চাঁদে পড়ছে মরিচা; পানি এবং অক্সিজেন ছাড়াই!

চাঁদ মামা, আমাদের সবচেয়ে কাছের মহাজাগতিক বস্তু এবং সৌরজগতের মধ্যে একমাত্র কোনো স্থান যেখানে পৃথিবীর বাইরে গিয়ে মানুষ পা রেখেছে। স্বাভাবিক ভাবেই আমরা জানি চাঁদে কোনো বায়ু নেই, নেই কোনো অক্সিজেন বা পানি। এরই মধ্যে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করলেন ধীরে ধীরে মরিচা পড়ছে উপগ্রহটিতে।

সম্প্রতি চাঁদে পাওয়া গেছে হেমাটাইটের অস্তিত্ব যা বিজ্ঞানীদের খুব অবাক করেছে। হেমাটাইট হচ্ছে লৌহের একটি আকরিক যা তৈরি হওয়ার জন্য প্রয়োজন পানি এবং বাতাসের অক্সিজেন উভয়কেই। চাঁদে প্রতিনিয়তই সৌর বায়ুর হাইড্রোজেনের আঘাতে বিস্ফোরণ হয়। একধরনের রিডিউসিং এজেন্ট রয়েছে যার ধর্ম ইলেক্ট্রন প্রদান করা সেসব বস্তুকে যেগুলোর সাথে এজেন্ট টি বিক্রিয়া ঘটায়। অক্সিডাইজেশন বা জারন ঘটে ইলেক্ট্রন হারানোর মাধ্যমে। সুতরাং যদি জারণ ঘটার জন্য সব ধরনের বস্তু বা উপাদান উপস্থিত থাকেও , তবুও সৌর বায়ুর কারণে তা বাধাগ্রস্ত হবে। ইউনিভার্সিটি অফ হাওয়াই এর প্রফেসর শিউ লাই এর কাছে বিষয়টা খুবই ধাঁধার মত যে চাঁদেও এমন চরমভাবাপন্ন পরিবেশে হেমাটাইট গঠিত হতে পারে।

ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার অরবিটার চন্দ্রায়ন ১ এর পাঠানো উপাত্ত থেকে হেমাটাইট সম্পর্কিত তথ্যে নিশ্চিত হওয়া যায়। চাঁদের খনিজ অনুসন্ধান মানচিত্র যা নকশা করে নাসার জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরি। সেখানে হাইপার স্পেক্ট্রাল ইমেজিং এর মাধ্যমে চাঁদের মাটির স্পেক্ট্রোস্কোপিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে একেবারে সূক্ষ্ম ধূলিকণারও যৌগ সম্পর্কে জানা যায়। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে লাই এবং তাঁর সহকর্মীরা ২০১৮ সালে চাঁদের মেরুতে গলিত বরফের সন্ধান পান! কিন্তু উপাত্ত গুলো পরীক্ষণের সময় লাই অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ্য করেন। তিনি জানান যে ডাটা গুলো বিশ্লেষণের সময় সচরাচর যেরকম মান আসার কথা সেরকম না এসে স্পেক্ট্রোমিটারে ভিন্নতর কিছু প্যাটার্ন দেখা যায়। তিনি ভাবেন হয়ত সেখানে পানি এবং চাঁদের পাথরের মধ্যে হওয়া কোনো বিক্রিয়ার ফল। কিন্তু মাস খানেক গবেষণার পর বুঝতে পারেন এখানে লোহার আকরিক হেমাটাইটের উপস্থিতি রয়েছে। এর থেকেও বিস্ময়কর ব্যাপার হলো কীভাবে এই হেমাটাইট এখানে আসল? কীভাবে সেটা উৎপন্ন হলো! তবে হেমাটাইটের বিস্তৃত অবস্থা বা ছড়িয়ে পড়ার ধরণ দেখে কিছু হলেও ধারণা করা যায় কীভাবে সেগুলো অস্তিত্বমান হলো। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে বরফ বা গলিত বরফের অস্তিত্ব চাঁদের বুকে পাওয়া গিয়েছে সেগুলো ভূ-গর্ভস্থ ম্যাগমা এর সাথে মিথস্ক্রিয়ায় লিপ্ত হয়েছিল এবং বিভিন্ন রকমের গ্রহাণুপিণ্ড বা উল্কার আঘাতের সময় সেখানে বিক্রিয়া সংঘটিত হয়।

আবার আরেকটি মজার ব্যাপার হলো হেমাটাইট সেই অংশটাতে পাওয়া যায় চাঁদের যে দিকটা পৃথিবীর দিকে মুখ করে আছে! এমনও হতে পারে এটা পৃথিবীর সাথে কোনোরকম ভাবে সম্পর্কিত। এই ঘটনাটি মনে করিয়ে দেয় জাপানের কাগুয়া মিশনের কথা যেখানে আবিষ্কৃত হয় এই ব্যাপারটি যে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল থেকে প্রচুর অক্সিজেন সৌরবায়ুর মাধ্যমে চাঁদে যেতে পারে! হয়ত এই ব্যাপারটি হেমাটাইট তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা রাখার সম্ভাবনা প্রবল। যখন পূর্ণ চন্দ্র দেখা যায় তখন চাঁদ পৃথিবীর ম্যাগনেটোস্ফিয়ারের সাথে প্রবল আকর্ষণে লিপ্ত হয়। পৃথিবীর ম্যাগনেটোস্ফিয়ার তখন সূর্যের দিক থেকে সরে যায় এবং প্রায় ৯৯ শতাংশ সৌর বায়ুই বাধাপ্রাপ্ত হয় চাঁদের দিকে যাওয়ার সময়। এই অবস্থায় হাইড্রোজেনও উপস্থিত থাকেনা অক্সিজেনের জারন বিক্রিয়ায় বাঁধা প্রদানের জন্য। দেখা যায় এই অক্সিজেন, পানি এবং মাসের এই সময়ের ত্রিমিলনে ধীরে ধীরেই তৈরি হয় মরিচা যা কয়েক বিলিয়ন বছর পর্যন্তও চাঁদে পাওয়া যাবে! কিন্তু এর মানে এই না যে এই রহস্যের সমাপ্তি ঘটল। কারণ শুধুই যে পৃথিবীর দিকে হেলে থাকা অংশে হেমাটাইটের উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছে এমন না, যে পাশ টা কখনো পৃথিবীর দিকে পাশ ফিরে ছিল না সেখানেও এর অস্তিত্ব রয়েছে। এই জায়গায় অক্সিজেন পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব।

বিজ্ঞানীরা এখনও সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সম্পূর্ণ মরিচা রহস্যটির খোলাসা করার জন্য। তবে একটা বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে, সেটা হলো যেহেতু এই মরিচা গুলো যুগের পর যুগ টিকে থাকে এদের মধ্যে থাকা অক্সিজেন আইসোটোপ হিসেবে রয়ে যায়। সেই আইসোটোপের ডেটিং করেও কিন্তু আমরা জানতে পারব অনেক কাল আগে আমাদের পৃথিবীর কী রকম ভৌগলিক অবস্থা ছিল ইত্যাদি বিষয়ে। তাছাড়াও এটা জানা যাবে মরিচা ধরানোর পাশাপাশি চাঁদের অবকাঠামো এবং বর্তমান পরিবেশ তৈরিতে পৃথিবী কতটা সক্রিয় ভূমিকা পালন করে এসেছে।

তথ্যসূত্রঃ Science Advances

Comments are closed.