মোনালিসার চিত্রকর লিওনার্দো দা ভিঞ্চির নাম শোনে নি এমন মানুষ খুব কমই আছে। তবে তিনি যে সারা জীবন ধরে শুধু মোনালিসাই এঁকে গেছেন এমন ধারনা যদি আপনার হয়ে থাকে তবে আপনার ধারণা ভুল । তিনি ছিলেন একাধারে চিত্রকর, স্থপতি , বিজ্ঞানী। বিভিন্ন অদ্ভুত সব গবেষণা করে তার সারা জীবন কেটেছে। তবে তার অন্যতম বিষ্ময়কর কাজ হচ্ছে তার আঁকা ছবি “ভিট্রুভিয়ান ম্যান”। ইংরেজিতে “Vitruvian Man” . এটি শুধু একটি ছবিই না। ছবির চেয়েও বেশি কিছু। এতে তিনি উল্লেখ করেছে মানবদেহে অবস্থিত এমন সব জ্যামিতিক অনুপাত যা পুরোপুরি ঐশ্বরিক। ড্যান ব্রাউন রচিত সাড়া জাগানো বেস্ট সেলার থ্রিলার বই “The Da Vinci Code” পড়া আছে যাদের তাদের কাছে এই ছবিটি পরিচিত লাগবে। না লাগলেও ক্ষতি নেই। আজ সেই ছবির বিস্তারিত তথ্যই আপনাদের বলবো।
এ ছবিটি ভিঞ্চি এঁকে ছিলেন ১৪৯০ সালের দিকে। খ্রিষ্টপূর্ব ৭০ থেকে ৮০ সালের মধ্যে জন্ম নেয়া “মার্কাস ভিট্রুভিয়াস পোলিও” নামের এক স্থপতির কিছু কাজের উপর ভিত্তি করে ছবিটি আঁকেন তিনি, যিনি বিশ্বাস করতেন, পৃথিবীর সকল স্থাপত্য অনুপাতের মূলে রয়েছে মানবশরীর। তার নামের উপর ভিত্তি করেই ছবিটির নামকরণ করেন ভিঞ্চি। কথিত আছে ছবিটি আঁকার জন্য কবর থেকে তিনি মৃত লাশ চুরি করে তা নিয়ে গবেষণা করেছেন। সেখান থেকেই তিনি দেখতে পান মানুষের শরীর আসলে আশ্চর্য জ্যামিতিক অনুপাতের মিশেল।
ছবিতে দেখা যায় একটা মানুষ একটা বৃত্তের ভেতর হাত পা ছড়িয়ে আছে। তার নোট বুকের লেখা থেকে যা যা জানা যায় ছবিটির ব্যাপারে তা হলঃ
১। দুই হাত সমান ভাবে প্রসারিত করলে এক হাতের আঙ্গুলের ডগা থেকে অন্য হাতের আঙ্গুলের ডগা পর্যন্ত যে দূরত্ব পাওয়া যায় সেটি আসলে মানুষের উচ্চতা।
২। চুলের গোড়া থেকে থুতনির নিচ পর্যন্ত সে দৈর্ঘ্য হয় তাকে ১০ দিয়ে গুন করলে যা পাওয়া যাবে সেটি হল মানুষটির প্রকৃত উচ্চতা।
৩। বুকের উপর থেকে মাথা পর্যন্ত যে দৈর্ঘ্য পাওয়া যায় তা মানুষের প্রকৃত উচ্চতার ৬ ভাগের ১ ভাগ।
৪। বুকের উপর থেকে চুলের গোড়া পর্যন্ত দূরত্ব হল উচ্চতার ৭ ভাগের ১ ভাগ ।
৫। স্তন থেকে মাথার দূরত্ব হল উচ্চতার ৪ ভাগের ১ ভাগ ।
৬। প্রসারিত অবস্থায় আমাদের কাঁধের দৈর্ঘ্য হল উচ্চতার ৪ ভাগের ১ ভাগ।
৭। কনুই থেকে হাতের আঙ্গুলের অগ্রভাগ পর্যন্ত দূরত্ব হল উচ্চতার ৪ ভাগের ১ ভাগ।
৮। কনুই থেকে বগল পর্যন্ত দৈর্ঘ্য হল উচ্চতার ৮ ভাগের ১ ভাগ।
৯। মানুষের পায়ের পাতার দৈর্ঘ্য তার প্রকৃত উচ্চতার ৭ ভাগের ১ ভাগ।
১০। সম্পূর্ণ হাতের দৈর্ঘ্য তার প্রকৃত উচ্চতার ১০ ভাগের ১ ভাগ।
১১। লিঙ্গের গোড়া মানুষের উচ্চতার প্রায় মাঝ বরবর অবস্থান করে।
১২। থুতনীর নিচ থেকে নাক পর্যন্ত এবং ভ্রু থেকে চুলের গোড়া পর্যন্ত দূরত্ব, কান থেকে মুখমন্ডলের দূরত্বের ৩ ভাগের ১ ভাগ।
১৩। পায়ের তলা থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত দূরত্ব হল উচ্চতার ৪ ভাগের ১ ভাগ।
এছাড়াও চিত্রে আঁকা বৃত্তের ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি লিখেছেন,
আপনি যদি আপনার পা দুটো দু পাশে ছড়িয়ে এমন ভাবে ছড়ান যাতে আপনার উচ্চতা ১৪ ভাগের ১ ভাগ কমে যাবে এবং আপনার হাত দুটো দু পাশে মেলে ধরেন যেন আপনার হাতের মধ্যমা আঙ্গুলটির ডগা ঠিক আপনার মাথার চূড়ার সমান হয় , তাহলে আপনার হাত দুটো আর পা দুটোর অবস্থানকে স্পর্শ করে একটি বৃত্ত আঁকা যাবে যার কেন্দ্র হবে আপনার নাভি। এছাড়াও এই দুই পায়ের মাঝ খানের ফাঁকটি হবে হুবুহু একটি সমবাহু ত্রিভুজ।”
ছবিটি পাওয়া যায় ভিঞ্চির মৃত্যুর অনেক বছর পরে। তার প্রায় সব গবেষণালব্ধ তথ্যই তিনি তার নোটবুক গুলোতে ইতালীয় ভাষায় উলটো হরফে লিখে গেছেন যাতে চট করে সেগুলোর অর্থ বের করা না যায়। সে গুলো বের করতে দরকার হয়েছে আয়নার। “ভিট্রুভিয়ান ম্যান” এ ছবিটি বর্তমানে রাখা আছে ইতালীর “গ্যালারি দেল আকাদেমিয়া” তে। এ ছবিতে বর্ণীত তথ্য গুলো থেকে বুঝা যায় মানুষের শরীর আসলে সুষম অনুপাতে গঠিত যাকে ইংরেজিতে বলা হয় “Model of Perfection“. আর এজন্যই সৃষ্টিকর্তাকে বলা হয় সবচেয়ে বড় আর দক্ষ স্থপতি।
2 Comments
গণিত, সৌন্দর্য্য এবং প্রকৃতি। পর্ব-১ | বিজ্ঞানবর্তিকা
[…] মানুষের শরীরে রয়েছে গোল্ডেন রেশিওর প্রকাশ । শরীরের মোট উচ্চতা এবং মাথা থেকে হাতের আঙ্গুল পর্যন্ত দূরত্বের অনুপাত Φ এর সমান। আবার মাথা থেকে নাভি এবং নাভি থেকে পায়ের গোড়ালির দূরত্বের অনুপাতও Phi এর সমান। মানুষের হাতের আঙ্গুলের হাড়গুলো একটি অন্যটির সাথে গোল্ডেন রেশিও দিয়ে সম্পর্কিত। যেমন নিম্নবাহু (হাতের কনুই থেকে তালু পর্যন্ত) এবং উর্ধবাহুর ( কনুই থেকে ঘাড়) দূরত্বে ও রয়েছে গোল্ডেন রেশিও বা Phi এর সম্পর্ক, একই সম্পর্ক রয়েছে হাতের তালু এবং নিম্নবাহুর দৈর্ঘ্যে। […]
গণিত,সৌন্দর্য্য এবং প্রকৃতি পর্ব-৩ | বিজ্ঞানবর্তিকা
[…] বিশেষ করে সোনালী আয়তক্ষেত্র তে। ভিট্রুভিয়ান ম্যানকে বলা হয় পিকচার অব পারফেকশন,যা […]