একটা সময় আমাদের আদি মানবেরা গুহাবাসী ছিলো। শিকার করার জন্য এবং ভয়ানক প্রাণী এবং শত্রুদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য হাতে বানানো বিভিন্ন অস্ত্র ব্যবহার করতো। ছুরি, বর্শা, ফলা, ধনুক এসব ব্যবহার করার হত। সময়ের সাথে সাথে মানুষের চিন্তা ভাবনা এবং বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে এসব অস্ত্রেরও এসেছে পরিবর্তন । মানুষ আবিষ্কার করেছে আগ্নেয়াস্ত্র । নিজেরদের এবং দেশের প্রতিরক্ষার কথা চিন্তা করে মানুষ উদ্ভাবন করেছে অত্যাধুনিক সব অস্ত্র। এসব অস্ত্র দিয়ে সহজেই শত্রুকে ঘায়েল করা যায়। তাই একটি দেশের সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে অবৈধ মাফিয়া গ্রুপ , সবার শক্তির মূল উৎস হয়ে উঠেছে অস্ত্র।সময় যত যাচ্ছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে শক্তিশালী হচ্ছে এসব অস্ত্র। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই কখনও নিরাপত্তা, কখনও শত্রুকে নিকেশ করতে মানুষ তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও শৈলীকে যেভাবে কাজে লাগিয়েছে তা দেখলে অবাক হতে হয়। এখনও পর্যন্ত বিশ্বে এক লক্ষেরও বেশি ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র আবিষ্কৃত ও ব্যবহৃত হয়েছে। এই প্রতিবেদনে দেখে নেওয়া যাক বিশ্বের সবচেয়ে সেরা ৫ টি ভয়ঙ্কর রাইফেল কি কি:
১। হ্যাকলার এন্ড কচ এইচকে ৪১৬ অ্যাসাল্ট রাইফেল (Heckler & Koch HK416) :
জার্মানির “হ্যাকলার এন্ড কচ” কোম্পানির ডিজাইন করা রাইফেল এটি। এটি নির্মাণ করা হয়েছে AR-15 এর উপড়ে ভিত্তি করে যা ইম্প্রুভমেন্ট করা হয় এম-৪ পরিবারের সদস্য করে। এই অস্ত্রটি বিশেষ ভাবে নির্মাণ করা হয়েছে ইউএস আর্মির বিশেষ চাহিদা সর্ট-স্ট্রোক গ্যাস পিস্টন সিস্টেম অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে।ইউএস আর্মির কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় অস্ত্র এটি। জার্মানিদের যে কত গুলো রাইফেল জনপ্রিয় তার মাঝে অন্যতম হল এটি। এতে ব্যাবহার করা হয়েছে সর্ট-স্ট্রোক গ্যাস সিস্টেম যা নেওয়া হয়েছে H&K-G36 থেকে, গ্যাস সিস্টেমস নেয়া হয় AR-15 থেকে। এর সর্ট স্টোক পিস্টন এর প্রভাবে এর গ্যাস অপারেটিং সিস্টেম খুবি নিখুঁত ভাবে কাজ করে। এর ফ্যাক্টরি টেস্টিং এর সময় এই H&K-416 ফুল্লি অটোমেটিক ভাবে ১০,০০০ রাউন্ড ফায়ার করে কোনোরকম বিরতি না দিয়েই। এই অস্ত্রটির রক্ষণাবেক্ষণ খুবি সহজ ও স্বল্প সময়েই এর অপারেটর তা করতে পারে। এই H&K-416 এ সংযুক্ত করা আছে Proprietary Accessory Rail Forearm সাথে MIL-STD-1913 ও রয়েছে চতুর্দিকে। এই রাইফেলটিতে আছে একটি মাল্টি-পজিশন টেলিস্কোপিক বাট স্টোক যা ৬টি আলাদা স্তরে টানা যায় এবং সুবিধামত সাইজে আনা যায়। এর কোল্ট-হ্যামার-ফর্গেট ব্যারেল এর লাইফটাইম ২০,০০০ রাউন্ড । এর উন্নত ব্যারেল ও পিস্টন সিস্টেম এর কারণে এটি খুব ভালোভাবে গুলি ছুড়তে পারে যখন এটি পানিতে ডুবন্ত অবস্থাতেও থাকে।বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় ২০টি দেশের আইনশৃঙ্খলা ও বিশেষ বাহিনী এটি ব্যবহার করে থাকে। অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য এ রাইফেলটির রয়েছে বেশ কয়েকটি মডেল বা প্রকার, যেগুলো বিভিন্ন পরিস্থিতির প্রয়োজনানুসারে ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়াও এটির সাথে ৫০ মিলিমিটারের গ্রেনেড লঞ্চারও ব্যবহার করা যায়।
এক নজরে দেখে নেয়া যাক এর বিস্তারিত বিবরণ:
প্রস্ততকারক দেশ: জার্মানি
ব্যাবহারের সময়কাল: ২০০৪- বর্তমান
প্রকার: HK416D, HK416C ,HK416A5, HK416A7, M27 IAR
ওজন: ২.৯৫০- ৩.৮৫০ কেজি
দৈর্ঘ্য: ৬৯০-১০৩৭ মি.মি.
ব্যারলের দৈর্ঘ্য: HK416C: ৯ ইঞ্চি , HK416D: ১০.৫-২০ ইঞ্চি , HK416F: ১১-২০ ইঞ্চি, M27 IAR: ১৬.৫ ইঞ্চি
প্রশস্ততা : ৭৮ মিমি (৩.1 ইঞ্চি)
উচ্চতা : HK416C: ২৩৬মিমি (৯.৩ ইঞ্চি ) & HK416 এবং M27 IAR: ২৪০ মিমি (৯.৪ ইঞ্চি )
কার্তুজ : ৫.৫৬*৪৫ মি.মি.
ফায়ারিং রেট : ৭০০-৮০০ রাউন্ড/মিনিট ।
২। ডিএসআর ৫০ রাইফেল ( DSR 50) :
এর নাম শুনে যতটা সাদামাটা মনে হয় আসলে সে কিন্তু মোটেও তেমন সাদামাটা নয়। কার্যক্ষমতা ও নিশানা ভেদ করতে বিশ্বের অন্যতম মারণাস্ত্র এটি। এর সঙ্গে টেলিস্কোপ জুড়ে দেওয়া থাকে। আর সামনের দিকে থাকে দুটি স্ট্যান্ড। প্রথমদিকে এটি দূরবর্তী শিকারের জন্য ব্যবহৃত হতো। পরবর্তীতে বিভিন্ন দেশের সীমান্ত চেকপোস্টে ব্যবহার করা শুরু হয়। এই রাইফেলটিও মূলত জার্মানির তৈরি। এই অস্ত্রটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো এর ম্যাগাজিন পয়েন্ট। এখানে একটি নয়, দুটি পয়েন্ট রয়েছে এই রাইফেলে। যার একটি ব্যবহৃত হয় আর অন্যটি রিজার্ভে থাকে, যা ইমার্জেন্সিতে কাজে লাগে। গতি,ক্যালিবার(12.7×99mm NATO) এবং আঘাতের ক্ষমতা, এই তিন মাপকাঠিতেই এটি অন্য অনেক রাইফেলের চেয়ে এগিয়ে যেসব দেশ এই রাইফেলটি বেশি ব্যবহার করে থাকে তাদের মধ্যে পোল্যান্ড, রাশিয়া ও গ্রিস অন্যতম। এ ছাড়া ল্যাটিন আমেরিকার কিছু দেশেও এর গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। অন্যান্য রাইফেলের তুলনায় এর ওজন খানিকটা বেশি। গুলি ছোড়ার সময় চালনাকারীকে খুব শক্ত হাতে ট্রিগার ধরে রাখতে হয়। তা না হলে ঝাঁকুনি খেয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে মাফিয়া এবং চোরাকারবারিদের কাছে এই রাইফেলটি খুবই জনপ্রিয়।
দেখে নেয়া যাক এর বিবরণ:
প্রস্ততকারক দেশ: জার্মানি
ওজন: ১০.৩ কেজি
ব্যারেল: ৮০০ মিমি
দৈর্ঘ্য: ১৩৫০ মিমি
ক্যালিবার: ১২.৭*৯৯ মিমি
৩। ওজি সাবমেশিনগান( Uzi Sub-Machine Gun):
এর উৎপত্তিস্থল হল ইজরায়েল। এর নকশা করেছেন সে দেশেরই এক মেজর। তান নাম ওজি গাল। এটি সাব মেশিনগানের উন্নত সংস্করণ।এটি বাজারে আসে ১৯৫০ সালে। অনেকটা বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো ব্যাপক জনপ্রিয় এটি। এর আকর্ষণীয় ডিজাইন আর আকারে ছোট হওয়ার কারণের এর বিশাল জনপ্রিয়তা আছে ফিলিস্তিনি সীমান্তে যারা দায়িত্ব পালন করেন তাদের কাছে। তবে কথা হল ইজরাইয়েল এটি তৈরি করলেও এটি বেশি ব্যবহার করেছে হামাস বাহিনী আর আল কায়েদা সদস্যরা। ইসরায়েলী এই অস্ত্রই তারা ব্যবহার করে ইসরায়েলীদের বিরুদ্ধে!অনেকটা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মত। । এতে যুক্ত আছে উন্নত ধরণের টেলিস্কোপ। এই অস্ত্রটি মিনিটে ছয়শ রাউন্ড গুলি করতে পারে। তবে এটি আকারে ছোট, সহজে বহনযোগ্য এবং প্রশংসনীয় পারফরম্যান্সের জন্য বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই অন্যতম সেরা অস্ত্র হিসেবে সমাদৃত। এর আরেকটি সুবিধা হল এর ৯*১৯ আকৃতির বুলেট। যার কারণে এটি ফায়ারিং এর সময় খুব একটা ধাক্কা দেয় না। এতে করে কোনো ঝামেলা ছাড়াই এটি ব্যবহার করা যায় যেটি এর জনপ্রিয়তার অন্যতম মূল কারণ।
বিবরণ:
প্রস্ততকারক দেশ: ইসরায়েল
ওজন: ৩.৫ কেজি
ব্যারেল: ২৫০ মি.মি.
কার্তুজ: ৯*১৯ প্যারাবুলাম , 0.22 LR, 0.45 ACP, 0.41 AE
ফায়ারিং রেটঃ ৬০০ রাউন্ড/মিনিট
কার্যকরী দূরত্ব: ২০০ মিটার
মাজল ভেলোসিটিঃ ৪০০ মিটার/ সেকেন্ড
এর অসুবিধার মধ্যে যা আছে তা হলো এর গরম হয়ে যাওয়া। সাধারণ লোহার পাতে তৈরি বলে এটি খুব সহজেই গরম হয়ে যায়। এছাড়া সাধারণ মানের বুলেট ব্যাবহার করা হয় বলে অনেক সময় অনেক লক্ষ্য ভেদ করা এর পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে।
৪। এফ ২০০০ অ্যাসল্ট ( F-2000 assault rifle ):
এফ-২০০০ অ্যাসল্ট রাইফেলটির প্রস্ততকারক প্রতিষ্ঠান হলো বেলজিয়ামের প্রখ্যাত কোম্পানি এমএন হারসটাল। মূলত এই রাইফেলটির কল্যাণেই অস্ত্রের বাজারে নতুনভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় বেলজিয়াম। এটি প্রথম প্রদর্শিত হয় ২০০০ সালে আবুধাবির একটি প্রদর্শনীতে। এ কারণে নামকরণ করা হয় এফ-২০০০। ন্যাটো বাহিনীতে এ অস্ত্রের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে আফগানিস্তান ও ইরাকে এ রাইফেলটি ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে। এটি চালাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। বর্তমানে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনীতে এমনকি স্পেশাল টাস্কফোর্সেও ব্যবহৃত হচ্ছে এটি। দেখতে আকর্ষণীয় হলেও মারণাস্ত্রের দিক থেকে এফ-২০০০ রাইফেলটির গ্রহণযোগ্যতা অন্যতম।। এই অস্ত্রটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, এতে রয়েছে একটি “Removable Hand Guard” যা অস্ত্রের চালককে অস্ত্রটি চালনায় সাবলীল বোধ করতে সহায়তা করে। তার পাশাপাশি ওজনে হালকা এবং সাইজে ছোট কিন্তু মারাত্মক অস্ত্র বিধায় এটি অনেক বাহিনীরই প্রথম পছন্দ। বিশ্বের অন্যতম ভয়ানক এই বন্দুকের ক্যালিবার সাইজ ৫.৫৬x৪৫ এম এম ।এতে ৫.৫৬*৪৫ মি.মি মডেলের যে কোন বুলেট ফায়ার করা যায়। বিভিন্ন প্রকার কাষ্টমাইজ বুলেট ও এতে ব্যবহার করা যায়। এছাড়া এর বুলেটের হাইড্রো-স্ট্যাটিক শক ও আছে। পানিতে ভিজে গেলে শুধু মাত্র ব্যারেলর পানি সরে গেলেই এই অস্ত্র ব্যবহার করা যায়।
এর ব্যবহারকারী দেশগুলো হলঃ
বেলজিয়াম ,ইরাক, আফগানিস্তান ,ক্রোয়েশিয়া ,ভারত, লিবিয়া ,পাকিস্তান , পেরু, পোল্যান্ড , সৌদি আরব এবং স্লোভেনিয়া। অত্র রাইফেলটি এসব দেশের নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে সব সময় শোভা পায় ।এছাড়াও এই রাইফেলটিতে আধুনিক যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাখা হয়েছে যেমনঃলেজার ফইনটার , ট্যাকটিক্যাল ফ্ল্যাশলাইট এবং আরো আছে ভারটিক্যাল হাত গ্রীফ । এটার এখন আরো অনেক ভার্সন বের হয়েছে ।
বিবরণ:
ওজন: ৩.৬ কেজি
দৈর্ঘ্য: ৬৯৪ এম এম
ব্যারেলের দৈর্ঘ্য: ৪০০ মিমি
মাজল ভেলোসিটিঃ ৯০০ মিটার/সেকেন্ড
ফায়ার রেট: ৮৫০ রাউন্ড /মিনিট
এপ্রাকটিক্যাল ফায়ার রেট হল: ৪০-১০০ আর পি এম
ম্যাগাজিনে ধারণ ক্ষমতা: ৩০ রাউন্ড
সাইটিং রেঞ্জঃ ৪০০ মিটার
৫। এএস ৫০ স্নাইপার রাইফেল ( Accuracy International AS50) :
এর জন্মভূমি ব্রিটেন। এর প্রস্ততকারক ব্রিটিশ ফার্ম অ্যাকুরেসি ইন্টারনেশনাল। ব্রিটিশ দের তৈরি যে কত গুলো রাইফেল সারা বিশ্বে ব্যাপকহারে ব্যবহৃত হয় তার মাঝে এ এস ৫০ স্নাইপার রাইফেলটি অন্যতম। এই অস্ত্রটি অনেক দূর থেকে টার্গেট এনগেজ করতে পারে এবং বিস্ফোরক বুলেটের সাথে টার্গেটকে ধরাশায়ী করতে পারদর্শী। এই মডেলে রয়েছে গ্যাস অপারেটেড সেমি অটোমেটিক অ্যাকশন এবং হাইলি সফিসটিকেটেড মাজল ব্রেক , যা অস্ত্রের পারফরম্যান্স আরো দ্রুত এবং সফল করতে সাহায্য করে। এই ধরণের রাজসিক স্নাইপার রাইফেলটির ওজন অনেক কম এবং সহজে বহন ও সংযোজনযোগ্য বলে এটি অনেক বাহিনীরই প্রথম পছন্দ।
এর বিবিরণঃ
প্রস্তুতকারী দেশ: ব্রিটেন।
ব্যবহারকারী দেশ: ব্রিটেন।
উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান: অ্যাকুরেসি ইন্টারনেশনাল
ধরণ: সেমি-অটো স্নাইপার রাইফেলের
ব্যবহার কাল: ২০০৬-বর্তমান।
ওজন: ১২.২ কেজি।
দৈর্ঘ্য: ৫৩.৯ইঞ্চি।
রেঞ্জ: ১৫০০ মিটার
এই ছিলো সেরা ৫ টি ভয়ানক রাইফেল সম্পর্কে তথ্য। এত আধুনিক অস্ত্র শস্ত্রের মাঝে সেরা ৫ বেছে নেয়া একটু কষ্টকরই বটে। তবে এই তালিকা লম্বা করলে যে নাম গুলো আসবে সে গুলোও জানিয়ে রাখি আপনাদের সুবিধার জন্য:
কালাশনিকভ একে ৪৭, থম্পসন এম১৯২ মেশিনগান, এমজি৩ মেশিনগান , হেকলার কোচ এইচকে এমজি৪ ইত্যাদি।
One Comment
বিশ্বের সেরা ৫ টি স্নাইপার রাইফেল | বিজ্ঞানবর্তিকা
[…] একনজরে দেখে নিন সেরা ৫ রাইফেলঃ […]