আমাদের সৌরজগৎ(পর্ব ৩): লোহিত রাজ্য মঙ্গল

মঙ্গল গ্রহ। লাল মাটির এই গ্রহটিকে আমরা খুব ভালোভাবেই চিনি অন্য কোনো গ্রহ থেকে। বিভিন্ন মুভি, ভবিষ্যত বসবাস করার কলোনি স্থাপন, উন্নত গবেষণা ইত্যাদি অনেক ক্ষেত্রেই মঙ্গল গ্রহের নাম সবার প্রথমে আসে। আজ জানব আমাদের অন্যতম প্রিয় গ্রহটির বিভিন্ন খুটিঁনাটি সম্পর্কে। মঙ্গল হচ্ছে সূর্য থেকে দূরত্বের হিসাবে চতুর্থ গ্রহ। মঙ্গলের নাম বিভিন্ন জাতিতে ভিন্ন ভিন্ন ছিল। রোমানরা তাদের যুদ্ধের দেবতার নামে নামকরণ করেছিল মার্স। তবে তাঁরা সেটা অনুকরন করেছে গ্রীকদের থেকে; গ্রীকরা তাদের যুদ্ধের দেবতা এরেস এর নামে লাল গ্রহটির নামকরণ করে। মিশরীয়রা মঙ্গলের রঙের কারণে এর নাম দেয় “হার দিশার” অর্থ লোহিত রঙ্গের নির্জীব। প্রাচীন চীনা জ্যোতির্বিদরাও এর নাম দেয় “আগুনের তারা”।

মূলত মরিচার কারণে মঙ্গলের মাটি লাল। পুরো মঙ্গলই লৌহ দ্বারা পরিপূর্ণ। নাসার মতে অতিরিক্ত পরিমাণ লৌহের উপস্থিতিতে তাতে মরিচা পড়ে এবং ফলস্বরূপ গ্রহটিকে লাল দেখায়। মঙ্গলের বায়ুমণ্ডল খুবই পাতলা স্তর বিশষ্ট এবং বেশ ঠান্ডা যার ফলে পানি এখানে তরল অবস্থায় থাকবে সেটা আশা করাটা মুস্কিল। মঙ্গলেই রয়েছে সৌরজগতের সবচেয়ে উঁচু পর্বতটি এবং দীর্ঘতম উপত্যকা। ”অলিম্পাস মনস” পর্বতটি প্রায় ২৭ কিলোমিটার উঁচু যা মাউন্ট এভারেস্টের তিনগুণ! “ভ্যালেস মেরিনারিস” উপত্যকার গভীরতা প্রায় ১০ কিলোমিটার এবং পূর্ব-পশ্চিম বরাবর ৪০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। ১৯৭১ সালে মেরিনার ৯ প্রব দ্বারা আবিষ্কৃত হওয়ার কারণে এর নাম এরকম রাখা হয়। বিজ্ঞানীরা মনে করেন এই উপত্যকার গিরিখাত গুলোতে একসময় পানির প্রবাহ বিদ্যমান ছিল। বিভিন্ন রকমের মাটি পরীক্ষা করে তারা এ ধরনের মত পোষণ করেন। তাছাড়াও “অলিম্পাস মনস” হচ্ছে সৌরজগতের সবচেয়ে বিশাল আগ্নেয়গিরি। এটি এতটাই বিশাল যে এর প্রস্থ প্রায় ৬০০ কিলোমিটার যা মেক্সিকো সিটির সমান! আগ্নেয়গিরিটি এখন আর সক্রিয় নয় তবে মঙ্গলে আরো বেশ কিছু ছোটো- বড় গিরি রয়েছে যেগুলোর কোনোটা থেকে মাঝেমধ্যে লাভার উদগীরণ হয়ে থাকে।

বিভিন্ন রকম চ্যানেল, গিরিখাত, ছোটো নালা ছড়িয়ে আছে পুরো মঙ্গলেই। এসব থেকে ধারণা পাওয়া যায় হয়ত কোনো একসময় এগুলো বেয়ে পানির প্রবাহ বিদ্যমান ছিল। হয়ত এখনও সেই গিরি বা নালার তলদেশে পানি রয়েছে বলে ধারণা করেন গবেষকরা। ২০১৮ সালে একটি গবেষণাপত্রে প্রকাশিত হয় মঙ্গলের ভূমির তলদেশে বিদ্যমান লোনা পানিতে হয়ত উপযুক্ত পরিমাণ অক্সিজেন রয়েছে যার ফলে সেখানে থাকতে পারে আণুবীক্ষনিক জীব! তবে এই অক্সিজেনের পরিমাণ নির্ভর করে তাপমাত্রা ও চাপের উপর, যা সময়ে সময়ে পরিবর্তিত হয়। মঙ্গলে থাকা গিরিখাত গুলো স্থানভেদে পরিবর্তিত হয়। দক্ষিণ গোলার্ধ্বের ভূমি অনেক পুরোনো তাই এতে রয়েছে বিপুল সংখ্যক গিরিখাত। হেলাস প্লানিটিয়া এরকম একটি গিরিখাত যার প্রস্থ প্রায় ২৩০০ কিলোমিটার! কিছু কিছু গিরিখাতের গঠন অনিয়মিত এবং আশেপাশের মাটির গঠন প্রমাণ করে একসময় জায়গাটা কর্দমাক্ত ছিল। অর্থাৎ জায়গা গুলোতে পানি কিংবা বরফের অস্তিত্ব ছিল অথবা এখনও আছে মাটির গভীরে!

Icy pole of Mars(photo from Mars Express )

২০১৮ সালে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির পাঠানো মহাকাশযান ”মার্স এক্সপ্রেস” দক্ষিণ মেরুর একটি ‘খাল’ Planum Australe এ পানি এবং বিভিন্ন দানাদার পদার্থের কর্দম সদৃশ কিছু অংশ দেখতে পায়, ধারণা করা হয় এই পানিযুক্ত লেকটি ভূমির ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত গভীর এবং বিস্তৃত। ঠিক এরকম এন্টার্কটিকার ভূমির নিচে থাকা লেক গুলো এরকম বিস্তৃত থাকে যেখানে বিভিন্ন প্রকার মাইক্রোব বা আণুবিক্ষণীক জীব পাওয়া যায়। মঙ্গলের আরেকটি বিশাল সম্ভাবনাময় বরফ গিরিখাত হচ্ছে Korolev Crater যাকে ঘিরে মার্স এক্সপ্রেস অনুসন্ধান চালাচ্ছে।

Mars Express

মঙ্গলের মেরুতে বিশালাকার বরফ খণ্ড ভূমিতে প্রোথিত আছে বলে বিভিন্ন পরীক্ষার ফলাফল দেখায়।এগুলো কে দেখতে টুপির মতো দেখায় বিধায় বলা যেতে পারে ভূমির উপর স্বচ্ছ পানির বরফ যা পুরো বছর ধরেই কঠিন অবস্থায় থাকে। শীতকালীন সময়ে মেরুগুলোতে ”ড্রাই আইস” বা শুষ্ক বরফের সন্ধান পাওয়া যায় যা গঠিত কার্বন ডাই অক্সাইড দ্বারা। জার্নাল অফ জিওফিজিক্যাল রিসার্চ প্লানেটস এর প্রতিবেদন মতে এই শুষ্ক বরফগুলো প্রায় বিষুবীয় অঞ্চল পর্যন্ত স্থায়িত্ব লাভ করে এবং দেখতে অনেকটা সদ্য হওয়া তুষারপাতের বরফের ন্যায় লাগে। যেহেতু সূর্য থেকে চতুর্থ দূরবর্তী স্থানে অবস্থান করছে মঙ্গল তাই গ্রহটি বেশ ঠান্ডা। এখানে গড় তাপমাত্রা থাকে মাইনাস ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো। শীতের সময় মেরুতে এই তাপমাত্রা নেমে প্রায় মাইনাস ১২৫ ডিগ্রি হয় এবং গ্রীষ্মকালে বিষুবে প্রায়ই ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠে। কার্বন- ডাই- অক্সাইড পূর্ণ মঙ্গলের বায়ুমণ্ডল পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল থেকে ১০০ গুণ কম ঘন। এত কম ঘনত্বের কারণে এখানে মেঘ বা বায়ুপ্রবাহ হয়না বললেই চলে। এজন্য শীতের সময় কার্বন ডাই অক্সাইড কঠিন আকার ধারণ করে শুষ্ক বরফে পরিণত হয়। প্রাচীনকালে এই বায়ুমণ্ডল আরো ঘন ছিল যার ফলে সেখানে বায়ু প্রবাহ ছিল এবং বৃষ্টিও হতো! সময়ের স্রোত ধরে বায়ুমণ্ডলের হালকা কণা গুলো সৌর বায়ুর চাপে উবে চলে যায় যে কারণে এটি ক্রমান্বয়ে পাতলা হতে থাকে। নাসা’র MAVEN( Mars Atmosphere and Volatile Evolution) মিশন থেকে জানা যায় মঙ্গলের কোনো চৌম্বকীয় ক্ষেত্র নেই। মঙ্গল হচ্ছে সৌরজগতের একমাত্র গ্রহ যেখানের বায়ুমণ্ডলে কার্বনডাই অক্সাইডের মেঘ সৃষ্টি হয় শীতকালীন সময়ে এবংবরফা আকারে ভূমিতে পতন ঘটে।মঙ্গলে হওয়া ধূলিঝড়ও সৌরজগতের মধ্যে ভয়ংকরতম ও বৃহত। এর কারণ হচ্ছে যখন ধূলিকয়া গুলো সূর্যের আলো শোষণ করে তা খুবই উত্তপ্ত হয় এবং পাতলা বায়ুমণ্ডলকে প্রচন্ড উত্তপ্ত করে তোলে। এতে উত্তপ্ত বায়ু ঠান্ডা বায়ুর এলাকার দিকে প্রচন্ড দ্রুত বেগে ছুটতে থাকে ও তৈরি অয় বিশাল ধূলিঝড়।

MAVEN

মঙ্গলের কক্ষপথ পৃথিবীর মতোই অনেকটা সূর্যের দিকে বাঁকানো। এর ফলে যখন সে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে বছরের বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন অংশে পতিত সূর্যালোকের পরিমাণেও তারতম্য দেখা দেয় যা মঙ্গলে ঋতু সৃষ্টির জন্য দায়ী। যাইহোক, মঙ্গলের ঋতু গুলো পৃথিবীর ঋতু থেকে চরমভাবাপন্ন। এর কারণ উপবৃত্তাকার, ডিম্বাকৃতির কক্ষপথটি অন্য কোনো গ্রহের তুলনায় অধিকতর সম্প্রসারিত। যখন মঙ্গল, সূর্যের নিকটবর্তী হয় দক্ষিণ গোলার্ধ্ব তখন সূর্যালোকের দিকে হেলে যায় এবং সেখানে দেখা দেয় খুবই উত্তপ্ত গ্রীষ্ম। অপরদিকে উত্তর গোলার্ধ্বে চলতে থাকে স্বল্পস্থায়ী শীতকাল। আবার যখন মঙ্গল সূর্য থেকে দূরে সরে যায় তখন উত্তর গোলার্ধ্বে দীর্ঘ গ্রীষ্ম পরিলক্ষিত হয় ও একইভাবে দক্ষিণ গোলার্ধ্বের শীতকালটাও দীর্ঘ হয়। মঙ্গলের দুটি উপগ্রহ, ফোবোস এবং ডিমোস কিন্তু এগুলো গ্রহটির সাথে সঠিকভাবে স্থিতিশীল নয় যার ফলে এতে ব্যতিক্রমধর্মী ঘূর্ণন দেখা দেয় কক্ষপথ জুড়ে। ২০১৭ সালে একটি গবেষণায় দেখা যায় এমন অস্থিতিশীল হেলে যাওয়ার ফলে মঙ্গলে ব্যতিক্রমী জলবায়ুর সৃষ্টি হয় যার কারণে বায়ুমণ্ডলে মিথেন উন্মুক্তি ঘটে এবং উষ্ণ আবহাওয়া পানির প্রবাহ সৃষ্টিতে কার্যকর ভূমিকা রাখে!

সূর্য থেকে মঙ্গলের দূরত্ব প্রায় ২২৭,৯৩৬,৬৪০ কিলোমিটার। পৃথিবীর দূরত্বের প্রায় দেড় গুণ। যখন সূর্যের সবচেয়ে নিকটবর্তী অবস্থানে আসে তখন এই দূরত্ব কমে হয় ২০৬,৬০০,০০০ কিলোমিটার প্রায় এবং সব থেকে দূরবর্তী অবস্থানে দূরত্ব হয় ২৪৯,২০০,০০০ কিলোমিটার।

নাসা’র মতে মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলের ৯৫ ভাগই হচ্ছে কার্বনডাই অক্সাইড সাথে আছে সাম্ন্য পরিমাণ নাইট্রোজেন, আর্গন, অক্সিজেন, কার্বন মনোক্সাইড, জেনন, ক্রিপ্টন, নিয়ন, পানি ইত্যাদি। গ্রহটির মেরুতে বর্তমানে কোনো চৌম্বকক্ষেত্র নেই কিন্তু কিছু কিছু এলাকা রয়েছে যেখানে প্রবল চৌম্বকক্ষেত্রের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় এবং সেগুলো পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র থেকে ১০ গুণ বেশি শক্তিশালী।

মঙ্গলের কেন্দ্র বা কোর নির্মিত লোহা, নিকেল এবং সালফারের সমন্বয়ে। পৃষ্ঠ আবরণের গাঠনিক উপাদান পৃথিবীর মতোই অনেকটা যা নির্মিত সিলিকন, অক্সিজেন, লোহা এবং ম্যাগনেসিয়াম দ্বারা। এর ভূত্বক গঠিত হয়েছে অগ্নিয়গিরিজাত শিলার মাধ্যমে। পৃথিবী এবং আমাদের চন্দ্রের ভূত্বকও এই শিলা দিয়ে গঠিত। এর কেন্দ্রের গভীরতা ভূমি থেকে প্রায় ৩০০০-৪০০০ কিলোমিতার পর্যন্ত বিস্তৃত এবং উপরিভাগের আবরণের পুরুত্ব ৫০ কিলোমিটার।

মঙ্গলের দুটি উপগ্রহ, ফোবোস এবং ডিমোস। যুক্তরাষ্ট্রের জ্যোতির্বিজ্ঞানী Asaph Hall এর স্ত্রী ১৮৭৭ সালে এই ভাতৃদ্বয়কে আবিষ্কার করেন। স্ত্রী এর কথা আলোকপাত করার কারণ হলো বিজ্ঞানী Asaph যখন আবিষ্কারের আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন তখন ঊনার স্ত্রী সেগুলো আবিষ্কার করেন। অস্তিত্ব প্রমাণ পাওয়ার পরের রাতেই ডিমোস আবিষ্কার করেন এবং ভহয় দিন পর ফোবোস। ফোবোস আর ডিমোস উভয় উপগ্রহ ই নির্মিত কার্বন পূর্ণ পাথর এবং বরফ দ্বারা যা ধূলিকনা দ্বারা আচ্ছাদিত। দুটো উপগ্রহ আমাদের চাঁদ থেকে আকারে ভীষণ ছোটো, আকারে অনিয়মিত এবং নিজেদের মধ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণ মহাকর্ষ শক্তি নেই গোলাকার আকৃতির হওয়ার জন্য। ফোবোসের ব্যাস ২৭ কিলোমিতার এবং ডিমোসের ব্যস মাত্র ১৫ কিলোমিটার। উভয় উপগ্রহ বড় ছোটো খাদে ভর্তি এবং সেখানে নিয়মিত বিশালাকারের উল্কাপাত হয়। উভয় সবসময় মঙ্গলের দিকে একই পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে রাখে। ফোবোস এবং ডিমোসের আবির্ভাব নিয়ে এখনও সংশয় আছে, ধারণা করা হয় গ্রহাণুপিণ্ড মঙ্গলের অভিকর্ষের মায়া কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে না পেরে উপগ্রহে পরিণত হয়েছে। এদের থেকে প্রাপ্ত অতিবেগুনী রশ্মি পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া যায় এরা একসময় গ্রহাণুপিণ্ড ছিল, জানান ইতালির পাদোভা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা।

মঙ্গলকে প্রথমে টেলিস্কোপের সাহায্যে দেখতে পান বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলেই। ধীরে ধীরে প্রযুক্তির উন্নতির সাথে নতুন জিনিস সামনে আসতে থাকে। ঊনিশ এবং বিংশ শতাব্দিতে গবেষকরা ভেবেছিলেন তারা মঙ্গলে দীর্ঘ সারি আকারে হ্রদ, খাল দেখতে পেয়েছেন এবং সেগুলোতে কলোনি গঠন করা সম্ভব। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায় এই অনুমান সঠিক ছিল না। বিভিন্ন মাধ্যমে পৃথিবীতে মঙ্গল হতে আগত মাটি এবং পাথরখন্ড পাওয়া যায় যা ছিল বিজ্ঞানীদের জন্য সোনার সুযোগ; মঙ্গলে না গিয়েও একে পরীক্ষা করতে পাড়া! ১৯৯৬ সালে মঙ্গল থেকে আসা উল্কাপিন্ড এল্যান হিলস ৮৪০০১ কে ঘিরে তৈরি হয় বেশ গুজব একইসাথে সম্ভাবনা। মিডিয়া গুলো দাবি করে এখানে হয়ত প্রাণিদেহের ফসিল ছিল কিন্তু পরবর্তীতে বিজ্ঞানীরা এমন ভ্রান্ত ধারণাকে নাকোচ করে দেন। ২০১৬ সাল পর্যন্ত এই বিতর্ক চলতে থাকে! ১৯৬০ সাল থেকেই মহাকাশযান গুলোর মাধ্যমে মঙ্গল অনুসন্ধান শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্রের মেরিনার ৪, ১৯৬৪ সালে এবং মেরিনার ৬ ও ৭, ১৯৬৯ সালে মঙ্গলকে প্রদক্ষিণ করে অনুসন্ধান চালাতে থাকে। এই অনুসন্ধান গুলো দেখায় মঙ্গলগ্রহ মোটেও সেরকম না যেরকম মানুষরা কল্পনা করেছিল সেখানে বসতি স্থাপন করে কলোনি গঠন করবে সহজে। ১৯৭১ সালেই মেরিনার ৯ গ্রহটির প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকা অনুসন্ধান করে আগ্নেয়গিরি, হ্রদ, লেক ইত্যাদির সন্ধান আমাদেরকে দেয়।

Mariner 4

সোভিয়েত ইউনিয়নও ৬০ এবং ৭০ এর দশকে বেশ কিছু মঙ্গল অভিযান শুরু করে কিন্তু বেশিরভাগই পণ্ড হয়ে যায়। শেষমেষ মার্স ২ এবং মার্স ৩ যথাক্রমে ১৯৭১ সালে সফলভাবে প্রদক্ষিণ করতে থাকে কিন্তু সেগুলো প্রবল ধূলিঝড়ের কারণে গ্রহের পৃষ্ঠভাগ দেখতে পায়না। নাসা’র ভাইকিং ১ মহাকাশযান প্রথমে লাল গ্রহের ভূমিতে অবতরণ করে ১৯৭৬ সালে এবং বিভিন্ন রকম ছবি তুলে পাঠায়। ১৯৯৬ সালে দুটি যান পথফাইন্ডার যা একটি ল্যান্ডার এবং মার্স গ্লোবাল সার্ভেয়ার(অরবিটার) পাঠানো হয় মঙ্গলের উদ্দেশ্যে। পথফাইন্ডারের মধ্যে ছিল একটি ছোটো রোবট সোজার্নার যা প্রথম কোনো চাকা বিশিষ্ট রোভার, গ্রহটির পাথর পরীক্ষা নিরীক্ষা করে। ২০০১ সালে নাসা মার্স অডিসে প্রব পাঠায় যা মঙ্গলের ভূমি তলে বিশাল এক বরফের রাজ্য আবিষ্কার করে প্রায় ১ মিটার পুরুত্ব বিশিষ্ট। এই বিষয়টি প্রমাণ করে এরকম বরফবন্দি পানির পরিমাণ অনেক আছে মঙ্গলে। ২০০৩ সালে মঙ্গল পৃথিবীর সবচেয়ে নিকটবর্তী অবস্থানে আসে যা গত ৬০০০০ বছরের হয়নি। সে বছরেই নাসা দুটো রোভার স্পিরিট এবং অপরচুনিটি পাঠায় মঙ্গলের উদ্দেশ্য যা বিভিন্ন এলাকা পর্যবেক্ষণ করে। দুটো রোভার থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায় একসময় মঙ্গলে পানির প্রবাহ বিদ্যমান ছিল। ২০১১ সালে নাসার মঙ্গল গবেষণা কেন্দ্র থেকে পাঠানো হয় মার্স কিউরিওসিটি রোভার। এটি মঙ্গলের মাটি এবং বিভিন্ন ভূতাত্বিক বিষয়াদি পরীক্ষা নিরীক্ষা করে। নাসার আরো দুটো অরবিটার এম আর ও এবং মাভেন এখনও প্রদক্ষিণ করছে মঙ্গলকে। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির দুটো অরবিটার মার্স এক্সপ্রেস এবং ট্রেস গ্যাস অরবিটার মঙ্গলকে প্রদক্ষিণ করছে। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের মার্স অরবিটার মিশন চতুর্থ দেশ হিসাবে নিজেদের যানকে সফলভাবে মঙ্গলের কক্ষপথে প্রবেশ করায়। ২০১৮ সালে নাসা মার্স ইনসাইটকে মঙ্গলে পাঠায় যা একটি স্থির ল্যান্ডার। এটি ভূমির নিচে প্রোব পাঠিয়ে বিভিন্ন জিনিস অনুসন্ধান করবে। এই বছর এবং এই জুলাইয়ের শেষ দিকে নাসা মার্স ২০২০ রোভার পাঠাবে মঙ্গলে, কিউরিওসিটি মিশনের উত্তরাধিকার হিসেবে! ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি কাজ করছে নিজস্ব এক্সোমার্স রোভার নিয়ে যা হয়ত এ বছর পাঠানো হতে পারে।

Curiosity Rover

শুধু এসব যন্ত্রদানব নয়, মানুষও হয়ত আগামীতে এবং এই ২০৩০ সালের মধ্যে মঙ্গলে যাবে এই স্বপ্ন সামনে রেখে কাজ করছে বিভিন্ন সংস্থা এবং দেশের সরকার। আমাদের সবার পরিচিত এলন মাস্কও বিভিন্ন উপায়ে মানবজাতি কে মঙ্গলে নেয়ায়র প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন স্পেস এক্সের মাধ্যমে। লোহিত এই রহস্যময় গ্রহকে নিয়ে অনেক জল্পনা কল্পনাই তো হলো, হয়ত অদূর ভবিষ্যতে আমরা দেখব সব প্রশ্নের অবসান ঘটিয়ে সাইন্স ফিকশন ভূমিকে বাস্তব প্রমাণ করে মানুষ মঙ্গলে বসতি স্থাপন করেছে!

তথ্যসূত্রঃ space.com, ESA, NASA

বুধ গ্রহ সম্পর্কে জানতে এখানে ক্লিক করুন।

শুক্র গ্রহ সম্পর্কে জানুন

Comments are closed.