টাইম ট্রাভেলঃ অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ (পর্ব-১)

একটা আইকিউ টেস্ট
একদা এককালে  বিখ্যাত একটি পত্রিকায় আইকিউ টাইপের একটা টেস্ট ছেপেছিল। সেখানে কার বুদ্ধিমত্তা বা চিন্তাধারা কেমন তা টেস্ট করার জন্য কিছু প্রশ্ন ছিল, সাথে এর উত্তর গুলোর বিস্তারিত মূল্যায়ন-ও  ছিল সেখানে। এর একটি প্রশ্ন ছিল এমন, ‘আপনাকে একটি টাইম মেশিন দেওয়া হল। এবং দিয়ে বলা হল যে, আপনি টাইম মেশিনে করে নিচের কোন সময়টাতে যেতে চান ? তাহলে আপনার উত্তর কি হবে?  

  •  ডাইনোসরের যুগে 
  •  সক্রেটিসের যুগে 
  •  মোঘল আমলে 
  •  বর্তমান সময়তেই থাকতে চান। 

বলা যদিও বাহুল্য নয়, আমি প্রবল উৎসাহে ‘ঘ’ অপশন টিকেই বাছাই করেছিলাম। আইকিউ শেষে ফলাফলে দেখা গেল, আমার আইকিউ ভয়াবহ মানের, এতই ভয়াবহ যে সেখানে সতর্কতা বাণী দেওয়া আছে, উক্ত রেঞ্জের মধ্যে অবস্থানকারী আইকিউ ধারীরা যেন মাছ মাংস প্রোটিন বেশি করে খায়।   

সে যা হোক, এই প্রশ্নের উত্তরে বেশি ইন্টেলিজেন্ট মানুষেরা ‘ক‘ বা ‘‘ বাছাই করেন, মধ্যমেরা ‘গ’ বাছাই করেন, আর যাহারা এর মধ্যে পড়েন না, তারা ‘‘ বাছাই করেন, এমনটাই উক্ত প্রশ্নের উত্তরের মূল্যায়ন। কারণ, ‘ঘ’ বাছাইকারীদের মধ্যে চার্ম বা থ্রিলার নামক অনুভূতি অনুপস্থিত। ইত্যাদি।  

অনেকদিন পরের কথা। আমার এক ‘নিরামিষভোজী’ বৈজ্ঞানিক প্রকৃতির বন্ধুর শরণাপন্ন হলাম। তার আইকিউ টেস্ট করার স্বার্থে আগ্রহ ভরে উক্ত প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করায়, বন্ধু আমার দু সেকেণ্ড ভেবে উত্তর করল, ‘ঘ’। বিজয়ীর হাসি হেসে তাকে মাছ মাংস প্রোটিন খাওয়ার পরামর্শ দিতে গিয়ে পড়লাম বিপদে। সে আমাকে তত্ত্বীয় ভাবে প্রমাণ করে দেখাল, কেন ‘‘ উত্তরদাতার আইকিউ বেশি। বন্ধু আমার অতি বুদ্ধিমান বিধায় তার কথা বুঝতে বেশ বেগ পেতে হয়। আমার আবার আবেগ বেশি, তাই আমি আপনাদের কাছে সহজ ভাষায় বিবৃত করি। 

টাইম ট্রাভেলিংঃ রূপক চিত্র

টাইম ট্র্যাভেল

যদিও প্রশ্নটি চিন্তা ও কল্পনা এবং মানসিক বাছাই এর সাথে সম্পর্কিত, তবুও আমরা নেহায়েত রসায়ন আর তর্কের খাতিরে বিজ্ঞানের দৃষ্টি থেকে দেখব। বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এখানে প্রথমেই যে বিষয়টির নাম চলে আসে তা হল ‘টাইম ট্রাভেল’- সময়ের পরিভ্রমণ। আসল বিষয় হল, আমরা টাইম ট্র্যাভল সবাই করি। আপনিও করছেন, কারণ আপনার সময় তো স্থির নয়। প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টা করে এগিয়ে চলছেন ভবিষ্যতের দিকে, অতীত হয়ে যাচ্ছে বর্তমান, থেকে যাচ্ছে আপনার স্মৃতি। তবে আপনি সময়কে পছন্দ মত ডোমিনেট করতে পারছেন না। তবুও, আপনি টাইম ট্র্যাভল করছেন প্রতিনিয়ত। কিন্তু আমাদের আলোচনার বিষয় মূলত এমন ভাবে সময়কে পরিভ্রমণ করা  নিয়ে, যাতে আমরা বর্তমানকে ছাপিয়ে যেতে পারি, সরাসরি বললে অতীত বা ভবিষ্যৎ -এর দিকে যাত্রা করতে পারি। আপনি কল্পনায় সময় পরিভ্রমণ করে হয়তো ফিরে যেতে পারবেন আপনার দাদীর সময়ে, হয়তো অংশ নিতে পারবেন ফরাসী বিপ্লবে, অথবা সিরাজউদ্দৌলাকে গিয়ে কানে ফিসফিস করে বলে দিয়ে আসতে পারবেন মীরজাফরের ষড়যন্ত্রের কথা। কিন্তু, এক মিনিট ! আদৌ এই  সময়গুলোর কোথাও আপনি কি সত্যিই যেতে পারবেন ?  আপনি সারেজমিনে অতীতের পথে যাত্রা করতে আদৌ পারবেন কীনা সেটা জানার আগে চলুন একটা খুন করে আসি ! (বাস্তবে না, কল্পনায়)। তাহলেই বিষয়টি বোঝা যাবে।

দা গ্রান্ডফাদার প্যারাডক্স  

ধরুন, আপনাকে একটা টাইম মেশিন দেওয়া হল। আপনি টাইম মেশিনে করে অতীতে চলে গেলেন, ধরা যাক ৫০-৬০ এর দশকে। এরপর অনেক খুঁজে-টুজে আপনি বের করলেন আপনার দাদা কে। কল্পনা করে নিন যে তখন আপনার দাদা মাত্র ১৫ বছরের কিশোর। অর্থাৎ, আপনার দাদামশাই তখনো বিবাহ করেন নি। আপনি সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন একটা রিভলভার। এবার পকেটে থাকা রিভলভারটা উঁচিয়ে একটা গুলি দিয়ে আপনার দাদার খুলিটি উড়িয়ে দিলেন, তৎক্ষনাৎ সে পরলোকে পাড়ি জমালো  (  বি.দ্র. কেউ বাড়িতে করার চেষ্টা করবেন না! )।   

এবার আসা যাক আসল কথায়। আপনি আপনার দাদাকে হত্যা করেছেন, খুবই ভাল কথা (এবং দুঃখজনক-ও বটে!)। কিন্তু হত্যার পাশাপাশি আপনার অস্তিত্ব নিয়ে একটা সিরিয়াস সমস্যা বাজিয়ে দিয়েছেন। কী সেই সমস্যা? এই যে, আপনি আপনার দাদাকে মারলেন, তাহলে আপনার বাবার জন্ম হবে কিভাবে?  আপনার দাদা তো বিয়ের আগেই গায়েব। আর আপনার বাবার জন্ম না-ই হয়ে থাকলে, আপনি আবার পৃথিবীতে জন্ম নিলেন কোথা থেকে? আর জন্মই যদি না হয় আপনার, তাইলে টাইম ট্র্যাভেলই বা করবেন কীভাবে ? বড়ই মুশকিলের বিষয় বটে। মারতে গেলেন দাদাকে, কিন্তু নিজেই নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে বসে আছেন, এইতো এখানে একটা বিরাট বৈপরীত্য সৃষ্টি হচ্ছে- যা কোন যুক্তিতেই মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। অথবা, কেউ টাইম মেশিনে পিছিয়ে গিয়ে তার নানাকে গায়েব করে দিলেন, এতে তার মায়ের জন্ম হবে না, তাইলে তাকে পেটে ধরবে কে ? এতে একটা প্যারাডক্সের সৃষ্টি হয়।  এটাই মূলত দা গ্র‍্যান্ডফাদার প্যারাডক্স।

 

                                              দা গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স

অথবা ধরতে পারেন, আপনি সময় পরিভ্রমণ করে গেছেন অদূর ভবিষ্যতে। গিয়ে দেখলেন আপনার পাড়ার গুণ্ডা বন্ধু মজনু হয়ে গেছে বড় ধরণের গডফাদার। আপনি এবার করলেন কী, আবার আগের সময়ে ফিরে আসলেন। অতঃপর দেশ ও দশের কথা ভেবে মজনু কে মেরে দিলেন। এবারেও প্যারাডক্স তৈরি হয়ে গেলো, কারণ মজনুকে এখন মারলে সে বড় হয়ে গডফাদার হবে কীভাবে ? (একে ‘গডফাদার প্যারাডক্স’ নামে ডাকতে পারেন, নামটা যদিও আমার দেওয়া)। মূলত, এইটাও আগের উদাহরণ টার সাথে আইডেন্টিকাল। যদি ভবিষ্যতের পথেও যাত্রা করেন, তবে আর ফেরত আসা যাচ্ছে না।

ফলাফল ও অতীত যাত্রা

এখন এই প্যারাডক্স থেকে আমরা কী ফলাফল পাই? এ থেকে যুক্তিবিদেরা মূলত বলে থাকেন, টাইম মেশিনে করে আর যাই করি, পিছনে (অতীতে) গিয়ে কর্ম সম্পাদন করা সম্ভবপর হয় না, তাহলে এই প্যারাডক্সের গহবরে পড়তে হয়।  তাই আপনারা পিছে গিয়ে থাকলে আপনাদের আইকিউ স্কোর বাড়লেও, আপনার বাড়ার আসলে কোন সম্ভাবনা নেই। তাই আমরা বলতে পারি, আপনি টাইম মেশিনে করে পিছনে গিয়ে ফিজিকালি সক্রেটিসের শিষ্য যেমন হতে পারবেন না, তেমন পারবেন না মোঘল বাদশাহ হুমায়ুনের সাম্রাজ্য কে শের শাহের কাছে থেকে রক্ষা করতে। তবে যেহেতু অসম্ভব কে সম্ভব করাই বিজ্ঞানের কাজ কাজেই এখানে ঢালাও ভাবে আসলে বলার সুযোগ নেই বা অতীত যাত্রা কে হেয় করার স্বার্থকতা-ও নেই! তাত্ত্বিকভাবে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত থাকলেও, অতীতে যাত্রা করা তখনই অসম্ভব্যতার ঝুলিতে পড়ে যখন সেটা স্বাভাবিক অবস্থাদৃষ্টে প্র্যাক্টিকাল হয় এবং অব্জারভেশনের গণ্ডিতে না থাকে। মোট কথা, যতক্ষণ না হিস্ট্রি পরিবর্তন না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত অবজার্ভার হিসেবে অতীত ভ্রমণের সম্ভাব্যতা থিওরিটিকালি  নাকচ করা যায় না।  

 

টাইম ট্রাভেলঃ জুরাসিক পিরিয়ড

অর্থাৎ, আপনি টাইম ট্রাভেল করে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থায় পিছনে বা অতীতে গিয়ে কিছু সম্পাদন করতে পারছেন না। তবে পূর্বের ন্যায় এখানে কথা হল, বিকল্প পথে অবজার্ভার হিসেবে এবং কিছু শর্তের দ্বারা আপনি অতীতে হয়ত ঘুরে আসতে পারেন, যার সম্ভাবনা বিজ্ঞান এখনো অগ্রাহ্য করেনি। পরবর্তী পর্বে সে সম্ভাবনা এবং বিকল্প গুলো নিয়ে আমরা দেখার চেষ্টা করব, আসলে কী ভাবে অতীতের পথের যাত্রায় আমাদের প্রায়-অসম্ভব প্রায়-সম্ভব হবে!  কিন্তু, স্বাভাবিক অবস্থায় অতীতে ডাইনোসরের আমলে বা জুরাসিক পিরিয়ডে যাওয়া খুবই রোমাঞ্চকর বটে, কিন্তু মোটেই সঠিক নয়। তাই বর্তমান সময়ে অবস্থানের সিদ্ধান্ত নেওয়া টাই প্র্যাক্টিকালি অধিক যুক্তিযুক্ত।

তথ্যসূত্রঃ
https://spaceplace.nasa.gov/review/dr-marc-space/time-travel.html
http://timetravelphilosophy.net/topics/grandfather/

মহাবিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী বল


Comments are closed.