বিজ্ঞানের অপার সম্ভাবনা: টাইম ট্রাভেল

মানবজীবনে সবচেয়ে মূল্যবান যে বিষয়টিকে ধরা হয়, তা হচ্ছে সময়। মানুষ সময়কে থামিয়ে রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে বহুকাল আগে থেকেই। কিন্তু তাদের এই প্রচেষ্টা সম্পূর্ণই ব্যর্থ। আজ অবধি সময়কে থামিয়ে রাখতে পারে এমন  কোনো রোবট কিংবা যন্ত্র আবিষ্কার হয় নি। তবে বিজ্ঞানীরা আভাস দিচ্ছেন এক নতুন সম্ভাবনার, আর তা হচ্ছে সময় ভ্রমণ বা টাইম ট্রাভেল। অতীত কিংবা ভবিষ্যৎ থেকে ঘুরে আসার ইচ্ছা কিন্তু আমরা সকলেই পোষণ করি। প্রত্যেকেই কোনো না কোনো সময় ভাবি যদি অতীত/ভবিষ্যৎ থেকে ঘুরে আসতে পারতাম! ভবিষ্যতে আমাদের অবস্থা কেমন হবে? অতীতেই বা কেমন ছিলো? এ ধরনের প্রশ্ন কিন্তু আমাদের সকলেরই মনে জাগে। তবে অনেক বিজ্ঞানীর মতেই আমাদের এই ইচ্ছা খুব শীঘ্রই পূরণ হতে পারে। অর্থাৎ আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ কিংবা অতীত থেকে ঘুরে আসতে পারবো। এখন সবার মনেই প্রশ্ন জাগছে কিভাবে??

প্রথমেই বুঝার চেষ্টা করি টাইম ট্রাভেল বিষয়টা কি??

মূলত এক সময় থেকে অন্য সময়ে পরিভ্রমণকে আমরা টাইম ট্রাভেল বা সময় ভ্রমণ বলে থাকি। প্রকৃতপক্ষে এটি হচ্ছে সময়ের অক্ষ বরাবর ভ্রমণ। ছোটবেলা থেকেই তিনটি মাত্রার সাথে আমরা অনেক পরিচিত। এই তিনটি মাত্রা হচ্ছে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা। এই তিনটি মাত্রা বরাবর স্থান পরিবর্তন সম্ভব। তবে ন্যূনতম চতুর্মাত্রিক একটি ধারণা হচ্ছে সময়ের ধারণা। আজ পর্যন্ত এই চতুর্থ মাত্রা দিয়ে স্থান পরিবর্তন সম্ভব হয়নি। এই সময়ের অক্ষ বরাবর স্থান পরিবর্তনকে কালমাত্রিক সরণ বলা হয়। এটি হতে পারে অতীতে ভ্রমণ, হতে পারে ভবিষ্যতে ভ্রমণ। বর্তমান পদার্থবিদ্যায় সময় ভ্রমণ একটি অন্যতম রহস্যময় বিষয়, তাই এই ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা একদমই বসে নেই।

টাইম ট্রাভেল কি আদৌ সম্ভব: সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের মতে টাইম ট্রাভেল সম্ভব। তার অন্যতম সৃষ্টি থিওরি অব রিলেটিভিটি অনুসারে কোনো বস্তু যখন আলোর গতিতে চলবে তখন তা হয়ে যাবে ভরশূন্য। আর যদি আলোর গতিতে চলে যায় তবে সময় স্থির হবে, মানে টাইম ট্রাভেল হবে। বিষয়টি আরেকটু ক্লিয়ার করি, আমরা সবাই জানি আলোর বেগ সর্বাধিক। এখন যদি কেউ আলোর বেগে অথবা আলোর সমান বেগের কোনো মহাকাশযানে অন্য কোন গ্রহের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো এবং সমবেগে মহাকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত ঘুরে বেড়ালো। তারপর পৃথিবীতে এসে দেখলো যে কয়েকশো বছর কেটে গেছে, কিন্তু তার কাছে সেটা মনে হয়েছিলো অল্প কিছু সময়। তার মানে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা অনুযায়ী তাত্ত্বিকভাবে সময় ভ্রমণ সম্ভব।

এবার চলুন ব্ল্যাকহোলের মাধ্যমে সময় ভ্রমণ সম্ভব কিনা? সেটা জানি: ব্ল্যাকহোল কিংবা কৃষ্ণবিবর হচ্ছে তারার দুর্দশাপূর্ণ একটি অবস্থা। ব্ল্যাকহোল প্রতিটি বস্তুকেই তার নিজের দিকে টেনে নেয়। শুধু যে টেনে নেয় তাও কিন্তু নয়। এর টানার ক্ষমতা এতোই বেশী যে, কোনো বস্তু এর নির্দিষ্ট সীমার ভিতরে চলে গেলে, আর তা ফিরিয়ে আনা সম্ভবপর হয় না। যার ফলে আলো এটিকে বেদ করে বাইরে আসতে পারে না। এখন আপনি যদি কোনো মহাকাশযান নিয়ে ব্ল্যাকহোলের আশপাশে ভ্রমণ করতে থাকেন আর অন্য একটি মহাকাশযান যদি পৃথিবীর চারদিকে ভ্রমণ করতে থাকে তবে ব্ল্যাকহোল ভ্রমণকারীর বয়স, পৃথিবীর চারপাশে ঘোরা ব্যক্তির বয়সের অর্ধেক হবে। অর্থাৎ ব্ল্যাকহোলের মাধ্যমে সময় ভ্রমণ পসিবল।

তবে টাইম ট্রাভেলকে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশী সমর্থন করে, সেটি হচ্ছে ওয়ার্মহোল। একটা বিষয় সম্বন্ধে আমাদের অবগত থাকা  প্রয়োজন, আর তা হচ্ছে স্পেস বা মহাশূন্যের পথ কখনোই সমতল নয়। অর্থাৎ এটি বাঁকা পথে চলে। তাই আলো যখন মহাশূন্যের ভেতর দিয়ে ভ্রমণ করে, তখন এই বাঁকানো স্পেসের ভেতর দিয়ে একটি বাঁকানো পথে চলতে বাধ্য হয়। কিন্তু এই বাঁকা পথের পাশাপাশি আরও একটি সংক্ষিপ্ত রাস্তাও আছে। এই সংক্ষিপ্ত পথই হচ্ছে ওয়ার্মহোল। তাই আপনি যদি ওয়ার্ম হোলের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করেন, তাহলে মহাকাশ পরিক্রমণে আপনার আরো কম সময় লাগবে।

তবে টাইম ট্রাভেলের মাধ্যমে অতীতে ফিরে যাওয়ার মধ্যে রয়েছে কিছু শঙ্কা। কিছু বিষয় আছে, যেগুলো টাইম ট্রাভেলের মাধ্যমে অতীতে পরিক্রমণ করার মধ্যে কিছুটা অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। এগুলোকে টাইম ট্রাভেল প্যারাডক্স (Time Travel Paradox) বলা হয়। সবচেয়ে বহুল পরিচিত প্যারাডক্স হচ্ছে গ্র‍্যান্ডফাদার প্যারাডক্স।

গ্র‍্যান্ডফাদার প্যারাডক্স: ধরুন আপনি কোনো টাইম মেশিনের মাধ্যমে ৫০ বছর আগের সময়ে চলে গেলেন। আর সেখানে গিয়ে আপনি নিজের দাদা-দাদীকে হত্যা করে ফেললেন ( যদিও আপনি এটা করবেন না )। তাহলে ব্যাপারটি কি দাঁড়াবে? এর ফলে তো আপনার বাবারই জন্ম হওয়ার কথা না! তাহলে আপনি কোথা থেকে আসবেন? এই বিষয়টি আপনার পুরো টাইম ট্রাভেলটিই বৃথা করে দিবে। এ ধরনের ঘটনাগুলোই টাইম ট্রাভেল প্যারাডক্স হিসেবে পরিচিত।

এখন জেনে নেয়া যাক টাইম ট্রাভেলের সাথে সম্পৃক্ত পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া এমন কিছু অদ্ভুত ঘটনা, যেগুলোর কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ বা ব্যাখ্যা আজ পর্যন্ত পাওয়া যায় নি।

(ইন্টারনেটে আলোচিত কিছু টাইম ট্রাভেলারের ছবি)

প্রথমেই আপনাদেরকে জানাবো ১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ রয়েল এয়ারফোর্সের এয়ারমার্শাল ভিক্টর গাড্ডার্ড ( Sir Robert Victor Gaddard) এর সাথে ঘটে যাওয়া একটি বাস্তব ঘটনা। ১৯৩৫ সালে তিনি যখন তার বিমানটি নিয়ে আকাশে উড়লেন, তখন বেশ অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলেন। তিনি যখন স্কটল্যান্ড থেকে ইংল্যান্ডের এন্ডোবারে যাত্রা করছিলেন, তখন ইডেনবার্গ  থেকে কিছুটা দূরে ড্রেম নামে একটি পরিত্যক্ত এয়ারফিল্ডের উপর দিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন। এককালে যেখানে বিমান উঠা-নামা করতো, কিন্তু এখন জায়গাটি সম্পূর্ণই পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। উক্ত জায়গাটির উপর দিয়ে ভিক্টর গাড্ডার্ড যখন বিমান নিয়ে এগিয়ে চলছিলেন, তখন হঠাৎ এক অদ্ভুত ঝড়ের সম্মুখীন হলেন। বাদামী-হলুদ রঙের মেঘের মাঝে হারিয়ে যেতে লাগলো তার বিমান। যার ফলে তিনি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললেন, তীব্র গতিতে বাক খেতে খেতে তার বিমানটি দ্রুত মাটির দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। কোনোভাবে সে বিমানটি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন, এবং অদ্ভুতভাবে লক্ষ করলেন ইতিমধ্যে ঝড়ও বন্ধ হয়ে গেছে এবং তার বিমানটি সেই পরিত্যক্ত এয়ারফিল্ডের দিকে এগিয়ে চলছে। কিন্তু তারপর ঘটলো আরো অদ্ভুত এক ঘটনা, তিনি দেখলেন এয়ারফিল্ডটি আর পরিত্যক্ত নেই, সেখানে চারটি বিমান রাখা আছে। এবং বিমানগুলো ছিলো ভিক্টরের অত্যন্ত পরিচিত। আরো একটি অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে এসকল বিমানের গাঁয়ে ছিলো পুরনো আমলের রঙ। ভিক্টর যখন মাটিতে নামলেন তখন আরো বিস্মিত হলেন। তিনি লক্ষ করলেন সেখানকার বিমান রক্ষণাবেক্ষণে নিয়োজিত কর্মীরা ভিক্টর বাহিনীর দিকে বিন্দুমাত্র মনোযোগ দিচ্ছে না, যেন পুরো ব্যাপারটি তাদের চোখেই পড়ে নি। তারা নিজেদের মতো কাজ করে যাচ্ছিলো। তারপর ভিক্টর যখন সেই এয়ারফিল্ড ত্যাগ করলেন, তখন আবার প্রচণ্ড ঝড় শুরু হলো। অবশেষে তিনি নিরাপদেই তার গন্তব্যে ফিরে আসতে সক্ষম হলেন। এরপর ১৯৩৯ সালে ব্রিটিশ রয়েল এয়ারফোর্সের বিমানগুলো হলুদ রং করা হয়, এবং কর্মীদের পোশাকের রং হয় নীল। অর্থাৎ ভিক্টর ১৯৩৫ সালে ঠিক যেভাবে, যেরকম অবস্থায় বিমানগুলো এবং কর্মীদেরকে দেখেছিলো, ১৯৩৯ সালে পুরো ব্যাপারটা সেরকমই করা হয়। তাহলে কি ভিক্টর কিছু সময়ের জন্য ১৯৩৫ সাল থেকে ১৯৩৯ সালে চলে গিয়েছিল![ তথ্যসূত্র ]

এবার আপনাদের শুনাবো অতীত আর বর্তমানের ঘূর্ণিতে আটকে যাওয়া এক তরুণীর গল্প। এই ঘটনাটি সর্বপ্রথম জনসম্মুখে প্রকাশ করেন একজন ডক্টর নাম রল রিয়স সেন্টেনো ( Raul Rios Centeno)। ঘটনাটি তারএক রোগীর সাথে ঘটেছিলো। তার ভাষ্যমতে ৩০ বছর বয়সী সেই তরুণীর দেহের একপাশ পুরোপুরি ভাবে প্যারালাইসেস হয়ে গিয়েছিল। তিনি পেরুর রাজধানী থেকে ৩৫ মাইল দূরে এক ফরেস্টে তার বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গিয়েছিলেন। রাতের বেলায় তিনি ও তার কয়েকজন বন্ধু অভিযানে বের হলে, কিছুদূর গিয়ে একটি কুটির দেখতে পান। যেখানে মিটমিট করে আলো জ্বলছিল এবং ভেসে আসছিল গানের শব্দ। তারা লক্ষ করলেন কুটিরের ভিতরে গানের তালে তালে কয়েকজন নাচ্ছে। তারা আরেকটু কাছে যেতেই দেখলো, সেখানে যারা নাচছিলেন তাদের প্রত্যেকের গাঁয়েই সতেরশো শতকের পোশাক। সেই তরুণীটি যে-ই কক্ষে প্রবেশ করতে যাচ্ছিলেন হঠাৎ করেই তার এক বন্ধু পিছন থেকে হাত টেনে ধরেন, আর সাথে সাথেই তার দেহের একটি অংশ অবশ হয়ে যায়। এরকম কেনো হলো??? সেই কুটির আর তরুণীটি কি ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা বা সময়ে অবস্থান করছিল?? নাকি তার বন্ধু পিছন থেকে টান দেয়ার কারণে তিনি দুই সময়ের মধ্যে আটকে গিয়েছিলেন?? বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে দেখা যায় যে এই তরুণীর মস্তিষ্কের বামদিকের অংশটিও কাজ করছে না, আর সেখানে অসংখ্য বৈদ্যুতিক সংকেতের আদান-প্রদান হচ্ছিল। [তথ্যসূত্র:]

পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া এ সমস্ত ঘটনাগুলো এখন পর্যন্ত প্রচুর আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকেই ঘটনাগুলো সত্যি বলে দাবী করছেন। অনেকেই আবার বলছেন এগুলো ডাহা মিথ্যে কথা। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ ঘটনাগুলো আসলেই সত্যি নাকি আসলেই মিথ্যা সে ব্যাপারে কোনো জোড়ালো প্রমাণ পাওয়া যায় নি। তাহলে কি টাইম ট্রাভেল সম্ভব? তবে কি এমন একটা সময় আসবে যখন আমরা সময় পরিক্রমণ করে অতীত কিংবা ভবিষ্যৎ এ চলে যেতে পারবো? অপেক্ষায় রইলাম সেই সুদিনের!

Whitehole সম্পর্কে জানতে চাইলে দেখে নিন এক নজরে

শ্বেত বিবর বা হোয়াইট হোল কি ?

Comments are closed.