সূর্য থেকে দ্বিতীয় নিকটিবর্তী অবস্থানে যে গ্রহটি আছে তা হলো আমাদের সবার অতি প্রিয় শুক্র গ্রহ। মজার ব্যাপার এই যে পুরো সৌরজগতের মধ্যে শুক্রই একমাত্র গ্রহ যার নামকরণ করা হয়েছে রোমান দেবীর নামে যাকে বলা হয় ভালোবাসা এবং সৌন্দর্যের দেবী! হয়তবা এর নামকরণ করা যেতে পারত রোমান দেবমন্দিরের সবচেয়ে সুন্দর দেবতার নামে, কারণ প্রাচীন জ্যোতির্বিদদের কাছে এটিই ছিল অন্য সব গ্রহের তুলনায় সবচেয়ে উজ্জ্বলতম। প্রাচীনকালে ভাবা হতো শুক্র হয়তো দুটি আলাদা নক্ষত্র। একটি ভোরে উদিত হয় এবং অপরটি সন্ধ্যা বেলায়। ল্যাটিন ভাষায় বলা হতো তারা দুটির নাম Vesper & Lucifer।

শুক্র এবং পৃথিবীকে প্রায়ই বলা হয়ে থাকে যমজ বা মেলায় হারিয়ে যাওয়া সহোদর! কারণ উভয়েরই আকার, ভর, ঘনত্ব এবং অভিকর্ষ প্রায় সমান বা কাছাকাছি। আকারে শুক্র পৃথিবী থেকে সামান্য ছোটো এবং পৃথিবীর ভরের প্রায় ৮০ শতাংশ। শুক্রের অভ্যন্তর নির্মিত ধাতব লোহা দ্বারা যা প্রায় ৬০০০ কিলোমিটারের মত বিস্তৃত কেন্দ্র পর্যন্ত। শুক্রের ভূ-ত্বক অগ্নিয়গিরিজাত শিলা দ্বারা নির্মিত যা প্রায় ১০-১২ কিলোমিটার পুরু।

শুক্র হচ্ছে সৌরজগতের সবচেয়ে উত্তপ্ত গ্রহ যদিও এটি সূর্যের সবচেয়ে নিকটবর্তী নয়। তাহলে এমন হওয়ার কারণ কী? কারণ হচ্ছে এর অত্যন্ত পুরু বায়ুমণ্ডল সূর্যের উত্তাপকে ধরে রাখতে সক্ষম হয় যা সার্ফেস টেম্পারেচার বাড়িয়ে দেয়। বলা যেতে পারে পৃথিবীতে যে কারণে গ্রীণহাউজ প্রভাবের সৃষ্টি হয় ঠিক সেরকমই। এর ফলে শুক্রের পৃষ্ঠ তাপমাত্রা দাঁড়ায় প্রায় ৪৭১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে এবং এমন তাপমাত্রা সীসা গলিয়ে দেবার জন্য উত্তম। এতে পাঠানো মহাকাশযান পৃষ্ঠে অবতরণের কয়েক ঘন্তার মধ্যেই গলে গিয়ে ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। শুক্রের বায়ুমণ্ডল’কে বলাহয় নরকের দরজা! এর মূল উপাদান কার্বন ডাই অক্সাইড, সালফিউরিক এসিডের মেঘ এবং অতি সামান্য পরিমাণ পানি। বায়ুমণ্ডলটি সৌরজগতের অন্য সব গ্রহের তুলনায় ভারী যেটার কারণে শুক্র পৃষ্ঠে পৃথিবীর চেয়ে প্রায় ৯০ গুণ বেশি চাপ অনুভূত হয়!। এই চাপ সমুদ্রতলে ১০০০ মিটার গভীরে অনুভূত হওয়া চাপের সমান। যাইহোক, নাসা’র গডার্ড ইন্সটিটিউট অফ স্পেস স্টাডির একটি মডেল থেকে ধারণা করা হয় যে একসময় শুক্র গ্রহ জীবের জন্য বসবাস উপযোগী ছিল। শুক্রের পৃষ্ঠ প্রচন্ড শুকনো এবং খটখটে, কারণ আমরা আগেই জেনেছি। অত্যাধিক তাপের কারণে সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি সরাসরি পৃষ্ঠে আসে এবং পানি তৈরি হবার সাথে সাথেই তা বাষ্পাকারে উবে যায়! বায়ুমণ্ডলের ভয়ংকর এই ওজন স্তরের কারণে কখনোই হয়তবা শুক্র পৃষ্ঠে পানি তৈরি হবেনা।

শুক্র গ্রহের প্রায় দুই- তৃতীয়াংশ সমতলই আগ্নেয়গিরি দ্বারা পূর্ণ। কিছু কিছু আগ্নেয়গিরি এখনও বেশ সক্রিয় যাদের প্রস্থ প্রায় ১ কিলোমিটার থেকে ২৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত হয় এবং লাভা প্রবাহের খাল ৫০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত যা অন্য কোনো গ্রহ থেকে সবচেয়ে বেশি! গ্রহের প্রায় এক- তৃতীয়াংশ ভূমি পর্বত দ্বারা আবৃত। এগুলোর বিস্তৃতি প্রায় ৫৪০ মাইল কিংবা ৮৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে এবং সর্বোচ্চ চূড়ার উচ্চতা ১১ কিলোমিটার প্রায় যা গ্রহের সবচেয়ে উচু স্থান! শুক্রের প্রাচীন নাম Lucifer এর অর্থ ছিল যে উজ্জ্বলতা বা আলো বয়ে আনে। পৃথিবীর আকাশ থেকে দেখা শুক্র গ্রহ সব গ্রহ বা নক্ষত্রের চাইতে উজ্জ্বল বস্তু।এত উজ্জ্বলতার কারণ হচ্ছে শুক্রের মেঘ, সেগুলো অত্যন্ত আলোকগ্রাহী এবং উচ্চ প্রতিফলন ক্ষমতা সম্পন্ন।
শুক্র নিজের অক্ষে একবার ঘুরে আসতে সময় নেয় পৃথিবীর হিসাবে প্রায় ২৪৩ দিন! অর্থাৎ পৃথিবীতে একদিন সমান শুক্রের ২৪৩ দিন। এত কম ঘূর্ণন গতির কারণে এতে পর্যাপ্ত পরিমাণ চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি হতে পারেনা। তাই শুক্রের চৌম্বকক্ষেত্র পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের মাত্র ০.০০০০১৫ ভাগ। উপর থেকে যদি দেখা হয় তবে দেখা যায় যে শুক্রের ঘূর্ণন দিক ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে ঘুরে। সেজন্য এখানে সূর্য পশ্চিম দিকে উদিত হয় এবং পূর্ব দিকে অস্ত যায়। শুক্র সূর্যের চারিদিকে একবার ঘূর্ণন সম্পন্ন করতে সময় নেয় ২২৫ দিন, এর মানে একদিন হওয়ার আগেই সেখানে এক বছর হয়ে যায়! শুক্র গ্রহ শেষ সূর্যের সামনে দিয়ে প্রদক্ষিণ করেছিল ২০১২ সালে এবং পরবর্তীবার আসবে ২১১৭ সালে!সূর্য থেকে শুক্রের দূরত্ব প্রায় ১০৮,২০৮,৯৩০ কিলোমিটার। সর্বোচ্চ নিকটে থাকাকালীন দূরত্ব ১০৭,৪৭৬,০০০ কিলোমিটার এবং সর্বোচ্চ দূরে থাকাকালীন দূরত্ব হচ্ছে ১০৮,৯৪২,০০০ কিলোমিটার।

শুক্রের উপরে ভাসমান মেঘ গুলো প্রতি চারদিনে গ্রহকে একবার ঘুরে আসে। ঘন্টায় প্রায় ৩৬০ কিলোমিটার বেগে হ্যারিকেনের গতিতে এই ঘূর্ণন সম্পন্ন হয় যা শুক্রের আবর্তন গতি থেকে ৬০ গুণ বেশি! এটা অন্যতম একটা রহস্য বিজ্ঞানীদের কাছে। এই মেঘ গুলো একধরনের অতিবেগুনী রশ্মি ধারক হিসেবে কাজ করে থাকে। সুর্য থেকে আসা অতিবেগুনী রশ্মি গুলোর প্রায় অর্ধেক অংশই শোষণ করে থাকে। এই কারণেই গ্রহ পৃষ্ঠ এতটা উত্তপ্ত এবং নরক তুল্য। ২০০৫- ২০১৪ পর্যন্ত মিশনে থাকা ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির মহাকাশযান Venus Express শুক্র গ্রহ থেকে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে গ্রহটিতে পৃথিবীর মতো বজ্রপাত হয়! সালফিউরিক এসিড পূর্ণ মেঘে মেঘে ঘর্ষণের ফলে এরকম ঘটনা ঘটে থাকে। অনেক বিজ্ঞানীদের কাছে এই বজ্রপাতের ঘটনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটা সম্ভব যে চার্জিত কণার নির্গমন হয়তবা জীবন শুরু করার জন্য প্রয়োজনীয় অণুর সৃষ্টি করতে পারে যেমনটা হয়েছিল পৃথিবীতে বলে কেউ কেউ বিশ্বাস করেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ইউরোপিয়ান মহাকাশ সংস্থা, জাপান এরোস্পেস এজেন্সি এখন পর্যন্ত প্রায় ২০ টিরও অধিক মহাকাশযান পাঠিয়েছে শুক্রের উদ্দেশ্যে গবেষণা এবং বিভিন্ন অনুসন্ধানের জন্য। নাসার মেরিনার ২ ছিল প্রথম কোনো মহাকাশযান যা ১৯৬২ সালে শুক্রের পৃষ্ঠের ছবি তুলে আনে সৌরজগতের প্রথম গ্রহ অনুসন্ধানকারী হিসেবে। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেনেরা ৭ ছিল প্রথম কোনো মহাকাশযান যা কোনো গ্রহ তথা শুক্রের পৃষ্ঠে ১৯৭০ সালে অবতরণ করে। ভেনেরা ৯ শুক্র পৃষ্ঠের ছবি নিয়ে প্রথমে পৃথিবীতে ফেরে। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির Venus Express প্রায় ৮ বছর যাবত বিভিন্ন আধুনিক সরঞ্জাম সহকারে শুক্রকে আবর্তন করে এবং বজ্রপাতের অস্তিত্ব নিশ্চিত করে। দীর্ঘ আট বছরের অভিযান শেষে মহাকাশযানটি ২০১৪ সালে জ্বালানী ফুরিয়ে যাওয়ার কারণে শুক্র পৃষ্ঠে পতিত হয়। শুক্রের উদ্দেশ্যে শুরু করা জাপানের Akatsuki মিশন শুরু হয় ২০১০ সালে। কিন্তু যান্ত্রিক গলযোগের কারণে মহাকাশযানটির প্রধান ইঞ্জিন মহাকাশেই নষ্ট হয়ে যায় এবং এটি অনিয়ন্ত্রিত ভাবে পরিভ্রমণ করতে থাকে। তবে জাপানের দল অত্যন্ত দক্ষতার সাথে থ্রাস্টার ব্যবহার করে মহাকাশযানটিকে সেটির গতিপথে ফিরিয়ে আনেন। ২০১৫ সালে এটি শুক্রকে প্রদক্ষিণ করা শুরু করে এবং ২০১৭ সালে শুক্রের বায়ুমণ্ডলে আবিষ্কৃত হয় রহস্যময় “Gravity Wave“। এখনও মহাকাশযানটি শুক্রকে ঘিরে আবর্তন করছে এবং প্রতিনিয়তই নতুন নতুন তথ্য উপহার দিচ্ছে!


রাশিয়া এবং নাসার একটি যৌথ উদ্যোগে সামনে পরিচালিত হবে Vanera-D Mission। যেটাতে থাকবে একটি অরবিটার, একটি স্পেস প্রব যা শুক্রে অবতরণ করবে এবং আরেকটি সৌর চালিত এয়ারশিপ। জানা যায় এই মিশনের সম্ভাব্য উৎক্ষেপণ তারিখ হতে পারে ২০২৬ সাল নাগাদ। হয়ত আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে কিছু নতুন এবং রহস্যময় ঘটনা!

তথ্যসূত্রঃ Space.com,NASA, Nature, ESA
গত পর্বে ছিলো, বুধ গ্রহ নিয়ে। বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন (এখানে)।