আমরা সবাই কী ট্রান্সন্সজেনিক? পর্ব -০২

বর্তমানে হাতের কাছেই আমাদের জিনোমের গঠন সম্পর্কে অনেক বিস্তারিত ও পর্যাপ্ত জ্ঞান রয়েছে। আর সেই জ্ঞান এটাই নির্দেশ করে যে ট্রান্সজেনেসিস বা ট্রান্সজেনিক-এর উৎপত্তি প্রকৃতিগতভাবেই হতে পারে। আমাদের আলোচনা শুরুর আগে আমরা আরেকবার ট্রান্সজিন বা পরিবর্তিত জিন সম্পর্কে আমাদের ধারণাটি আরেকবার ঝালাই করে নিই।

ট্রান্সজিন বা পরিবর্তিত জিন হচ্ছে এমন কোনো জিন বা জেনেটিক বস্তু যা প্রাকৃতিক অথবা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং কৌশল ব্যবহার করে এক জীব থেকে অন্য জীবে স্থানান্তর করা হয়।

এই ধারণার ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে প্রথমে বরং আমরা বিভিন্ন জনপ্রিয় উৎস থেকে প্রাপ্ত কিছু পর্যবেক্ষণ অবলোকন করে নিই। আমদের ডিএনএ-র নানারকম বিশ্লেষণ ও এর সংকরায়নের মাধ্যমে দেখা যায় যে আমাদের জিনোমের একটি বিরাট অংশেই একই সিকুয়েন্সের বারংবার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। আরও অনেক প্রজাতির জিনোম নিয়ে গবেষণা করে দেখা গেছে, জিনোমের দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি অঞ্চল হচ্ছে নন-কোডিং। অর্থাৎ ঐ অঞ্চলে প্রোটিন কোড করার জন্য কোনো তথ্য নেই। এইসব নন-কোডিং T (ncDNA) অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুনরাবৃত্তিমূলক ডিএনএ সিকুয়েন্স দিয়ে সজ্জিত। এই সিকুয়েন্সগুলো প্রতিস্থাপনযোগ্য (Transposable Elements or TE or Transposons)। তবে এখন পর্যন্ত এই TE উপাদানের উৎপত্তি সম্পর্কে আমরা তেমন কিছুই জানিনা। যদিও, কিছু ভাইরাসের জিনোমের সাথে এর মিল পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, ডিএনএ-র এই অঞ্চলগুলো প্রকৃতিগতভাবে আমাদের পূর্ব-পুরুষে রেট্রো-ভাইরাসের আক্রমণের ফলে বিবর্তনের মাধ্যমে আমাদের জিনোমে এসে পৌঁছেছে।

এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতিতে প্রকৃতিগতভাবে ডিএনএ সিকুয়েন্সের স্থানান্তরের (অনুভূমিক জিন স্থানান্তর) অনন্য এক উপায় হচ্ছে মিথোজীবিতা (Symbiosis); আদিকোষ এবং প্রকৃত কোষের মিথোজীবিতা। আমাদের কোষে তথা প্রকৃত কোষে মাইটোকন্ড্রিয়া ও উদ্ভিদকোষে ক্লোরোপ্লাস্টের মত কোষ-অঙ্গাণুর উৎপত্তির ক্ষেত্রে দুটি ভিন্ন ধরনের কোষের মিথোজীবিতা-কেই দায়ী করা হয়। সম্ভবত, কোনো উন্নত ব্যাকটেরিয়া এবং আদি প্রজাতির কোনো প্রকৃত কোষের মিথোজীবিতার ফলে ব্যাকটেরিয়া থেকে তৎসংশ্লিষ্ট কোনো জিন প্রকৃত কোষে স্থানান্তরের কারণে এদের জন্ম হয়ে থাকতে পারে। বর্তমানে আমরা জানি যে মাইটোকন্ড্রিয়ার অর্ধেকেরও বেশি প্রোটিন কোড করার জন্য যে জিনগুলো সম্পর্কিত তা সব আমাদের নিউক্লিয়ার জিনোমেই অবস্থিত; একই কথা উদ্ভিদকোষের ক্লোরোপ্লাস্টের জন্যেও সমানভাবে প্রযোজ্য।

পূর্বোল্লিখিত মিথোজীবিতার মত জীবজগতে বিদ্যমান আরেক প্রকারের সম্পর্ক হচ্ছে পরজীবিতা (Parasitism)। প্রকৃতিতে এর একটি প্রামাণ্য উদাহরণ হচ্ছে, উদ্ভিদমূলে অ্যাগ্রো-ব্যাকটেরিয়ার বসবাস। এটি প্রমাণিত যে অ্যাগ্রো-ব্যাকটেরিয়া তার জিনোম থেকে উদ্ভিদ ক্রোমোসোমে জিনের স্থানান্তর ঘটিয়ে থাকে। সবচেয়ে অবাক করা তথ্য হচ্ছে, এইসব ভাইরাল এবং ব্যাকটেরিয়াল অবশিষ্টাংশকে আমাদের কোষে নানা কাজ করতেও দেখা যায়; অনেক ক্ষেত্রে যা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতএব, ট্রান্সজেনেসিস শুধুমাত্র প্রাকৃতিক নয়, বরং বিবর্তনীয় দৌড়ে আমাদের টিকে থাকার জন্য এর প্রয়োজন অবশ্যই রয়েছে।

সাম্প্রতিক গবেষণায় এক দল গবেষক দেখতে পান যে শুধুমাত্র অ্যাগ্রো-ব্যাকটেরিয়া (A. rhizogenes) প্রাকৃতিকভাবে মিষ্টি আলুর (Ipomea potatoes; আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত) জিন স্থানান্তরই করে না, বরং এই জিনগুলো কার্যক্ষম এবং এই উদ্ভিদের মূলে এম-আরএনএ (mRNA) উৎপন্ন করে। এই এম-আরএনএ থেকেই পরবর্তীতে রাইবোসোমে আরও অন্যান্য কোষীয় বস্তুর সহায়তায় প্রোটিন তৈরি হয়। জিনের এই স্থানান্তর আমাদের দেখায় যে, যেকোনো প্রাকৃতিক উদ্ভিদে প্রাকৃতিকভাবেই যেকোনো কার্যকরী জিন অন্য প্রজাতির দ্বারা প্রতিস্থাপিত হতে পারে।

সুতরাং, ট্রান্সজেনিকের সংজ্ঞা অনুসারে আমরা মিষ্টি-আলুকে একটি ট্রান্সজেনিক পণ্য বলতেই পারি। আর এই ট্রান্সজেনিক পণ্যটি প্রায় হাজার বছর ধরে আমরা ব্যবহার করে আসছি খাদ্য হিসেবে। এই পর্যবেক্ষণ বারবারা ম্যাক ক্লিনটক-এর গবেষণাকে সমর্থন করে। তিনি ১৯৫০ সালে তাঁর এক গবেষণায় দেখেন যে, ভুট্টার আশি শতাংশেরও বেশি ডিএনএ ট্রান্সপোসেবল বস্তু (Transposons) দিয়ে গঠিত। তাঁর গবেষণায় দেখা এই ট্রান্সপোসন্সগুলো সম্ভবত ভাইরাস থেকে আগত। ম্যাক ক্লিনটকের এই গবেষণা ভুট্টাকে প্রাকৃতিক ট্রান্সজেনিক খাদ্যের কাতারে ফেলে দিয়েছে। ১৯৯০ সালে প্রথম বিটি-ভুট্টা (Bacillus thurangenesis corn) বাজারে আসার আগ পর্যন্ত এই ভুট্টাই আমরা শতাব্দী ধরে ব্যাপক হারে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করছি।

আজকাল জিনোমিক ডাটার ব্যাপক কল্যাণে আমরা দেখতে পাই, আমাদের জিনোম যেন একটা ‘ইকোসিস্টেম’; বিভিন্ন ট্রান্সজেনিক সিকুয়েন্সের ইকোসিস্টেম। সেই সিস্টেমে বিভিন্ন ট্রান্সজেনিক সিকুয়েন্সগুলো সময়ের সাথে সাথে নতুন জিনোম তথা নতুন প্রজাতি সৃষ্টির জন্যে যুক্ত হচ্ছে।

এতক্ষণ যে যে তথ্য এখানে আলোচিত হয়েছে, তার সবগুলোই আমাদের সমাজে বিদ্যমান ট্রান্সজেনিক খাদ্য নিয়ে যে নেতিবাচক সমালোচনাগুলো রয়েছে, তার তীব্র বিরোধীতা করে। সবশেষে, যদি আমাদের গৃহীত খাদ্যের অধিকাংশই ট্রান্সজেনিক হয়েই থাকে, তাহলে মনুষ্যসৃষ্ট ট্রান্সজেনিক খাদ্য আমাদের এমন কী ক্ষতি করতে পারে, যেখানে আমরা বহু বছর ধরে জিনগত পরিবর্তীত বিভিন্ন বস্তুকে ইতোমধ্যেই গ্রহণ করে আসছি? যদি আমাদের সমাজ এখানে উপস্থাপিত তথ্যগুলো নিয়ে পর্যালোচনা করে, তাহলেও কী তাদের সুর অপরিবর্তিত থেকে যাবে?

প্রযুক্তিকে দোষারোপ করার আগে আমাদের উচিত আমাদের নিজেদের অবস্থান আরও সূক্ষ্মভাবে ও বাস্তবতার নিরিখে বিবেচনা করে দেখা। বিশেষ করে, যেসব ব্যাপারগুলো বিজ্ঞানের সহায়তা-ই সুষ্ঠুভাবে সমাধান করা যায়, সেগুলোকে সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে গিয়ে বৈজ্ঞানিকভাবেই সমাধান করা উচিত। পরিশেষে এটাই বলা যায় যে, যদি কোনো ব্যাপারে পর্যাপ্ত সাক্ষ্যের অভাব থাকে তবে তা কখনই কোনো বিতর্কের বিষয় হতে পারে না। বরং প্রমাণকে উপেক্ষা করার বিষয়টিই বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারেননি।

পর্ব ১-এখানে

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>