সেমিস্টার ব্রেক চলছে। আপনার মন চাইলো হুট করে লস এন্জেলেস থেকে ঘুরে আসতে। এক ঘণ্টার মধ্যেই বন্ধুবান্ধব জড়ো করে হাজির হয়ে গেলেন আমেরিকায়। নাহ,এখানে ২ দিন কাটিয়ে এখন আর ভালো লাগছে না। ব্যাগ এন্ড ব্যাগেজ গুছিয়ে হোটেল চেক আউট করে বেরিয়ে গেলেন। এর কিছু সময় পর আপনাকে দেখা গেলো থাইল্যান্ড পাটায়া বীচে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এতক্ষণে আপনি ভাবছেন এমন অদ্ভুত ব্যাপার তো সায়েন্স ফিকশন বা মুভিতে দেখা যায়। টেলিপোর্ট হয়ে মুহূর্তের মধ্যে মানুষ পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে চলে যাচ্ছে। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে যা কিছু একসময় মানুষের কাছে নিছক কল্পনা ছিলো তা আজ আমাদের হাতের মুঠোয়। বিশ্বাস না হলে আপনি গ্যলিলিওর সময়কার কোন মানুষকে তার সমাধি থেকে তুলে আনুন যারা কিনা ভাবতো পৃথিবী থালার মত চ্যাপ্টা,মোটেও গোল না। ঐ ব্যক্তি অবশ্যই পৃথিবীর বর্তমান অবস্থা দেখে প্রচণ্ড বিস্মিত হয়ে পুনরায় মৃত্যুবরণ করবে।আমার কাছে মনে হয় পৃথিবীতে মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য যে সকল জ্ঞানী,ধৈর্যশীল,আশাবাদী এবং প্রচণ্ড কর্মঠ মানুষেরা ছিলেন তাদের মধ্যে বিজ্ঞানীদের নামই সবার প্রথমে আসা উচিত।কারণ অন্ন,বস্ত্রের চিন্তা বাদ দিয়ে এরাই ভেবেছিলেন প্রকৃতি নিয়ে,পৃথিবী নিয়ে, এই মহাবিশ্ব নিয়ে,এই মহাবিশ্বের নিগুড় রহস্য নিয়ে।বলছিলাম যা আজ অসম্ভব তা একসময় হয়তো মানুষের হাতের মুঠোয় থাকবে। যেমন,একসময় টেলিপোর্টেশন এর মত ব্যাপারগুলোও খুব সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। না,মোটেও মিথ্যা বলছিনা।সব সম্ভবের যে জগত সে জগত এর নাম কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা।এটাই তার সৌন্দর্য।বিজ্ঞানের এই সুন্দরতম বিদ্যা মানব সভ্যতাকে নিয়ে যাবে সফলতার শিখরে।
টেলিপোর্টেশনের মূলভিত্তি হচ্ছে ‘কোয়ান্টাম এনটেঙ্গেলমেন্ট’। এই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত ক্ষুদ্র কিছু ফোটন কণাকে দূরবর্তী স্থানে টেলিপোর্ট করতে সক্ষম হয়েছেন।আশা করা হচ্ছে বেশ অল্প সময়ের মাঝেই ভাইরাসের মত জটিল অণুকে টেলিপোর্ট করা সম্ভব হবে। টেলিপোর্টেশন সম্পর্কে জানার আগে কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিয়ে কিছু বিস্তারিত আলোচনা করবো। কারণ এ বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা না থাকার ফলে অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেন না যে টেলিপোর্টেশন আসলেই সম্ভব। অদ্ভুত সব থিওরিগুলো কিভাবে এবং কেনো আসলো সেটা জানতে জানতে আমরা পৌঁছে যাবো টেলিপোর্টেশনের কাছে। ধৈর্য ধরে পড়লে মাথা গোলানো তত্ত্বগুলো কিছুটা হলেও বোধগম্য হবে এবং বড় কোন বস্তু যেমন মানুষকে আসলেই টেলিপোর্ট করা সম্ভব কিনা কিংবা বিজ্ঞানীরা কেনো এই বিষয়ে আশাবাদী তা সম্পর্কে আপনার ধারণা পরিষ্কার হয়ে যাবে। সব সম্ভবের জগতে আপনাকে স্বাগতম।চলুন তাহলে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সৌন্দর্যে হারিয়ে যাই।
ভাবুন একটি টেনিস বল আপনি ছুঁড়ে দিলেন ওপরে।আপনি জানেন যে তা অবশ্যই আবারো আপনার হাতেই ফিরে আসবে।কারণ মহাবিশ্বের সবকিছুই নিয়মের অধীন। নিউটিনিয়ান মেকানিক্স বা চিরায়ত বলবিদ্যা আমাদের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা ব্যাখ্যার জন্য দারুণ সব তত্ত্ব এবং সূত্র সাজিয়ে রেখেছে।এবার চলুন আমরা চলে যাই আমাদের দৃশ্যমান জগতের আরও ভেতরে।টেনিস বলটার দিকে তাকিয়ে কল্পনায় চলে যান এর অনেক অনেক গভীরে।কি দেখতে পাচ্ছেন।পরমাণু এবং বেশ ক্ষুদ্র কিছু কণিকা। আপনি আসলেই এখন চলে এসেছেন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জগতে। এ এমন এক জগত যেখানে কিনা চিরায়ত বলবিদ্যার কোন সূত্র খাটে না।এ এক আলাদা জগত।এখানে কোন কিছুই নিয়মের অধীন না।
১৯২০ সালের দিকে কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে দেখা গেল ক্ষুদ্রতম কণা ইলেকট্রন যার কিনা তরঙ্গ ধর্মও আছে সে একই সময় কণা এবং তরঙ্গ উভয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে।আমি,আপনি, আপনার টুথব্রাশ এবং হ্যাঙারে ঝুলতে থাকা শার্ট সবকিছুই তো শেষমেশ ইলেকট্রনে গিয়ে শেষ হয়।তারমানে কি এসবও তরঙ্গ?সমুদ্রের ঢেউ হচ্ছে তরঙ্গ।তীরে পড়ে থাকা নুড়ি পাথর হচ্ছে কণা।তারমানে ঢেউ শুধু ঢেউ না,নুড়ি পাথরও?আবার নুড়ি পাথর শুধু কণা না,নুড়ি পাথর তরঙ্গও?সিরিয়াসলি?এবার বিজ্ঞানীরা নড়েচড়ে বসলেন।
এই জিনিস ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তারা দেখলেন একটি ইলেকট্রন আসলে গতিশীল অবস্থায় একটি তরঙ্গের ন্যায় আচরণ করে। অতঃপর স্রোডিন্ঞ্জার, যিনি সে সময়ের বাঘা বাঘা পদার্থবিজ্ঞানীদের একজন, তিনি একটি গাণিতিক সমীকরণের অবতারণা করলেন। তার ধারণা অনুযায়ী একটি ইলেকট্রন কোনভাবে একটি তরঙ্গের মত ছড়িয়ে পড়ে যেটা শুধুমাত্র একটা কণা নয়,ছড়িয়ে যাওয়া এটা মন্ডের মত। এই ধারণা আসলে কি বর্ণনা করে তা নিয়ে বহু তর্ক বিতর্ক চললো।শেষে একজন জার্মান পদার্থবিদ ম্যাক্স বর্ন নতুন এক ব্যাখ্যা নিয়ে আসলেন। তিনি বললেল এটি মোটেও ইলেকট্রনের ছড়িয়ে পড়ার মত কোন বিষয় নয়। তিনি একেবারেই নতুন একটি জিনিসের অবতারণা করলেন যার নাম ‘প্রবাবিলিটি ওয়েভ’। এই মতবাদ অনুযায়ী বর্ন দাবি করেন যেকোনো সময়ে যেকোনো নির্দিষ্ট স্থানে এই তরঙ্গের আকার বা বিস্তার নির্দেশ করে কোন সময়ে সে তরঙ্গের কোন নির্দিষ্ট স্থানে ইলেকট্রনের অবস্থান করার সম্ভাবনা। আরো সহজভাবে বলতে গেলে আপনি জিজ্ঞেস করতে পারেন না যে ঠিক এই মুহূর্তে ইলেকট্রনটি কোথায় আছে বরং এটা বলতে পারেন যে এই মুহূর্তে এই তরঙ্গের কোন নির্দিষ্ট স্থানে যদি আপনি পর্যবেক্ষণ করেন তবে ইলেকট্রনটি সেখানে থাকবে তার সম্ভাবনা কতটুকু।এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে স্রোডিন্জারের সমীকরণ ব্যাবহার করে অনেকটা সঠিকভাবে পরিমাপ করে ফেলা যায় কোন নির্দিষ্ট পরীক্ষায় একটি নির্দিষ্ট স্থানে মোট ইলেকট্রনের কত ভাগ পরিমাণ ইলেকট্রন রয়েছে।এই পর্যন্ত মোটামুটি নানান পরীক্ষার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা যে সিদ্ধান্তে আসলেন তা হলো সম্ভাবনা।যার মানে এটমিক লেভেলে প্রতিটি কণার আচরণ এমন যে এদের অবস্থান আপনি কখনোই নির্দিষ্ট করে বলতে পারবেন না।যদি মনে হয়ে থাকে যে সম্ভাব্যতা দিয়ে করা পরিমাপ কি করে সঠিক হতে পারে?তাহলে উদাহরণ দেয়ার জন্য চলুন চলে যাই লাস ভেগাসে।এখানে গড়ে ওঠা শত শত ক্যাসিনো জুয়া খেলার জন্য বিখ্যাত।এরা যে জিনিস ব্যাবহার করে মিলিয়ন ডলার আয় করছে তা গণিত ছাড়া আর কিছুই না।সম্ভাব্যতার ও যে নিশ্চয়তা বলে একটা ব্যাপার আছে এটা এরা জানে।ক্যাসিনো মালিকরা জানেন যে সম্ভাব্যতার ফলাফল অনুযায়ী যত খেলাই হোক না কেনো জেতার সম্ভাবনা আপনার ২০% হলে তাদের ৮০%।এই মজার বিষয় নিয়ে আরেকদিন বিস্তারিত লিখবো।তাহলে কোয়ান্টাম মেকানিক্স এর ব্যাখ্যানুযায়ী পৃথিবীর সকল বস্তুই সম্ভাবনা নামক একটি জালে আবৃত।কিন্তু এ ব্যাখ্যা মেনে নেয়াটা সহজ নয়।
অবশেষে একজন ব্যক্তি বেঁকে বসলেন। তিনি মানতে রাজি নন যে বাস্তব জগত এবং এর যত ক্ষুদ্র বা গভীরে যাওয়া হোক না কেনো এখানে কোনকিছু সম্ভাবনা দ্বারাই নির্ধারিত হবে। এমনটা হতে পারে না।তিনি বললেন “God doesn’t play dice”- ঈশ্বর পাশা খেলেন না।তবুও কিছু সংখ্যক পদার্থবিদ সম্ভাব্যতার তত্ত্বগুলোকে একেবারে ফেলে দিতে পারলেন না।কারণ কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সমীকরণগুলো বিস্ময়করভাবে প্রায় নির্ভুল ফলাফল এনে দিচ্ছিলো এবং বিভিন্ন কণার চরিত্র প্রায় নির্ভুলভাবে ব্যাখ্যা করছিলো পরোক্ষভাবে যার ওপর ভিত্তি করে লেসার,ট্রানজিস্টার এবং আইসি সহ আরো যুগান্তকারী আবিষ্কারগুলো হলো।কোয়ান্টাম চরিত্র বিশ্লেষণ করে ইঞ্জিনিয়াররা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সার্কিট তৈরি করেন যা ইলেকট্রনের গতিপথকে নির্ভুলভাবে নিয়ন্ত্রণ করে।পদার্থবিদরা বলেন কোয়ান্টাম মেকানিক্স এখন পর্যন্ত আমাদের পাওয়া সবচাইতে সম্ভাবনাময় এবং সফল একটি তত্ত্ব অথচ আমরা পদার্থবিজ্ঞানীরা এখনো ভাবি এখনও খুঁজি এই তত্ত্ব আমাদেরকে প্রকৃতির মাঝে লুকিয়ে থাকা সত্য নিয়ে কি বলতে চায় কি বুঝাতে চায়। কোয়ান্টাম মেকানিক্স এর জয়জয়কার সত্ত্বেও এর গভীরের রহস্যগুলো রহস্যই রয়ে যায়।
আইনস্টাইন এত সহজে সব থিওরি মেনে নেবার পাত্র নন।১৯২০ এবং ১৯৩০ এর মাঝামাঝি সময়কার যে মৌলিক প্রশ্নগুলো আইনস্টাইনকে ভাবিয়ে তুললো এবং পুনরায় বিতর্কের উদ্ভব হলো তা নিয়ে এবার আলোচনায় আসি।সেই বিতর্কগুলো তৈরি হলো মূলত সম্ভাবনা,নিশ্চয়তা এবং পরিমাপের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে।নীলস বোর পূর্বের থিওরিগুলোকে অনেকটা সমর্থন করে বললেন যে সহজাতভাবে এই সত্যের প্রকৃতি অনেকটা ধোঁয়াশার মত।তার মতে পরিমাপ করার আগে আপনি নির্দিষ্টভাবে কোন কণার অবস্থান বা আচরণ জানতে পারবেন না।আপনার পরিমাপের ফলাফল একটি সম্ভাব্যতার মধ্যে আবদ্ধ।এর সম্ভাব্য ফলাফল কি কি হতে পারে তা আপনি জানেন কিন্তু পর্যবেক্ষণ ব্যতীত আপনি কখনোই সুনির্দিষ্টভাবে এর ফলাফল নিরূপণ করতে পারবেন না।চলুন একটি বিখ্যাত উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করি।এটি একটি থট এক্সপেরিমেন্ট যা ‘স্রোডিন্ঞ্জারের বিড়াল’ নামে পরিচিত।একটি বিড়ালকে বাক্সবন্দি করে দিয়ে যদি তেজস্ক্রিয় কোন পদার্থ বাক্সের ভেতর দিয়ে দেওয়া হয় তবে দুটি ঘটনা ঘটতে পারে।হয়তো বিড়ালটি মারা যাবে নয়তো সে টিকে থাকবে।বিড়ালটি ঐ মুহূর্তে জীবিত নাকি মৃত তা আপনি বাক্স খোলার আগে কখনোই বলতে পারবেন না। সুতরাং পর্যবেক্ষণের আগে পর্যন্ত বিড়ালটি আপনার কাছে একই সাথে জীবিত এবং মৃত।এধরণের ধারণার সাথে আইনস্টাইন একমত হলেন না।তিনি বিশ্বাস করেন নিশ্চয়তায় সেটা পর্যবেক্ষণ করা হোক বা না হোক।তিনি বললেন আমি যদি ভাবি চাঁদের অবস্থান এই মুহূর্তে যেখানে থাকবার কথা, যেভাবে থাকবার কথা সেটা ঠিক সেভাবেই আছে, আমি তাকাই বা না তাকাই তাতে কিছু যায় আসে না।তিনি সিদ্ধান্তে আসলেন কিছু একটা অবশ্যই বাদ পড়ে যাচ্ছে।সেই কিছু একটা যা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের তত্ত্বগুলোকে অসম্পূর্ণ করে রেখেছে,এবং যা কোন কণার অবস্থান এবং আচরণ সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ ছাড়াই নির্ভুল ধারণা দিতে সক্ষম হবে।আইনস্টাইনের এই বিতর্ক সত্ত্বেও নীলস বোর তার নিজ বক্তব্যে অটল রইলেন।একজন বলছেন ঈশ্বর পাশা খেলেন না, অপরজন উত্তরে বললেল ঈশ্বরের কি করা উচিত তা ঈশ্বরকে বলে দেবার প্রয়োজন নেই।তর্ক লেগেই রইলো।
অবশেষে ১৯৩৫ সালে আইনস্টাইন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অসম্পূর্ণতার ব্যাখ্যা দেবার চাবিকাঠি খুঁজে পেলেন।তিনি নতুন এক ধারণার অবতারণা করলেন যে অদ্ভুত ধারণা মহাবিশ্বের সব যৌক্তিক ঘটনাকে, সব চিন্তা ভাবনাকে উল্টেপাল্টে দিতে যথেষ্ট।পদার্থবিদদের মতে এখন পর্যন্ত পাওয়া কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সব তত্ত্বের মধ্যে সবচেয়ে আজব,উদ্ভট এবং ভূতুড়ে একটি তত্ত্ব হচ্ছে এনটেঙ্গেলমেন্ট থিওরি।এটি এমন একটি তত্ত্বীয় ধারণা যা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের পূর্ববর্তী তত্ত্ব এবং সমীকরণগুলো থেকে নির্মিত হয়।আমরা মূল বিষয়বস্তুর অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছি।আজকের আলোচনার যে প্রধান আকর্ষণ টেলিপোর্টেশন, তার মূল ভিত্তি এই কোয়ান্টাম এনটেঙ্গেলমেন্ট।এই তত্ত্ব অনুযায়ী দুটি কণা যখন পরস্পরের কাছাকাছি থাকে তখন তাদের আচরণগত বৈশিষ্ট্য এবং ধর্মগুলো পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত হয়ে যায় যাকে বলা যায় এরা পরস্পর এনটেঙ্গেলড। এদেরকে আপনি পরস্পর থেকে যত দূরেই নিয়ে যান না কেনো হোক সেটা মহাবিশ্বের অপর কোন প্রান্তে বা মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে কেনো স্থানে তবুও এদের মধ্যকার এই সম্পর্ক অটুট থাকবে এবং একটি কণার যেকোনো ধর্ম ন্যূনতম পরিবর্তন হলেও বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে থাকা কণার ধর্মও একইভাবে পরিবর্তিত হবে এবং তা আলোর বেগের সমান দ্রুততার সাথে পরিবর্তিত হবে অর্থাৎ সাথে সাথেই পরিবর্তিত হয়ে যাবে।একটু উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাক। ধরুন দুটি কণা যেমন দুটি ইলেকট্রন পরস্পর এনটেঙ্গেলড অবস্থায় রয়েছে।একটি কণা পৃথিবীর কোন গবেষণাগারে আছে এবং অপরটি অবস্থান করছে চন্দ্রপৃষ্ঠে।গবেষণাগারে অবস্থিত ইলেকট্রনটি যেকোনো সময়ে যেকোনো অক্ষের সাপেক্ষে ঘূর্ণায়মান হতে পারে একে বলা হয় স্পিন।একটি কণার স্পিন যদি আপনি কোন নির্দিষ্ট সময়ে নির্ণয় করতে পারেন তবে কোনো অক্ষের সাপেক্ষে হয় সেটা ঘড়ির কাঁটার দিকে ঘুরছে অথবা ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে ঘুরছে।আপনি নির্ণয় করলেন যে আপনার গবেষণাগারে থাকা ইলেকট্রনটি এই মুহূর্তে ঘড়ির কাঁটার দিকে ঘুরছে তাহলে অবশ্যই আপনি নিশ্চিত থাকুন যে এর সাথে এনটেঙ্গেলড অবস্থায় থাকা ইলেকট্রনটির স্পিন এই মুহূর্তে ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে।এবং শুধু তাই নয়,এদের একজনের স্পিন কোনভাবে পরিবর্তন করে দিলে অপরটিও সাথে সাথে একইভাবে পরিবর্তিত হবে।এই ব্যাপারটি বেশ ভূতুড়ে হওয়ার আইনস্টাইন এই ঘটনার নাম দিলেন ‘spooky action at a distance’। এবং তিনি এটাও বললেন যে এই ব্যাপারটি আসলে অদ্ভুত না,অন্যান্য পদার্থবিদদের কাছে এই ব্যাপারটি অদ্ভুত লাগার কারণ হচ্ছে এই ঘটনার পেছনে থাকা গাণিতিক সমীকরণগুলোই অদ্ভুত, বাস্তব জগতে এটা মোটেও অদ্ভুত ঘটনা নয়।বাস্তবে আসলে এর ব্যাখ্যা খুব সহজেই দেয়া যায়। তিনি সুন্দর একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টিকে সহজভাবে ব্যাখ্যা করে দিলেন।ধরা যাক আপনি দুটি হাতমোজা তৈরি করলেন।এবার দুটি একই রকম বাক্সের একটিতে ডান হাতের মোজা এবং অপরটিতে বাম হাতের মোজা রাখলেন।একটি বাক্স আপনি আমার কাছে দিলেন এবং অপরটি পাঠিয়ে দিলেন ইংল্যান্ডের ওলসথর্প ম্যানর এ আইজ্যাক নিউটনের বাড়ির সামনে থাকা আপেল গাছের পরিচর্যাকারী মালীর কাছে।তো আমি বাক্স খুলে দেখলাম আমার কাছে আছে ডান হাতের মোজাটি তাহলে বাম হাতেরটি রয়েছে ঐ মালীর কাছে।এটা বুঝতে আমার মোটেও কোন সময় লাগেনি এবং অপর মোজাটি কত দূরে আছে তাও এখানে কোন বিষয় না।তাহলে একইভাবে দুটি কণা এনটেঙ্গেলড অবস্থায় থাকলে পরস্পর থেকে আলাদা হবার পর এদের যেকোনো একজনকে পর্যবেক্ষণ করে অপরজনের অবস্থা সম্পর্কে সুনিশ্চিত ধারণা পাওয়া যায়। তাহলে কে সঠিক? বোর নাকি আইনস্টাইন?
বোর বলছেন দুটি কণার সম্পর্কে পাওয়া তথ্য সম্ভাব্যতার ফলে কখনো কখনো মিলে যাবে আর আইনস্টাইন বলছেন দুটি কণার মধ্যে একটির ধর্ম অপরটির সাথে অবশ্যই মিলবে এবং একটির বর্তমান অবস্থা জেনে অপরটির অবস্থা সম্পর্কে বলে দেয়া যাবে।এরপর ১৯৫৫ সালে আইনস্টাইন মৃত্যুবরণ করলেন।কোয়ান্টাম মেকানিক্স অসম্পূর্ণ রয়ে গেলো।
১৯৬৭ সালে আইনস্টাইনের করা এই চ্যালেঞ্জের কিনারা করলেন কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির একজন ছাত্র যার নাম জন ক্লাউজার। নভোপদার্থবিদ্যায়(এস্ট্রোফিজিক্স) পিএইচডি ডিগ্রী অর্জনের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো তার কোয়ান্টাম মেকানিক্সে প্রাপ্ত গ্রেড। তিনি এনটেঙ্গেলমেন্ট থিওরি নিয়ে বহু চিন্তাভাবনা ও পড়াশোনার পর এ তত্ত্ব নিয়ে উঠেপড়ে লাগলেন।এর সত্যতা যাচাই করার লক্ষ্যে কিছু মেশিন তৈরি করা হলো। প্রথমবারের মত এই বিষয়ের একেবারে হাতে কলমে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হলো।প্রায় ১০০০ টি ইলেকট্রনের কোয়ান্টাম স্টেট বা বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ করে তিনি হতবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন আমি কি কোন ভুল করলাম?তিনি স্তম্ভিত হয়ে গেলেন এটা দেখে যে আইনস্টাইনের দেয়া তত্ত্ব এবং তত্ত্বের পেছনে থাকা গাণিতিক সমীকরণগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে মিলে যাচ্ছে।তিনি বারবার পরীক্ষা চালালেন এবং প্রমাণিত হলো এনটেঙ্গেলমেন্ট থিওরি এবং এর পেছনে থাকা গণিত একেবারেই বাস্তব।
২০১০ সালে তিনি সম্মানিত হন ‘Wolf Prize in Physics‘ পুরষ্কারে যা আধুনিক বিজ্ঞানে অবদান রাখার ক্ষেত্রে নোবেল পুরষ্কারের পরবর্তী অবস্থানে গণ্য হয়।অথচ এরপরও তিনি বললেল এসব ব্যাপার নিয়ে আমি এখনও বিস্মিত, আমি এখনও কোয়ান্টাম মেকানিক্স বুঝতে পারিনা।
পরবর্তী পর্বে চলে যাবো টেলিপোর্টেশন নিয়ে মূল আলোচনায়।এনটেঙ্গেলমেন্টের মাধ্যমে টেলিপোর্টেশন কিভাবে এবং কতটুকু সম্ভব হলো তা থাকছে দ্বিতীয় পর্বের আলোচনায়।
One Comment
টেলিপোর্টেশন ও কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অতীত,বর্তমান : পর্ব-২ | বিজ্ঞানবর্তিকা
[…] […]