বরফযুগে পৃথিবী- (পর্ব ০১)

মহাবিশ্বের সৃষ্টির পর থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে মানুষ আসার পর থেকে, সব সময় নতুন কিছু আবিষ্কার করেই চলেছে। আমাদের অজানা অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেয়েছি এই পৃথিবীর মধ্যেই। এমনকি আমরা এটাও জানি যে সৃষ্টির আদিতে পৃথিবী কেমন ছিল, কি অবস্থায় ছিল এবং তার রূপান্তর সম্পর্কিত প্রায়  সকল তথ্যের উন্মোচন করেছি। সেই ৪.৬ বিলিয়ন বছর পূর্বের পৃথিবী আর আজকের মাঝে অনেক পরিবর্তন হয়েছে এমনকি হতেই থাকবে।

আমরা সকলেই কম বেশি হলিউডের চলচ্চিত্রগুলোতে ফিকশনের অনেক কাজ দেখেছি যেখানে কোনো বিশাল ঘূর্ণিঝড়ের কারণে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গিয়েছে বা সবকিছু জমে বরফ হয়ে গিয়েছে। আবার কখনো কখনো দেখানো হয় ভূমিকম্পের ফলে পুরো শহর ধ্বসে গিয়েছে বা সুনামিতে পানির তলায় চলে গিয়েছে। এসকল চলচ্চিত্র সমূহ মানুষের কল্পনাকে কাজে লাগিয়েই মূলত তৈরি করা হয়। কিন্তু আমি যদি বলি এমন কিছু আমার আপনার বা মানুষের পৃথিবীতে আগমনের পূর্বেই ঘটেছিল। বিশ্বাস করবেন যদি বলি শেষ বরফযুগে পৃথিবী প্রায় ১১,৭০০ বছর ধরে বরফের চাদরের নিচে পড়ে ছিল। পুরো পৃথিবীর অবস্থা আজকের এন্টার্কটিকা মহাদেশের মতো ছিলো।

বিশ্বাস করা কষ্টকর হলেও এটাই সত্যি আজকের এই পৃথিবী এককালে বরফযুগে ছিলো। তাও শুধু একবার কিংবা দুবার নয়। পাঁচবার এই পৃথিবীতে বরফযুগের সূচনা এবং ইতি ঘটেছিল। তাহলে চলুন, আজকের এই উত্তপ্ত পৃথিবীর কিছু হিমশীতল ইতিহাস জেনে আসি।  

বরফযুগ বা আইস এজ হচ্ছে সম্পূর্ণ পৃথিবী এবং পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের উপর প্রভাব বিস্তারকারী কম তাপমাত্রা সম্পন্ন একটি দীর্ঘ সময়কাল। যার কারণে পৃথিবীর প্রায় সকল জায়গা পুরু বরফ স্তরের নিচে চলে যায় বা বরফের চাদরে ঢাকা পড়ে। এর কারণে পৃথিবীর সকল হিমবাহের প্রসারণ ঘটে এবং বরফের চাদর গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। এক একটি বরফযুগ নির্দিষ্ট সময়কাল জুড়ে পরিচালিত হয়ে থাকে। এই বরফযুগ প্রায় মিলিয়ন বছর ধরেও স্থায়ী থাকতে পারে, এবং তারা দুইটি আন্তঃ হিমবাহের মাঝে অবস্থান করে থাকে। (তথ্যসূত্রঃ Imbrie, K. P. (1979). Ice ages: solving the mystery)

চিত্রঃ কন্টিনেন্টের উপর বরফের চাদর

বর্তমানে পৃথিবীতে যে হিমবাহ সচল রয়েছে তা হচ্ছে “কোয়াটারনারি গ্লাসিয়েশন” বা চতুরাত্মক হিমবাহ। এটি আবার প্লাস্টোসিন হিমবাহ নামেও পরিচিত, যা ২.৫৮ মিলিয়ন বছর পূর্বে শুরু হয়ে আজ অবধি চলছে। এক একটি বরফযুগ মূলত একটি হিমবাহকাল এবং আরেকটি আন্তঃ হিমবাহকালে সংঘঠিত হয়। অর্থাৎ, পৃথিবীতে কিছু সময়কাল ধরে অনেক ঠান্ডা অনুভূত হবে এবং পরবর্তি সময়ে অনেক বেশি গরম অনুভূত হবে। আর এই প্রত্যেকটি সময়কাল কে যোগ করলে একটু বরফযুগ পাওয়া যায়।

এখন প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে যে, বরফযুগে পুরো পৃথিবী বরফের চাদরে ঢেকে থাকার কথা কিন্তু সবসময় তা ঘটে না কেন? এর উত্তর কিছু বিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীর ঘূর্ণন এবং সূর্যের সাপেক্ষে অবস্থানকে দায়ী করে থাকেন এবং তা অনেকাংশেই যথার্থ।

বরফযুগ কেন আসে?

বিজ্ঞানীদের মতে কয়েকটি কারণ হতে পারে পৃথিবীতে বরফযুগের আবির্ভাব হওয়ার। সেগুলো হচ্ছে,

  • পৃথিবীর অক্ষের পরিবর্তন
  • ঘূর্ণন গতির পরিবর্তন
  • সূর্য থেকে পৃথিবীর দুরত্ব
  • দীর্ঘ শীতকাল
  • হিমবাহের সময়কাল দীর্ঘ হওয়ায়
  • আন্তঃহিমবাহের সময় স্বল্প হওয়ায়
চিত্রঃ পৃথিবীর আবর্তন

এখন ঐ সময়গুলোতে সূর্য থেকে যে রশ্মি পৃথিবীতে আসতো তার সম্পূর্ন তাপ পৃথিবী ধরে রাখতে পারতো না। যার কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা দ্রুত কমতে থাকে। বর্তমানে এন্টার্কটিকা বা আর্ক্টিকের তাপমাত্রা প্রায় ৫৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত নামতে পারে। আর ঐসময় গুলোতে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা মাইনাস ৫৬-৬০ ডিগ্রী সেলসিয়াস ছিল (তাপমাত্রার পার্থক্য বিভিন্ন বিজ্ঞানীর মতামত অনুযায়ী)। প্রথম দিকের বরফযুগে কন্টিনেন্টগুলো বর্তমান এন্টার্কটিকা অবস্থানে ছিল। অর্থাৎ, সূর্যের আলো শুধুমাত্র বিষুবরেখা বরাবর পরত। যার ফলে বাকী কন্টিনেন্টগুলো বরফের চাদরে জড়িয়ে যায়। (তথ্যসূত্রঃ Lee Hannah, Climate Change Biology)

বরফযুগের প্রমাণসমূহ

বরফযুগের তিন ধরণের প্রমাণ বর্তমানে বিজ্ঞানীদের নিকট রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে,

  • ভূতাত্ত্বিক প্রামানাদী
  • রাসায়নিক প্রমানাদী
  • প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমানাদী
চিত্রঃ হিমবাহ চ্যানাল

ভূতাত্ত্বিক প্রমানাদী

বরফযুগের সবচেয়ে বড় নিদর্শন হচ্ছে ভূমির উপর যেসকল প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন কোনো বড় পাথরের উপর ঘষার দাগ এবং বিভিন্ন আঁচড়ের দাগ লক্ষ করা যায়। তাছাড়া দেখা যায় “গ্লেসিয়াল মোরেইন” বা তুষারযুগীয় গ্রাবরেখা ( মোরেইন হচ্ছে কোনো তলের উপর দিয়ে যেমন কোনো পাথর কিংবা মাটির উপর দিয়ে বড় কোনো বরফের ছাইয়ের আঁচড়ের দাগ যা পুরো একটি মাটির স্তর সরাতে সক্ষম), ড্রামলিনস (উপবৃত্তাকার আকৃতির ছোটখাটো একটি পাহাড়, যার মধ্যে কাদার মাটির তৈরি নুড়ি পাওয়া যায়)। কিছু কিছু পাহাড়ের ন্যায় জায়গা দেখা যায়, যেখানে পাহাড়ের কিছু অংশ কোনো তুষার ধ্বসে কেটে যায় আর তার আসে পাশেই হিমবাহ পাওয়া যায়। বিভিন্ন ধরণের “টিল” এবং “টিল” জাতীয় পদার্থ পাওয়া যায় ( টিল হচ্ছে একধরণের পলল যা বিভিন্ন আকারের কণা দ্বারা গঠিত)। এই ‘টিল’ গুলো গলিত হিমবাহ থেকে এসেছে এবং একটি নির্দিষ্ট জায়গায় জমা হয়ে তৈরি হয়েছে। তাছাড়া কিছু ‘গ্লেসিয়াল ইরেটিক্স’ দেখা যায় যা বিভিন্ন পাথর বা নুড়ি থেকে তৈরি হয়েছে এবং তা অন্যান্য পাথর থেকে আলাদা।

চিত্রঃ পাহাড়ে মাঝে অবশিষ্ট গ্লেসিয়ার

হিমবাহগুলি ভূতাত্ত্বিক প্রমাণগুলি বিকৃত এবং মুছে ফেলার প্রবণতা তৈরি করে, যার কারণে প্রমাণগুলো  ব্যাখ্যা করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাছাড়া প্রমাণগুলো কখন গঠিত হয়েছে, তাদের নির্দিষ্ট সময় বের করা কিছুটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এর জন্য প্রথম দিকের গবেষণাগুলোতে কিছু ভুল আসতো। তখন সবাই ভাবতো হিমবাহকাল আন্তঃহিমবাহ কাল থেকে ছোট ছিল। পরবর্তিতে অবশ্য তার সমাধান পাওয়া যায়। ঐ এলাকায় পলললের আবির্ভাব এবং আইস কোর এর উপস্থিতির উপর ভিত্তি করে হিমবাহকাল এবং আন্তঃহিমবাহকালের সময় নির্ধারণ করা হয়। অবশ্য এর জন্য অনেক সময় লেগেছিল বিজ্ঞানীদের। (তথ্যসূত্রঃ History.com/ice_age)

রাসায়নিক প্রমানাদী

রাসায়নিক প্রমাণের মধ্যে মূলত দেখা হয় যে, পলল এবং পাললীক শিলা এবং সমুদ্রের পলললের মধ্যে উপস্থিত জীবাশ্মের আইসোটোপের অনুপাতের বিভিন্নতা রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ের হিমবাহকালের বরফের কোরগুলি তাদের পূর্ববরর্তী বরফ থেকে জলবায়ুর তথ্য সরবরাহ করে এবং বায়ুমণ্ডলের বুদবুদ থেকে বায়ুমণ্ডলের নমুনা সরবরাহ করে। যেহেতু ভারী আইসোটোপযুক্ত পানির বাষ্পীভবনের তাপ বেশি থাকে, তাই শীতকালে এর অনুপাত হ্রাস পায়। আর এটি তাপমাত্রার একটি নির্দিষ্ট তথ্য বহন করে থাকে। (তথ্যসূত্রঃ “How are past temperatures determined from an ice core?”The Scientific American)

চিত্রঃ একটি প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ

প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমানাদীঃ

প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমানাদীর মধ্যে মূলত জীবাশ্মের তথ্য হিসেব করা হয়ে থাকে। আর ভৌগোলিক অবস্থানের উপর নির্ভর করেই জীবাশ্মগুলো বিভিন্ন জায়গায় বরফের চাদর বা ছাইয়ের নিচে আটকা পড়ে আছে। হিমবাহের সময়কালে শীতল-অভিযোজিত জীবগুলি পৃথিবীর নিম্ন অক্ষাংশে ছড়িয়ে পড়ে এবং উষ্ণ তাপমাত্রা পছন্দকারী জীবগুলি বিলুপ্ত হয়ে যায় বা নিম্ন অক্ষাংশে কোনো পাথরে বা বরফের মধ্যে সঙ্কুচিত হয়ে থাকে। এই প্রমাণগুলো সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা কিছুটা কষ্টসাধ্য। কারণ,

  • দীর্ঘ পরিধির মধ্যকার অক্ষাংশে যে পললগুলো স্তরাকারে পড়ে থাকে, প্রায় সবগুলোই একই দেখতে। তাই নির্দিষ্ট পলল স্তর খুজে পাওয়া কিছুটা কষ্টসাধ্য।
  • প্রাচীন জীবগুলির মধ্যে যারা নিজেদের কোনো পরিবর্তন না করে কয়েক মিলিয়ন বছর বেঁচে থাকে, তাদের তাপমাত্রা সহজেই নির্ণয় করতে হয়
  • হিমবাহের সাথে সম্পর্কিত জীবাশ্ম অনুসন্ধান

(তথ্যসূত্রঃ Christian (2010). “Glacier advance in southern middle-latitudes during the Antarctic Cold Reversal”)

চিত্রঃ ৯৩০০ বছর পুরোনো প্রাণী

বিভিন্ন অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও, আইস কোর এবং সমুদ্রের পলল বিশ্লেষণ করে বিগত কয়েক মিলিয়ন বছর ধরে পর্যায়ক্রমে হিমবাহ এবং আন্তঃবিজ্ঞানগুলির বিভিন্ন তথ্য দেখিয়েছে। এগুলি বরফ যুগ এবং মহাদেশীয় ক্রাস্ট ইভেন্টগুলির মধ্যে যেমন গ্লাসিয়াল মোরাইনস, ড্রামলিনস এবং গ্লাসিয়াল ইরেটিক্স বিষয়গুলির মধ্যে যোগসূত্রটিও নিশ্চিত করে। মহাদেশীয় ভূত্বকগুলির ঘটনাটি পূর্বের বরফযুগের ভাল প্রমাণ হিসাবে স্বীকৃত হয়, যখন সেগুলি বরফের সমুদ্রের সাথে এবং সমুদ্রের পললিক শিলার মধ্যে উপলব্ধ সময় সীমার তুলনায় অনেক আগে তৈরি স্তরগুলিতে পাওয়া যায়।

পরবর্তী পর্বে আসবো কিছু বরফযুগের ইতিহাস নিয়ে আর সাথে থাকবে হিমশীতল কিছু তথ্য। ততক্ষণ পর্যন্ত, আল্লাহ হাফেজ।

Comments are closed.