মৃত্যু কি ও তার নিশ্চিতকরণের ইতিহাস!!

মৃত্যু। এটা সত্যিকার অর্থে একটি শব্দের চেয়ে বেশি কিছু। এর সাথে আবেগ জড়িয়ে থাকে। আর আমরা বাঙালি। একজন বাঙালির জীবনে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তার কাছের মানুষদের সাথে জড়িয়ে থাকা সকল আবেগ।ভূমিকা আর বাড়াবো না। আসল কথায় আসি।

জীবন ও মৃত্যুর মাঝে পার্থক্য কি? বেশ দার্শনিক ধরণের প্রশ্ন এটি। কেউই সরাসরি এর উত্তর দিতে পারবে না। প্রাথমিকভাবে এর উত্তর দেওয়া সত্যিই অসম্ভব। আমি নিজেও কিছু সময়ের জন্য এই পৃথিবী থেকে হারিয়ে গিয়েছিলাম যখন প্রথম এই প্রশ্নের সম্মুখীন হই। জীবন ও মৃত্যুর পার্থক্য সাদা-কালো রঙের মত নয়, যাকে খুব সহজেই আলাদা করা যাবে। অনেক বিদ্বান ব্যাক্তিও মৃত্যুর কাটখোট্টা একটি সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে পারে নি। অনেক সময় অনেক সহজ প্রশ্নের উত্তর কঠিন হয়ে দাড়ায়। এটিও সেরকম এক অবস্থা।

মৃত্যু কখন হয়??

প্রত্যেকে নিজ নিজ ধর্মীয় ভাবে এই বিষয়টি ব্যখ্যা করতে সক্ষম। কিন্তু আমরা বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলছি। আর বিজ্ঞান বলছে মৃত্যুর কোন নির্দিষ্ট সময় নেই। মৃত্যু একটি সিরিজের সমন্বিত ফলাফল। একটি দিন পার করি আর আমরা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাই। প্রতিনিয়তই আমাদের দেহের কোন না কোন কোষগুচ্ছ নির্দিষ্ট হারে ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে বা ধ্বংস হচ্ছে। প্রতিদিনের এই ঘটনাকে বলা হয় “মিনি ডেথ”। আর অনেক অনেকগুলো মিনি ডেথের সমন্বিত রূপ মৃত্যু। যার কারণেই সংজ্ঞা নির্ধারণ করা অনেক কঠিন।

মারা গেলে বুঝবো কিভাবে??

মানুষ অনেক ভাবেই মারা যেতে পারে। ধরুণ আপনাকেই জিজ্ঞাসা করা হল যা মানুষ কিভাবে মারা যায়। কেউ বলবে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হলে, কেউ বলবে হার্ট তার কাজ বন্ধ করলে, আবার কেউ বলবে মস্তিষ্ক তার ক্ষমতা হারালে। এর সবগুলোই ঠিক। আসলে এটি নির্ভর করে আপনার ধারণা বা বিশ্বাসের উপর।

বিশিষ্ট নিউরোলজি ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ Dr.James Bernat এর মতে, “মানুষের জীবনে নির্দিষ্ট কোন মুহূর্ত নেই যখন তার সব শেষ হয়ে যায়। এই শেষ হওয়া তার জন্মের পর থেকেই শুরু হয়। আর শেষ পরিণতি অনেক গুলো মিনি ডেথের সমষ্টি।”

অনেক আগে থেকেই মানুষের মৃত্যু নিশ্চিত করা অনেক কঠিন একটি কাজ। মধ্যযুগে যেটা হত সেটা হল যদি কাউকে মৃত বলে মনে হত তাহলে তাকে একটি বাক্সে বন্ধ করে, বাক্সটি ভালো করে ঝাঁকানো হত। যদি সে এর পরেও জেগে না উঠে তাহলে সে মৃত। এতে করে অনেক জীবিত মানুষ কেও ভুল বশত সমাধি দেওয়া হত।

১৯শ শতকে ফরাসীরা বেশ কিছু নিয়ম মেনে চলত মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য। মৃত বলে সন্দেহ করা ব্যক্তির বিশেষ অঙ্গে চিমটি দেওয়া, শরীরের উপরিভাগে জোঁক ছেড়ে দেওয়া, ব্যক্তির নাম কানের কাছে চিৎকার করে বারবার উচ্চারণ করা ইত্যাদি পদ্ধতি অনুসরণ করা হত।

কিছু কিছু শিক্ষিত এলাকায় সন্দেহ করা ব্যক্তির নাকের কাছে আয়না ধরা হত। শ্বাস-প্রশ্বাস চললে আয়নার কাঁচে কুয়াশা বা ধোয়ার মত দেখা যাবে। এভাবেও মৃতকে শনাক্ত করা হত।

১৮৪৬ সালে একাডেমী অব সাইন্স, প্যারিসে একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। যার নাম ছিলো The best work or the signs of death and means of preventing premature। ফরাসী চিকিৎসক ইউয়িনে বোখাট সেখানে প্রথম বারের মত দেখান হার্ট বিটের অস্তিত্ব পরীক্ষার মাধ্যমে মৃত ব্যক্তি শনাক্ত করা সম্ভব। আর এই ফলাফল উপস্থাপন করতে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করেন স্টেথোস্কোপ। সেখান থেকেই স্টেথোস্কোপের যাত্রা শুরু। এই মহামূল্যবান আবিষ্কারের জন্য তাকে ঐ প্রতিযোগিতার বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।

এর অনেক সময় পর বিশ্ব পরিচিত হয় কোমা পেশেন্টের সাথে। তখন কোমা পেশেন্ট সবার কাছে আশ্চর্যজনক ছিলো। এই অবস্থায় রোগীর মস্তিষ্ক আংশিক সচল থাকলেও রোগী থাকে গভীর নিদ্রায়। সেই ঘুম কখনো ভাঙবে কিনা কেউ জানে না।

এবার আসি সবচেয়ে আজগুবি বিষয়টাতে। আশা করি আপনি ব্রেইন ডেথ শব্দটির সাথে পরিচিত। এই অবস্থা কোমা পেশেন্টের চাইতেও খারাপ। মস্তিষ্ক সম্পূর্ণরূপে কর্মক্ষমহীন হয়ে পড়ে, এমনকি শ্বাস-প্রশ্বাসও নিজে থেকে চালাতে পারে না। ১৯৫০ এর দিকে চিকিৎসকরা এই অবস্থার সামনাসামনি প্রথমবারের মত হন।লাইফ সাপোর্ট এর মাধ্যমে এদের জীবিত রাখা হয়। এধরণের রোগীর সুস্থ হওয়ার সম্ভবনা নেই বললেই চলে। এদের বলা হয় heart-beating cadavers। cadavers মানে মৃতদেহ বা লাশ। তাই বাংলায় বলা হয় জিন্দা লাশ। অনেকে ব্রেইন ডেথ আর ব্রেইন স্ট্রোককে এক মনে করে থাকে। আসলে দুটি বিষয় আলাদা। ব্রেইন স্ট্রোকের ব্যক্তিকে বাঁচানো অনেক কঠিন হলেও সম্ভব। কিন্তু ব্রেইন ডেথের রোগীকে বাঁচানো যায় না। কারণ মস্তিষ্ক সেখানে সচল থাকে না, নিজের সামান্যতম কাজ করার ক্ষমতাটিও হারিয়ে ফেলে। তবে কিছু ক্ষেত্রে রোগী বেচে যায়। এর হার খুবই কম। একে মিরাকল ও বলা চলে।

এই বিষয়টি নিয়ে অনেকের মাঝে অনেক প্রশ্ন থাকতে পারে। যদি থাকে তবে আমাদের জানান, আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করব উত্তর দেওয়ার।

আর্টিকেলটি পড়ার জন্য অসংখ্যা ধন্যবাদ।

মো:আবিদুল ইসলাম।

Comments are closed.