বর্তমান পৃথিবীতে এমন মানুষ খুবই কম পাওয়া যাবে যারা হিমালয় সম্পর্কে জানেন না। পৃথিবীর প্রায় সকলের পাঠ্য বইয়ে একবার করে হলেও এই হিমালয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতি বছর অনেক মানুষ এই হিমালয়ে বেড়াতে যান। কেউ কেউ আবার এভারেস্টের চূড়ায় উঠতে আবার কেউ কেউ কাঞ্চনঝংগার সৌন্দর্য উপভোগ করতে।
ভ্রমণপিপাসুদের জন্য এটি একটি আদর্শ এবং মারাত্মক একটি জায়গা। প্রতি বছর অনেকেই মারা যান এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে গিয়ে। কিন্তু মানুষ তাও থেমে নেই।

আজ আমরা যেই হিমালয় কে দেখছি, সেটি হয়ত আমরা দেখতে পাতাম না। যদি না ইন্ডিয়ান প্লেট ইউরেশিয়ান প্লেটের সাথে ধাক্কা খেত। ৩৮-১০ মিলিয়ন বছরের মধ্যে এই পর্বত শৃঙ্গের কোনো অস্তিত্ব ছিলো না। তাহলে একবার ভেবেই দেখুন না, কি ছিলো সেই জায়গায় যেখানে আজ এতো বিশাল এক পর্বতমালা দাঁড়িয়ে আছে।
এই রহস্যের গভীরে যাওয়ার জন্যে আমাদেরকে আরো অনেক পিছনে যেতে হবে। আপনি কি ১৯৫৩ সালের কথা ভাবছেন? না, একদমই না। আমাদের যেতে হবে আজ থেকে প্রায় ২০০ মিলিয়ন বছর পূর্বে।
পেঙ্গিয়ার ভাঙন
আজ থেকে প্রায় ২০০ মিলিয়ন বছর পূর্বে একটি টেকটনিক শিফটের কারণে সুপার কন্টিনেন্ট পেঙ্গিয়া ভেঙে দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। যার মধ্যে একটি হচ্ছে লাউরেশিয়া, অপরটি গোন্ডওয়ানাল্যান্ড। আর তাদের মাঝেই জন্ম হতে থাকে “তেথিস মহাসাগরের”।

কিন্তু বিজ্ঞানীদের মতে তেথিস মহাসাগরের উৎপত্তি ঘটে আজ থেকে ২৫০ মিলিয়ন বছর পূর্বে, যখন পেঙ্গিয়ার ভাঙন প্রক্রিয়ার শুরু। বিজ্ঞানীরা এই মহাসগরের সময়কালকে ৪টি ভাগে ভাগ করে উপস্থাপন করেছেন।
কখনো ভেবেছেন কি, তেথিস মহাসাগরকে বন্ধ করতে প্রায় ৫০০০ কিমি ‘র সামুদ্রিক মহাদেশীয় প্লেটকে সাবডাক্ট করতে হয়েছিলো? যা অবশ্য গত ৫০ মিলিয়ন বছরের মধ্যে সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে গিয়েছিলো পৃথিবীর গভীরে। (তথ্যসূত্রঃ Breakdown of Pangea- National Geographic.org)
তেথিস মহাসাগর
তেথিস মহাসাগরকে হয়ত অনেকেই চিনবেন না। কিন্তু সেই মহাসাগরটি আমাদের পায়ের নিচেই অবস্থান করছে। বর্তমান তিব্বতের মালভূমি থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে উত্তর আমেরিকা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো এই মহাসাগর।
অবশ্য লাউরেশিয়া এবং গোন্ডওয়ানাল্যান্ডের ভাঙ্গনের পর থেকে এটি ছোট হতে থাকে, যা শেষ হয় ইন্ডিয়ান প্লেটের ইউরেশিয়ান প্লেটে আঘাত হানার পর। গোন্ডওয়ানা ভাঙ্গার পর যখন আফ্রিকা মহাদেশ ইউরোপের দিকে যেতে থাকে তখন তেথিসের অর্ধেক অংশ বন্ধ হয়ে যায়।

আবার কিছু কিছু বিজ্ঞানীদের মতে তেথিস ছিলো শুধুমাত্র বর্তমানের চীন এবং ভারতের মধ্যকার অঞ্চলের মাঝামাঝি। আলফ্রেদ ওয়েগনার যখন তার কন্টিনেন্টের জুড়ে যাওয়ার তত্ত্ব উপস্থাপন করেন, তখনো অনেকের মাঝে সন্দেহ ছিলো এসকল বিষয় বস্তু নিয়ে।
কিন্তু উনার তত্ত্ব প্রমাণিত হওয়ার পর সকলেই বুঝতে পারলো এই ভূতাত্ত্বিক বিষয়বস্তু সমূহকে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে তেথিসের সন্ধান কিভাবে পেল বিজ্ঞানীরা? ১৮৮৫ সালে একজন অস্ট্রিয়ান প্রত্নতত্ত্ববীদ তেথিস সম্পর্কে ধারণা দেন। তারপর ১৮৯৩ সালে একজন ভূতত্ত্ববীদ, ইডওয়ার্ড সুস একটি তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। তিনি তেথিস নামটির প্রবর্তন করেন গ্রীকদের দেবীর নামে।
সেই তত্ত্ব অনুযায়ী পেঙ্গিয়ার ভাঙ্গনের একটি ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তারপর থেকে ১৯২০ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত সময়কালে অনেক বিজ্ঞানী এটি মানতে বাধ্য হয়েছেন যে তেথিস নামক একটি মহাসাগরের অস্তিত্ব ছিল। (তথ্যসূত্রঃ “Tethys—the Evolution of an Idea” Kollmann, H. A. (1992))
তেথিস হারিয়ে হিমালয়
তেথিস মূলত হারিয়ে যেতে শুরু করে যখন গোন্ডওয়ানাল্যান্ড ভাঙতে শুরু করে। ইন্ডিয়ান প্লেট যখন উত্তর-পূর্ব দিকে যেতে থাকে তখন সামুদ্রিক প্লেট (তেথিসের তলদেশ) বন্ধ হতে থাকে।
প্রায় ১৩২-৫২ মিলিয়নের মাঝে প্রায় ৫০০০ কিমি সামুদ্রিক প্লেট ইউরেশিয়ান প্লেটের নিচে চলে যায়। সেখানে “মেন্টাল প্লুম” ‘র মাধ্যমে গলে গিয়ে আবার অন্য জায়গায় চলে যায়। আর অন্যদিকে ইন্ডিয়ান প্লেট ইউরেশিয়ার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
প্রশ্ন থাকতেই পারে, ইন্ডিয়ান প্লেট কেন ইউরেশিয়ান প্লেটের নিচে সাবডাক্ট করবে? এখানে ব্যাপারগুলো নির্ভর করবে ক্রাস্টের ঘনত্বের উপর। পুরাতন প্লেটের ঘনত্ব বেশি থাকায় তা উপরে অবস্থান করে।

১৩২ মিলিয়ন বছর পূর্বে টেকটনিক শিফটের মাধ্যমে ইন্ডিয়ান প্লেট উত্তর-পূর্ব দিকে যেতে থাকে। আর এর মাঝে ভারতীয় মহাসাগর খুলতে আরম্ভ করে। ঐসময় “কারগুলিয়ান হটস্পট” নামক একটি ম্যান্টাল প্লুমের সৃষ্টি হয়।
যা থেকে ইন্ডিয়ান কন্টিনেন্ট এবং অ্যান্টার্কটিক কন্টিনেন্ট আলাদা হয়ে যায়। ১২০-৫৫ মিলিয়ন বছরের মাঝে ইন্ডিয়ান প্লেট ইউরেশিয়ান প্লেটে আঘাত করে। এর ফলে ইন্ডিয়ান প্লেট ইউরেশিয়ান প্লেটের নিচের দিকে সাবডাক্ট করে।

ভূতত্ত্বের মতে, যখন দুইটি মহাদেশীয় প্লেট একসাথে আঘাত করে, তখন বেশি ঘনত্বের প্লেটটি তার চাপ অপসারণের জন্য তা উপরের দিকে ঠেলে দেয়। এর ফলে প্লেটটি মুছড়ে গিয়ে পাহাড় পর্বতের সৃষ্টি করে।
আজ থেকে প্রায় ৫০ মিলিয়ন বছর পূর্বে প্রায় এমনি ঘটনা ঘটেছিলো তেথিসের উপর। তখনো তিব্বতের মালভূমির অস্তিত্ব ছিল না। ইন্ডিয়ান প্লেট আঘাত হানার পর আসতে আসতে চাপ বাড়তে থাকায় ইউরেশিয়ান প্লেটের সম্মুখ অঞ্চল উপরে উঠে যায়, যা আজকের হিমালয় নামে পরিচিত।
হিমালয় তৈরি হওয়ার পর তার বিপরীত দিকের পাদদেশে তৈরি হয় পৃথিবীর বৃহত্তম মালভূমি। ইন্ডিয়ান প্লেটের আঘাতের ফলে উপরে উঠে আসা ভূমির উপর তৈরি হয় এই মালভূমি।
(তথ্যসূত্রঃ “Plate Tectonics -The Himalayas”. The Geological Society)
অপরদিকে সম্মুখ পাদদেশে তৈরি হয় বিভিন্ন নদী-নালা, এবং নতুন জলবায়ু। এমনকি হিমালয় থেকে আসা পলল দিয়েই নিচের দিকের অনেকগুলো দেশ, দ্বীপ আজ দাঁড়িয়ে আছে।
(আরো বিস্তারিত জানতেঃ কিওক্রাডং এর উতপত্তি)
হিমায়লের আবহাওয়া
হিমালয়ের এপারে বৃষ্টির হইচই আর ওপারে মরুভূমি। এমনটি কেন দেখা যায়? এর সাথে তেথিসের কোনো সম্পর্ক রয়েছে?

তেথিসের সাথে সম্পর্ক হয়ত নাও থাকতে পারে। কিন্তু জলবায়ুর সাথে ইন্ডিয়ান প্লেট এবং হিমালয়ের সম্পর্ক তখনো ছিল। হিমালয়ের সৃষ্টির পূর্ব মূহুর্তে পৃথিবীতে ৫ম বরফযুগ চলছিলো। (তথ্যসূত্রঃ https://bigganbortika.org/ice_age_ep3/)
উত্তর গোলার্ধের অনেকটুকু জায়গা বরফে ঢেকে গিয়েছিলো। যার জন্য হিমালয় সৃষ্টির পর থেকেই বরফে ঢেকে ছিলো। আর সেই বরফ গলা পানি থেকেই আজকের অনেকগুলোর নদীর সৃষ্টি।
শুধুমাত্র তাই নয়। হিমালয়ের কারণে দক্ষিণ দিক থেকে বয়ে আসা বাতাস উত্তরের পর্বতে বাধা পেয়ে আবার দক্ষিণে চলে আসে। যার ফলে ঐ পর্বতের পাদদেশে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টিপাত ঘটে।
এটি একটি বিশাল কারণ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর উর্বর থাকার জন্যে। আবার অন্য দিকে তিব্বত অঞ্চলে মেঘগুলো যেতে না পারায় সেটি শুষ্ক থেকে যায়। যার ফলে সেখানকার মাটি অনুর্বর। এমনকি বৃষ্টিপাতও অনেক কম।

শুধুমাত্র হিমালয় অঞ্চলে ১৫,০০০ গ্লেসিয়ার রয়েছে। ইন্ডুস নদীর উৎপত্তি এখনেই। মিঠা পানির সবচেয়ে বড় উৎস এই হিমালয় পর্বতশৃঙ্গ। পুরো পৃথিবীর জলবায়ুর অনেকাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে এই মহাদানব।
(তথ্যসূত্রঃ “The Himalayan Glaciers”. Fourth assessment report on climate change)
কিন্তু একবার ভেবেই দেখুন না, আজ থেকে ৫০ মিলিয়ন বছর পূর্বে কে ভেবেছিলো লবণ সমুদ্র একদিন এভারেস্টের তাজ হয়ে দাঁড়াবে। গভীর সমুদ্র থেকে ৮,৮৪৮ মিটারের পর্বত সৃষ্টি হবে। পৃথিবীর সৌন্দর্যকে মাটির উপরে সকলের সামনে তুলে ধরবে।