেনা বরং এটি তাদের টিভি প্রোগ্রাম দেখাকে কঠিন করে তোলে।
এনসিডিবি ( National Center on Deaf-blindness ) অনুসারে যুক্তরাষ্ট্রে মোটামুটিভাবে ৪৫,০০০ থেকে ৫০,০০০ অন্ধ-বধির লোক বাস করে। এনসিডিবির গণনা অনুসারে এসব লোকদের মধ্যে প্রায় ১০,০০০ লোকের বয়স ২২ বছরের নিচে । হাজারের বেশি অন্ধ-বধির মানুষ বিশ্বের অন্যত্র বসবাস করছে।
Ángel García Crespo স্পেনের কারলোস ইউনিভার্সিটি অফ মাদ্রিদের একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। তার দল অন্ধ-বধিরদের টিভি দেখার জন্য নতুন পথ আবিষ্কার করেছে। তিনি গতবছর পর্তুগালের অ্যাভেইরো তে একটি সম্মেলনে এ প্রযুক্তিটি জনসম্মুখে প্রকাশ করেন। দলটি কি কাজ করেছে তা তারা কাগজে লিপিবদ্ধ করেছে এ বছরের শুরুতে।
দলটি ইতিমধ্যে অন্ধ বা বধিরদের জন্য অডিও-ভিজ্যুয়েল উপকরণ তৈরি করা নিয়ে কাজ করেছে। কিন্তু দলটি তাদের সাহায্য করতে চায় যারা একই সাথে অন্ধ এবং বধির তাদের সাহায্য করতে চায়। তাই তারা কিছু অন্ধ-বধির লোকদের জিজ্ঞাসা করেছিল তারা কি সাহায্য চায়।
García Crespo বলেন,
আমরা তাদের কাছ থেকে জানতে পারি যে, তারা কারো সাহায্য ছাড়াই টিভিতে কি সম্প্রচারিত হচ্ছে তা জানতে চায়। অর্থাৎ আশেপাশে কি ঘটছে তা জানার জন্য সবসময় অন্যের সাহায্য নিতে চায় না।
-তাদের এ উক্তিটি দলটিকে চিন্তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
একই সাথে কাজ করার জন্য প্রযুক্তির সমন্বয়
যোগাযোগ করার জন্য অন্ধ-বধির লোকেরা তাদের স্পর্শানুভূতির উপর নির্ভর করে। আক্ষরিকভাবে- তথ্য পাওয়ার জন্য একটি উপায় হাতে আছে।’ টাচ বেজড হ্যান্ড সিগনাল’ এর মাধ্যমে একজন অন্ধ-বধির ব্যক্তি আরেকজন ব্যক্তির কাছ থেকে তথ্য পেতে পারে এবং তথ্য দিতে পারে। কিন্তু তথ্য আদান প্রদানের জন্য সবসময় সাহায্যকারী পাওয়া সম্ভবপর হয়ে উঠে না।
যারা দেখতে পায় না তারা ব্রেইল লাইনের মাধ্যমে তথ্য আদান প্রদান করতে পারে, ভালভাবে বলতে গেলে ব্রেইল লাইন “রিফ্রেশেবল ব্রেইল ডিসপ্লে” হিসেবে পরিচিত। ব্রেইল পদ্ধতি উত্তল বিন্দুসমূহের প্যাটার্ন ব্যবহার করে বর্ণ বা নাম্বারকে নির্দেশ করার জন্য। ‘রিফ্রেশেবল ব্রেইল ডিসপ্লে’ হল পরিবর্তনযোগ্য ব্রেইল ডিসপ্লের সমন্বয়ে তৈরি ইলেকট্রিক মেশিন। মেশিনে পাঠানো ইলেকট্রিক তথ্যের উপর ভিত্তি করে বিন্দু বা পিনগুলো উন্নীত বা অবনীত হয়। এমন একটি পোর্টেবল ডিভাইস এর মাধ্যমে যারা চোখে দেখতে পায় না তারা কম্পিউটার থেকে ই-মেইল বা অন্য কোনো তথ্য পড়তে পারে।
নতুন পদ্ধতিটি টিভি সিগনালকে ডাটা বা তথ্যে রূপান্তর করে যেটি রিফ্রেশেবল ডিসপ্লে ব্যবহার করতে পারে।
García Crespo ব্যাখ্যা করেন,
এ পদ্ধতিতে টিভির তথ্য সংগ্রহ করার জন্য সাবটাইটেল ব্যবহার করার সম্ভাবনা রয়েছে। তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গে সাবটাইটেলগুলো ‘ইমেজ’ এবং ‘অডিও’ এর সাথে চলমান অবস্থায় থাকে ,যে তরঙ্গগুলো আমরা চোখে দেখতে পায় না। একটি ইলেকট্রিক সিস্টেম এ তরঙ্গগুলোকে ক্যাপচার করে। যা আমরা করে থাকি।
এ পদ্ধতিতে প্রথমে একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম অথবা অ্যাপ ব্রডকাস্ট সিগনাল থেকে সাবটাইটেল এবং চাক্ষুষ বর্ণনা গুলো বের করে আনে। এরপর সিস্টেম উভয়কে একত্রিত করে ডাটা তে রূপান্তর করে ব্রেইলে ব্যবহারের জন্য। García Crespo মন্তব্য করেন, এটি আগে কেউ কখনো করেনি।
এখন আরেকটি অ্যাপ তৈরি করা হয়েছে যেটি চাহিদা অনুসারে লোকেদের রিফ্রেশেবল ব্রেইল ডিসপ্লে তে তথ্য প্রেরণ করে। García Crespo বলেন এটি সেকেন্ডের চেয়েও কম সময়ে এ কাজটি করে। এটি অন্ধ-বধির দের টিভি দেখতে সাহায্য করে। ব্লুটুথ কানেকশন সংযুুুক্ত সব ধরনের রিফ্রেশেবল ব্রেইল ডিসপ্লে তে এ সিস্টেম কাজ করে।
বর্তমানে এ পদ্ধতিটি শুধুমাত্র ইউরোপে ব্যবহার করা হয়। García Crespo এর দলকে বিভিন্ন অঞ্চলের ব্রডকাস্টারদের ব্যবহৃত টিভি সিগনালের ডিকোডিং প্রসেস এর মধ্যে কিছু সমন্বয় আনতে হয়। প্রকৃতপক্ষে এ পদ্ধতিটি শীঘ্রই যুুুুক্তরাষ্ট্রে পাওয়া উচিত।
এ লক্ষ্যে ‘ডিকাপটা ফাউন্ডেশন’ আর García Crespo এর দলটি এক সাথে কাজ করছে। তারা তাদের প্রোজেক্ট এর নাম দিয়েছে GoCC4All ।
Lourdes Fiallos বলেছেন , গুগল আর আইফোনের অ্যাপস এর জন্য প্রায় তৈরি হয়ে গেছে।
Lourdes Fiallos‘ ডিকাপটা ‘ তে একজন প্রোজেক্ট ম্যানেজার। তিনি আরো বলেন যে, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে অন্ধ-বধির ইউজারদের মাধ্যমে টেস্টিং শুরু করা হবে।
এছাড়াও অন্ধ-বধিরদের জন্য García Crespo এর দলটি একটি ইউনিভার্সাল কমিউনিকেটর তৈরি করতে চায়। যেটির মাধ্যমে অন্ধ-বধিররা কোনো মানুষের সাহায্য ছাড়াই কমিউনিকেট করতে পারবে।
অনিন্দ্য বাপিন ভট্টাচার্য HKNC ( Hellen Keller National Center for Deaf-blind Youth and Adult) তে একজন টেকনোলজি ডেভেলপমেন্টার এবং ট্রেনিং বিশেষজ্ঞ। ‘বাপিন’ নিজেও একজন অন্ধ-বধির। তিনি বলেন, নতুন প্রযুক্তি মানে বৃহৎ উন্নয়ন।
বাপিন কয়েকটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তিনি বলেন যে, এখানে একটি মেন্যু থাকা প্রয়োজন যেখানে তিনি নিজের ইচ্ছেমত চ্যানেল বা শো সিলেক্ট করতে পারবেন। যেখানে ক্যাপশন এবং অডিও-ভিজ্যুয়াল ডেসক্রিপশন থাকবে।
বাপিন বিজ্ঞাপন স্কিপ করার জন্য ও একটি উপায় চেয়েছেন।
বাপিন বলেন,
যারা চোখে দেখতে পায় এবং কানে শুনতে পায় তারা টিভিতে কমার্শশিয়াল ব্রেক আসলে তারা বিরতি নিতে পারে। আবার যখন তারা দেখতে ও শুনতে পায় যে, টিভি শো পুনরায় শুরু হয়ে গেছে তখন তারা মনোযোগ দিতে পারে। ‘অন্ধ-বধিররা’ ও এরকম সংকেত পেতে চায় যখন একটি টিভি শো পুনরায় শুরু হয়।
বাপিন আরো বলেন, প্রযুক্তি চমৎকার একটি জিনিস যা অক্ষম লোকেদের সাহায্য করে- এটি অন্ধ-বধিরদের ডিজিটাল তথ্য এবং যোগাযোগে এক্সেস প্রদান করে। তিনি মন্তব্য করেন, তা সত্তেও কিছু ত্রুটি রয়ে যায়। যেমন- এর মধ্যে কিছু দোকান এবং ব্যাংকের ‘সেল্ফ হেলফ মেশিন’ অন্তর্ভূক্ত । প্রায় সময় ডেভেলপাররা এসব মেশিনের মধ্যে ‘এক্সেসেবিলিটি ফিচার ‘ যোগ করতে ভুলে যায়।
García Crespo ‘র দলটি শিখেছে এক্সেসেবিলিটি বুস্ট করার জন্য নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন প্রয়োজন। এই ক্ষেত্রে টিভি সিস্টেম কে রিয়েল টাইমে কাজ করতে হবে। অথচ কেউ আগাম জানে না যে কে কোন শো টি দেখতে চায়। এ সমস্যা সমাধানের জন্য দলটির কাছে বিভিন্ন ধরনের কম্পিউটার প্রসেসর রয়েছে। যেগুলো প্রত্যেক টিভি চ্যানেলের সিগনালকে হ্যান্ডেল করতে পারে। একটি সার্ভার সেন্ট্রালি এসব কাজ পরিচালনা করে থাকে। চাহিদা অনুযায়ী সার্ভারটি সাবটাইটেল আর ভিজ্যুয়াল ডেসক্রিপশন কে প্রসেস করে ব্যবহারকারীদের নিকট প্রেরণ করে।
সম্পূর্ণ সিস্টেমটিকে কাজ করানো জটিল ছিল। কিন্তু García Crespo কাজটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে পছন্দ করেছে
García Crespo বলেন,
আমি সমস্যার সমাধান করতে ভালবাসি । আমি সেসব সমস্যাগুলোকে বেশি পছন্দ করি, যদি সেগুলো প্রযুক্তির সাথে সম্পর্কিত হয় মানুষের জীবনকে উন্নত করার জন্য
Reference : Science News for Students