এক অদৃশ্য মাংসাশী

১৮৭১ সালের কোন এক সময়। আর্মি সার্জন ডাক্তার জোসেফ বেশ চিন্তিত। তার হসপিটালের ওয়ার্ডের প্রায় ৪৬% রোগীই এক বিরল রোগের থাবায় ঘায়েল। তাদের শরীরের কিছু অংশে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অক্সিজেনের অভাবে সেখানকার টিস্যুগুলো(কোষগুচ্ছ) পচে যাচ্ছে। মাংস সেখান থেকে বলতে গেলে খুলে খুলে পড়ছে; সে এক বীভৎস দৃশ্য।  ইনফেকশন হওয়ার পর থেকে হতভাগ্য রোগীদের আয়ুও তখন জানা ছিল।

মাত্র ২৪ ঘন্টা!

এরপরের ৭০ বছর এই রোগ প্রায় দাপটের মত হেঁটে বেড়িয়েছে।

আমরা একটু খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীতে ফিরে যাই। ফিরে যাই আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক হিপোক্রেটিসের আমলে। জানা যায়, তিনিই প্রথম এই বিরল রোগটির বর্ণনা করে গিয়েছেন। তার বর্ণনানুযায়ী, এই ইনফেকশন খুব দ্রুতই পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ত। শরীর থেকে মাংস বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। এইরকম আরো বীভৎস রকমের বর্ণনা দেয়া সেখানে। তবে ডাক্তার জোসেফের দেয়া বর্ণনা থেকেই মূলত বহির্বিশ্ব এই রোগের সাথে পরিচিতি লাভ করে।

সমস্যা ছিল একটাই।

কারণটা কি, কেউই জানত না।

একটা সময় এলো যখন চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক অপার সম্ভাবনার দরজা খুলে গেল। মাইক্রোস্কোপ আবিষ্কার হল, অদৃশ্য ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া-আর্কিয়া-এককোষী ছত্রাকের মত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অদৃশ্য বস্তুগুলো দৃশ্যমান হল। এমনই এক সময়ে বিরল রোগটির কারণ জানা যায়। যদিও ততোদিনে খুব বেশি দেরি হয়ে গিয়েছে। মহামারীর আকার ধারণ করা রোগটি ততোদিনে এক বিশাল জনগোষ্ঠীকে গ্রাস করে নিয়েছে। তবুও, কোন দেরিই দেরি নয়।

Image result for Necrotizing Fasciitis

Vibrio vulnificus নামক এই ব্যাক্টেরিয়াটি ১৯৭৬ সালে এক রোগীর ব্লাড স্যাম্পল থেকে উদ্ধার করা হয়। Koch’s Postulate– এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয় এটিই সেই মরনঘাতী রোগের কারণ। বীভৎস এই রোগের নাম রাখা হয় Necrotizing Fasciitis. Vibrio গণের কেবল এই প্রজাতিটিই এই রোগের জন্য দায়ী। এই রোগের কারণে মৃত্যুর হার গড়ে ৩০%!

ব্যাক্টেরিয়াটি একটি গ্রাম-নেগেটিভ। অর্থাৎ, এটার বিরুদ্ধে আমাদের শরীরের কোনরকম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেই। দ্বিতীয়ত, সাধারণ এন্টিবায়োটিক এর বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়।

এই প্রজাতির ব্যাক্টেরিয়ার মূল আবাসস্থল হচ্ছে ঈষোদোষ্ণ সামুদ্রিক অঞ্চল। সাধারণত উপকূলীয় অঞ্চলে এর বিস্তার বেশি। তবে দূষিত পানিতেও এর অস্তিত্ব পাওয়া  গিয়েছে বলে জানা যায়। আমেরিকা মহাদেশে শামুকের মাংসল দেহ বেশ জনপ্রিয় একটি খাবার। আর এর কাঁচা মাংস খাওয়ার কারণেই সবচেয়ে বেশি এই রোগটি ছড়ায়।   

আমরা জেনে এসেছি যে এই রোগের কারণে মৃত্যুর হার প্রায় ৩০%। অর্থাৎ ৭০% সম্ভাবনা থাকে সিরিয়াস ইনফেকশন না হওয়ার। সিরিয়াস ইনফেকশনের লক্ষণ বেশ ভয়াবহ ধরণের। শরীরের বিভিন্ন যায়গায় প্রথম প্রথম লাল রঙের র‍্যাশ দেখা যায়। পরে তা পক্সের মত তবে বড় সাইজের ফোড়াতে পরিণত হয়। আর চিকিৎসার অবহেলায় শেষ সময়ে যা হয় তা আমরা জেনে এসেছি। এই ধরণের ইনফেকশন সবচেয়ে বেশি দেখা যায় USA-তে। প্রতিবছর গড়ে ২০০ জনের সিরিয়াস ইনফেকশন হয়ে থাকে।

তবে যে শুধু শামুকের কাঁচা মাংস খেলেই হয় তা নয়। সমুদ্রের পানিতে সাঁতার কাটতে গিয়ে মাছের কাঁটার আঘাতে চামড়া কেটে যাওয়ার মধ্য দিয়েও এই ব্যাক্টেরিয়া দেহে প্রবেশ করে।

ব্যাক্টেরিয়াটা কি আসলেই মাংসাশী?

আংশিক সত্যি। আসল কারণ যেটা সেটা হচ্ছে ব্যাক্টেরিয়াটা যখন টিস্যুর ভিতর বংশবৃদ্ধি শুরু করে, তখন এক ধরণের বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ উৎপন্ন হয়। এর কারণে দেহে রক্ত চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। যার ফলে টিস্যগুলো প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায় না। যা পরবর্তীতে টিস্যুসমূহের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

Image result for vibrio vulnificus
নিউজ হেডলাইন

ওদিকে ব্যাক্টেরিয়ার ক্রমাগত বংশবিস্তারের কারণে টিস্যুর মৃত্যুর হারও বেড়ে যেতে থেকে। এক সময় তা ক্ষত হতে হতে উন্মুক্ত হয়ে যাবে।  আর এতেই ধরে নেয়া হয় যে তা মাংসাশী।   

তবে কি এর চিকিৎসা একদমই নেই?

অবশ্যই আছে। যতদ্রুত সম্ভব, এর চিকিৎসা করাতে হয়। কেননা রক্তে মিশতে সময় নেয় ২৪-৭২ ঘণ্টা সময় নেয়। মূল চিকিৎসা হচ্ছে Debridement surgery, যা করে ইনফেক্টেড টিস্যু কেটে ফেলা হয়। বেশি দেরি হয়ে গেলে হয়ত দেখা যায় দেহের কোন অংগে তা ছড়িয়ে গেছে। অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে যাতে না পড়ে তার জন্য সেই অংগ প্রয়োজনে কেটে ফেলতে হয়। এছাড়াও Ceftriaxone Doxycycline নামক স্পেশাল কিছু এন্টিবায়োটিক ব্যাবহার করা হয়।  

nejmicm1716464_f1.jpeg (800×313)

সবশেষে, চিকিৎসা নির্ভর করে কেবলমাত্র কত দ্রুত তার পদক্ষেপ নেয়া হল। দেরি হলে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকাটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। সমস্যাটা এখানেই।

কেননা প্রথমদিকের লক্ষণসমূহ খুবই সাধারণ হয়ে থাকে। যেমন, হাঁচি, কাশি সাথে সর্দিজ্বর। যা দেখে মনে হতে পারে হয়তোবা ভাইরাস জ্বর। কেননা এই রোগের নির্দিষ্ট কোন লক্ষণ নেই।

আসা যাক এর বিস্তারের অঞ্চল নিয়ে। এই ব্যাক্টেরিয়া সবচেয়ে বেশি দেখা যায় মেক্সিকো উপসাগর অঞ্চলে, অন্যভাবে বললে, আমেরিকা মহাদেশে মূলত এর প্রভাব বেশি। তাই বলা যায় আমরা মোটামুটি চিন্তামুক্ত থাকতে পারি।  

এখন আসি শিরোনামের কাহিনীতে। এতক্ষণ ধরে যে প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, সন্দেহ নেই তা ‘জলবায়ু’ শব্দটা নিয়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে আবার এর সম্পর্ক কী?

খুব বেশি যদিও নেই তবে কিছুতো আছেই। আমরা জানি, গত বছরকে ধরা হয়েছিল উষ্ণতম বছর হিসেবে। বলা হয়, সাগরের তাপমাত্রা তাতে ১.৫ ডিগ্রী বেড়ে গিয়েছে। আর যেহেতু উপকূলীয় অঞ্চলের সমুদ্রের পানি গভীর সমুদ্রের চেয়ে এমনেতেই উষ্ণ থাকে, তাই আগের চেয়ে আরো বেড়ে গিয়েছিল। আর এই মরণঘাতী Vibrio vulnificus –এর বিস্তারের পরিমাণও বেড়ে গিয়েছে। সাথে সাথে বেড়ে গিয়েছে রোগীরও পরিমাণ।

এতো গেল জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম এক কারণ। অভাব তো আর নেই।

References:

  1.  Food Microbiology: Fundamentals & Frontiers- Oliver JD, Kaper J.
  2. businessinsider.com
  3. glynns.co.uk
Comments are closed.