সূর্য থেকে দূরত্বের দিকে সপ্তম গ্রহটি হচ্ছে ইউরেনাস। গ্রহটিকে খালি চোখেই দেখা যায় রাতের আকাশে। তবে মজার ব্যাপার হলো অনেক দীর্ঘ সময় থেকে ইউরেনাসকে সবাই ভেবে আসছিলেন একটি নক্ষত্র! কারণ হচ্ছে এর অতি ধীর সঞ্চারপথে আবর্তন এবং ম্রিয়মাণ আলো। তাছাড়াও ইউরেনাসের অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যের একটি হচ্ছে নাটকীয় হেলানো অক্ষ সমূহ। এর ফলে গ্রহটির অক্ষ বিন্দু সরাসরি সূর্যের দিকে মুখ করে আছে। ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী উইলিয়াম হার্শেল ১৭৮১ সালের ৩১ শে মার্চ ইউরেনাস আবিষ্কার করেন নিজের টেলিস্কোপ দ্বারা। তিনি জরিপ চালাচ্ছিলেন সেসব নক্ষত্রের উপর যারা সাধারণ খালি চোখে দৃশ্যমান তারা থেকে দশ গুণ বেশি অনুজ্জ্বল। একটি নক্ষত্রে কিছু ব্যতিক্রম লক্ষ্য করেন এবং এক বছরের মধ্যে খেয়াল করেন সেটি কক্ষপথ কে ঘিরে ঘুরছে এবং ঘোষণা দেন মহা আবিষ্কারের! ইউরেনাসের নামকরণ করা হয় গ্রীক আকাশ দেবতা Ouranos এর নামে। এটাই একমাত্র গ্রহ যার নাম দেয়া হয় কোনো গ্রীক দেবতার নামে যেখানে অন্য সব গ্রহের নাম রোমান দেবতাদের নামে দেয়া হয়েছে। অনেক ধরনের দেবতার নামে প্রস্তাব করা হয় ইউরেনাসের নাম রাখার জন্য কিন্তু শেষমেষ জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী জোহান বোড যে ইউরেনাসের কক্ষপথের বিস্তৃতি দেখিয়েছিলেন তিনি ইউরেনাম নামে নামকরণ করেন।

(Image: © NASA and Erich Karkoschka, U. of Arizona)
ইউরেনাসের রঙ হচ্ছে নীল-সবুজ। এর কারণ হচ্ছে হাইড্রোজেন হিলিয়াম পূর্ণ বায়ুমণ্ডলে মিথেনের উপস্থিতি। এটিকে বলা হয় বরফ দানব কারণ ইউরেনাসের প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকাই পানি, ইউরিয়া ও মিথেন মিশ্রিত বরফের তৈরি। ইউরেনাস নিজ কক্ষপথে এতটাই হেলানো যে গ্রহটি পার্শ্ব দিয়ে সূর্যের দিকে মুখ করে প্রদক্ষিণ করে। এর কারণ হচ্ছে যখন ইউরেনাস গঠিত হত সে সময়ই হয়ত বিশাল কোনো গ্রহাণুপিণ্ড একে আঘাত করে এবং ফলস্বরূপ ঘূর্ণ ও অক্ষে আসে পরিবর্তন। ২০১৮ সালের একটি গবেষণাপত্রে দেখানো হয় যার মাধ্যমে এ সংঘর্ষ হয়েছিল সেটি হয়ত পৃথিবী থেকেও আকারে দ্বিগুণ! অস্বাভাবিক এই হেলে যাওয়ার কারণে ইউরেনাসে লক্ষ্য করা যায় চরমভাবাপন্ন ঋতু যা প্রায় ২০ বছর ধরে স্থির থাকে যা প্রায় ৮৪ পৃথিবীর বছরের সমান। সূর্য শুধু মাত্র মেরুর উপরে উদিত হয় এবং গ্রহের বাকি অংশ দীর্ঘ একটা সময় ধরে অন্ধকারে থাকে। শুধু তাই নয় এখানে তাপমাত্রাও প্রচন্ড নিম্নে থাকে। ইউরেনাসের বায়ুমণ্ডল সৌরজগতের অন্য সব গ্রহের তুলনায় অত্যন্ত ঠান্ডা যদিও এটি সূর্য থেকে সবচেয়ে দূরবর্তী গ্রহ নয়। এর কারণ হচ্ছে ইউরেনাসের অভ্যন্তরীন তাপ সংরক্ষণ ব্যবস্থা অতি সীমিত বা নেই ই।

কোনো গ্রহের চৌম্বকীয় ক্ষেত্রে সবসময় অক্ষের সাথে সংযুক্ত থাকে যখন গ্রহটি ঘুরে। কিন্তু ইউরেনাসের বেলায় তা ব্যতিক্রম এবং হেলানো! চৌম্বক ক্ষেত্রটি এক্সিস অফ রোটেশন বা ঘূর্ণন অক্ষ থেকে ৬০ ডিগ্রি দূরবর্তী অঞ্চলে অবস্থান করছে। এতে উত্তর গোলার্ধ্ব থেকে দক্ষিণ গোলার্ধ্বে চৌম্বক ক্ষেত্র ১০ গুণ বেশি শক্তিশালী দেখা যায়। ২০১৭ সালের একটি অনুসন্ধানে বলা হয় এমন ভারসাম্যহীন চৌম্বক ব্যবস্থার ফলে ইউরেনাসের স্বীয় অক্ষে আবর্তনের(১ দিন= ১৭.২৪ ঘন্টা) সময় প্রচন্ড ঝাঁকুনি অনুভূত হয়।
ইউরেনাসের বায়ুমণ্ডলে আয়তনের প্রায় ৮২ শতাংশ হচ্ছে হাইড্রোজেন, ১৫ শতাংশ হিলিয়াম এবং ২ শতাংশ মিথেন। গ্রহের অভ্যন্তরীণ কাঠামো পানি এমোনিয়া অ মিথেনের বরফ দ্বারা আবৃত। কেন্দ্রে রয়েছে লৌহ এবং ম্যাগনেসিয়াম সিলিকেটের যৌগ। সূর্য থেকে ইউরেনাসের গড় দূরত্ব প্রায় ৩ বিলিওন কিলোমিটার যা পৃথিবীর দূরত্বের ১৯ গুণ!

(Image: © Imke de Pater (UC Berkeley)/Keck Observatory)
অস্বাভাবিক অক্ষীয় হেলানের কারণে ইউরেনাসের চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া দেখা যায়। আগেই বলা হয়েছে ইউরেনাসের বেশিরভাগ এলাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে, সেগুলোতে যখন প্রথম বারের মত সূর্য রশ্মি আসে তখন এক বিশাল সাইক্লোনের উৎপত্তি হয়। যখন ভয়েজার ২, ১৯৮৬ সালে ইউরেনাসের দক্ষিণ মেরুর উপর দিয়ে অতিক্রম করার সময় ছবি তোলে, সেখানে দেখা যায় বরফাবৃত মেঘের এক বিশাল কুণ্ডলী এবং কোনো ভাবেই তখন ইউরেনাসের পৃষ্ঠ ভালোভাবে দেখা যায়নি। ২০১৪ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সেই গ্রীষ্মকালীন ঝড়টির দেখা পান। সবচেয়ে রহস্যের বিষয়টি হচ্ছে সূর্যের আলোর কারণে কেন এই বিশাল ঝড়টি ইউরেনাসের বুকে তৈরি হয়। ইউরেনাসের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর হীরক বৃষ্টি! প্চরণ্ড তাপ এবং চাপে ভূমির প্রায় হাজার কিলোমিটার নিচের বরফ শিলা গুলো নিজের হাইড্রোকার্বন আলাদা করে দেয়। ঠিক তখনই কার্বন প্রচণ্ড চাপে সংকুচিত হয়ে হীরকের পরিণত হয় এবং গ্রহের আরো গভীরে সেগুলো যাত্রা করে। যে পরীক্ষাটি করা হয়েছে সম্পূর্ণ ঘটনাটি অনধাবন করার জন্য তা সংঘটিত হয় SLAC National Accelerator Laboratory তে। সেখানে ব্যবহার করা হয় উন্নত প্রযুক্তির Linac Coherent Light Source(LCLS) যা একপ্রকার অতি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন এক্সরে লেজার। এটির মাধ্যমে দেখা যায় কার্বন সরাসরি হীরক ক্রিস্টালে পরিণত হয়ে যায়!LCLS এর পরিচালক এবং একজন প্লাজমা পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে Mike Dunne জানান যে তাদের অনুসন্ধানটি এমন একটা ঘটনার উপাত্ত দিয়েছে যার প্রসেসড মডেল তৈরি করা খুব কঠিন। অর্থাৎ হাইড্রোকার্বন ভেঙে কার্বনের হীরক হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা বিশ্লেষণ করা একটু জটিল বটে। এখানে এটাই দেখার বিষয় যে কীভাবে সেগুলো যৌগ অবস্থায় থাকে এবং কীভাবেই বা আবার সঠিকভাবে আলাদা হয়ে যায় মিশ্রিত অবস্থা থেকে। সহজে উপস্থাপনের জন্য ব্যাপারটিকে খাবার মায়োনিজের সাথে তুলনা করা যায়। এখান এটাই দেখা হবে যে কীভাবে সেই মায়োনিজ থেকে পুনরায় তেল এবং ভিনেগার ফেরত পাওয়া যাবে।
ইউরেনাসেরও রয়েছে বলয়! শনি গ্রহের পর পরই আবিষ্কৃত হয় ইউরেনাসের বলয়। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি আবিষ্কার ছিল কারণ বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছিলেন বলয় থাকাতা গ্রহদের জন্য স্বাভাবিক, এটি কেবলমাত্র শনির কোনো আলাদা বৈশিষ্ট্য নয়। ইউরেনাসের ২ সেট বলয় রয়েছে। ভেতরের বলয় গুলো খুব অনুজ্জ্বল এবং বেশিরভাগই অন্ধকার। তবে বাহিরের বলয় দুটি মোটামুটি ভাবে আলোকিত ও রঙীন। একটি লাল অপরটি নীল এবং এরা যথেষ্ট সামাজিক দূরত্বে একে অপরের থেকে অবস্থিত। হাবল স্পেস টেলিস্কোপ এগুলো আবিষ্কার করে। তাছাড়াও বিজ্ঞানীরা আরও তেরোটি অজানা বলয় এর অস্তিত্ব নিশ্চিত করেন ইউরেনাসে। ২০১৬ সালের একটি গবেষণা দেখায় ইউরেনাস, শনি অ নেপচুনের বলয় সৃষ্টির আসল কারণ হচ্ছে বামন গ্রহের ধ্বংসাবশেষ। একসময় বামন গ্রহ গুলো এই দানবদের অনেক কাছে অবস্থান করত এবং মহাকর্ষের প্রবল শক্তিতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে গ্রহের বলয় হিসাবে অবস্থান করছে।

ইউরেনাসের আছে ২৭ টি উপগ্রহ। গ্রীক দেবতাদের নামে নামকরণ না করে ইউরেনাসের প্রথম চারটি উপগ্রহকে নামকরণ করা হয় ইংরেজী সাহিত্যের জাদুর চরিত্র থেকে। এ ক্ষেত্রে শেক্সপিয়ার এবং পোপের সাহিত্যকর্ম থেকে এগুলো বাছাই করা হয়। অবেরন এবং টাইটানিয়া হচ্ছে সবচেয়ে বর ইউরেনিয়ান উপগ্রহ। এগুলো ১৭৮৭ সালে উইলিয়াম হার্শেল আবিষ্কার করেন। উইলিয়াম লাসেল বাকি ২ টা উপগ্রহ আবিষ্কার করেন। ১৯৮৬ সালে ভয়েজার ২ আরো ১০ টি উপগ্রহ আবিষ্কার করে যেগুলোর ব্যাস মাত্র ২৬-১৫৪ কিলোমিটার; জুলিয়েট, পাক, কর্ডেলিয়া, অফেলিয়া, বিয়ানিকা, ডেসডেমনা, পোর্শিয়া, রোসালিন্ড, ক্রেসিডা এবং বেলিন্ডা। এই উপগ্রহ গুলো অর্ধেক পাথুরে অর্ধেক বরফের তৈরি। এরা এতই ক্ষুদ্র এবং দূরবর্তী যে হাবল টেলিস্কোপের জন্য অবস্থান খুঁজে বের করা খুবই কঠিন কাজ।কর্ডেলিয়া অফেলিয়া এবং মিরিন্ডার মাঝে আরো অনেক গুলো ছোটো ছোটো উপগ্রহ আছে যা এখনও আবিষ্কার সম্ভব হয়নি এবং বিজ্ঞানীরা চেষ্টা চালাচ্ছেন বের করতে কীভাবে সেগুলো এরকম জায়গায় আসল। উপগ্রহের মতো ইউরেনাসের কিছু ট্রোজান গ্রহাণুপিণ্ড আছে যারা একই কক্ষপথে আবর্তন করে গ্রহের সাথে। এরকম একটি সম্ভাব্য জায়গা হচ্ছে Lagrange Point।
নাসার ভয়েজার ২ হচ্ছে প্রথম এবং একমাত্র মহাকাশযান যা ইউরেনাসে ভ্রমণ করেছে। যদিও জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কোনো পরিকল্পনা নেই বর্তমানে ইউরেনাসের জন্য অন্য কোনো যান পাঠানোর তবে তাঁরা প্রতিনিয়তই হাবল টেলিস্কোপ থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্য ও উপাত্ত নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। ২০১১ সালে প্লানেটারি সার্ভে কমিশন সুপারিশ করেছিল নাসা কে এই বরফ গ্রহটিতে মিশন পরিচালনা করার জন্য। ২০১৭ সালে নাসা বিভিন্ন অনুসন্ধান থেকে প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক আশা ব্যক্ত করে ইউরেনাসে মিশন সম্পর্কিত। সেটা হতে পারে কোনো ফ্লাইবাই অথবা এমনও হতে পারে ইউরেনাসের বায়ুমণ্ডল এ ল্যান্ড করা কোনো ক্রাফট। ২০১৯ সালে নাসার গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টার একটি মডেল তুলে ধরে বায়ুমণ্ডলে প্রব পাঠানোর ডিজাইন নিয়ে। এটি বৃহস্পতিতে পাঠানো প্রবের মতোই হুবহু যা গ্যালিলিও মিশনে ব্যবহৃত হয়েছিল। ২০১৮ সালে নাসার বিজ্ঞানী এবং ইঞ্জিনিয়াররা একটি তাত্ত্বিক মিশন তৈরি করেন ইউরেনাসের জন্য যাতে খরচ হবে প্রায় ১ বিলিওন মার্কিন ডলার। তাছাড়াও একটা গ্রহজনিত সংযুক্তি ঘটবে ২০৩০ সালের দিকে যেখান থেকে ভালোই সুবিধা নেয়া যাবে ইউরেনাসের যাওয়ার ক্ষেত্রে। এই স্বল্প বাজেটের মিশন খুব আহামরি না হলেও হয়ত আরো বিষদভাবে আমাদেরকে জানার সুযোগ করে দিবে অল্প পরিচিতি গ্রহটিকে!

তথ্যসূত্রঃ NASA, Space.com