মমি বৃত্তান্তঃ কেন এবং কিভাবে করা হত মমি?

সেই ছোট বেলা থেকে আমরা মমি কথাটার সাথে পরিচিত। অথবা হলিউডের বিখ্যাত চলচিত্র সিরিজ ” The Mummy” আমাদের অনেকেরই দেখা আছে।  মমি কথাটা শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে পিরামিড আর মমির দেশ মিশরের ছবি অথবা  হলিউডের সিনেমা গুলোয় দেখানো জীবন্ত হয়ে উঠে গল্পের নায়ক নায়িকাদের ধাওয়া করতে থাকা  মমির ছবি। যদিও তাদের জীবন্ত হয়ে উঠার কোনো সম্ভাবনা আসলে নেই।   এত কিছুর পরেও মমির সঠিক ইতিহাস বা মমি  কিভাবে তৈরি করা হয় তা আমরা বেশিরভাগই জানি না। তাই আজকের আমাদের এই আর্টিকেলটি মমি নিয়েই।

মমি কি?

সহজ ভাষায় হলতে গেলে মমি হল মৃতদেহ সংরক্ষণ করার বিশেষ এক পদ্ধতি। মমি কথাটি আরবি শব্দ ‘মামিয়া’ থেকে এসেছে, যার অর্থ মোম। মূলত মোম দিয়ে মৃতদেহকে আবৃত করা হতো, সেজন্য এর নামকরণ করা হয় মমি। প্রাচীন মিশরে বিশ্বাস করা হত যে, মৃত্যুর পর মানুষ আরেক পৃথিবীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। তাদের বিশ্বাস ছিল, এই যাত্রা শেষে পরকালে বসবাসের জন্য তাদের দেহ সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। আর এই ধারণা থেকে তারা মমি বানানো শুরু করে। মিশরীয়রা শুধু মানুষ নয়, তাদের প্রিয় প্রাণী যেমন- কুকুর, বিড়াল এদের মৃতদেহকেও মমি বানিয়ে রাখতো।বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন সময়ে মমি করে মৃতদেহ সংরক্ষণের প্রচলন ছিল। ইনকা, অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসী, প্রাচীন ইউরোপিয়ান সভ্যতা সহ আরও অনেক সভ্যতায় মৃতদেহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে হাজার হাজার বছর ধরে মমিকরণ প্রথা প্রচলিত ছিল। তবে অধিকাংশ গবেষকের মতে, মমির উৎপত্তিস্থল হলো প্রাচীন মিশর। তবে গ্রহণযোগ্য সূত্রে জানা যায় যে, প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতারও এক হাজার বছর পূর্বে উত্তর চিলি এবং দক্ষিণ পেরুর চিনচেরাতে মমির সংস্কৃতি চালু হয়। ওই অঞ্চলের অধিবাসীরা সমুদ্রের মাছ খেয়ে জীবনযাপন করত।

তবে সব সংস্কৃতি তে মমি তৈরির প্রক্রিয়া এক রকম ছিলো না। এক এক সংস্কৃতিতে এক এক রকম ছিলো। ধারনা করা হয়, কোন কোন রীতিতে পুরো শহরের বাসিন্দাদের মমিকরণ করা হত। সেখানে ধনী আর গরিবের কোনো ভেদাভেদ ছিলো না।  আর অন্যান্য রীতিতে মমিকরণ করা হত সমাজের ধনী এবং উচ্চবর্গীয় মানুষদের মৃতদেহ। যেহেতু বেশিরভাগ ব্যাকটেরিয়া চরম তাপমাত্রায় বাড়তে পারেনা, সেহেতু মৃতদেহকে সূর্যের প্রচণ্ড তাপমাত্রায় রেখে বা হিমায়িত করার মাধ্যমে যে মমিকরণ প্রক্রিয়া পরিচালিত হত তা অনেকটাই অসম্পূর্ণ একটি প্রক্রিয়া ছিল।

মমির প্রকারভেদ:

মমি গুলো সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে।

১।  এন্থ্রোপজেনিক মমি এবং

২। স্পন্টেনিয়াস মমি।

এন্থ্রোপজেনিক মমি বলতে সেই মমিগুলোকে বুঝায় যেগুলোকে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হত। সাধারণত ধর্মীয় কারণে এই ধরনের মমি বানানো হত। যেগুলো আমরা দেখতে পাই মিশরীয় সভ্যতায়।

আর স্পন্টেনিয়াস মমি তৈরি হত প্রাকৃতিক ভাবে, প্রচণ্ড গরম বা তীব্র ঠাণ্ডার মধ্যে অথবা বদ্ধ কোন জলাভূমির মত বায়ু শূন্য অবস্থায়। অধিকাংশ মমি ১ম ধরনের অন্তর্ভুক্ত হলে।

মমি কিভাবে করা হয় ??

মৃতদেহের ইচ্ছাকৃত মমিকরণ প্রথার চল শুরু হয় মিশরে ২য় রাজশাসন (খ্রিস্টপূর্ব ২৮০০ সাল) চলাকালীন সময়ে। ইউনিভার্সিটি অব ইয়র্ক, ম্যাকারি ইউনিভার্সিটি এবং ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড এর ১১ বছরের গবেষণা থেকে জানা যায় যে, অনুমান করা সময়েরও প্রায় ১,৫০০ বছর আগে থেকে মমিকরণের প্রথা চালু হয়। মিশরের মমির উপর অনেক গবেষণা করা হয়েছে এখন পর্যন্ত। সেই প্রাচীন মিশরের লাশ মমি করে রাখার ব্যাপারটা ছিল একটা শৈল্পিক পর্যায়ের কেমিস্ট্রির খেলা। একটা লাশ মমি করতে কমপক্ষে ৭০ দিন সময় লাগতো।

মমিকরণের প্রধান হিসেবে থকতেন একজন পুরোহিত। তিনি মুখে আনুবিশের মুখোশ পড়ে থাকতেন। আনুবিশ হলেন মিশরীয়দের মৃত্যুদেবতা যার মুখ শেয়ালের মুখের মত । মিশরীয়দের বিশ্বাস ছিলো মমিকরণের সাথে আনুবিশ দেবতা জড়িত ছিলেন। তাই মমি করার সময় পুরোহিতরা আনুবিশের মুখোশ পড়ে থাকতো। মমি তৈরির প্রক্রিয়াকে বলা হয় মমিফিকেশন। নিচে এর পদ্ধতিকে ধাপে ধাপে বর্ণনা করা হলঃ

১। প্রথমেই  মৃতদেহটিকে ধুয়ে  খুব  পরিষ্কার করে নেয়া হতো ।

২। মৃতদেহের   তলপেটের বাম দিকে একটা ছিদ্র  করা  হতো এবং সেই ছিদ্র  দিয়ে মৃতদেহ থেকে  নাড়ীভুঁড়ি, যকৃত, ফুসফুস ইত্যাদি বের করে ফেলা হতো । তবে মজার ব্যাপার হলো তারা প্রাচীন মিশরীয়দের ধারনা ছিল মৃতেদের জগতে অর্থাৎ পরপারে মগজের কোনও প্রয়োজন নেই।হুকের মত একটা যন্ত্র ব্যবহার করা হত মাথা থেকে নাক দিয়ে মগজ বের করার জন্যে।  মগজ নাক দিয়ে বের করে ফেলে দেয়া হত।  তবে তারা হার্ট কিংবা হৃদপিণ্ডটাকে খুব নিরাপদে রাখতো। সেখানে ছুঁয়েও দেখতো না। কারণ তারা বিশ্বাস করতো ইহকাল এবং পরকাল উভয়জীবনে মানুষের শক্তির আধার হচ্ছে হার্ট। অতএব হার্টটা শরীরের ভেতরেই থাকতো।

৩।  দেহের অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলো বের করার পর ওই কাটা অংশকে তালের মদ দিয়ে পরিষ্কার করা  হতো। শরীরের ভেতরের অঙ্গগুলো অপসারণের জন্য যে ফাঁকা জায়গা তৈরি হলো, পরিশুদ্ধির জন্য সেই জায়গাটি আবারো তালের মদ  দিয়ে ধুয়ে দেওয়া হতো। এরপর মৃতদেহকে যেন জীবিতের মতোই দেখায়, যেন চামড়া শুকিয়ে গেলে পেটের দিকে তা ভেতরে ঢুকে না যায়, সেজন্য ফাঁকা জায়গাটি ধুপ এবং অন্যান্য পদার্থ দিয়ে ভরাট করে দেয়া হতো।

৪। এবার পুরো দেহটিকে ন্যাট্রন পাউডারে(এক ধরণের লবণ)ঢেকে দেওয়া হতো। এ ন্যাট্রন পাউডার চামড়ার রঙ খুব বেশি পরিবর্তন করা অথবা শক্ত করা ছাড়াই মৃতদেহের জলীয় পদার্থ শোষণ করে নিতো। দেহটিকে এভাবে ৩৫-৪০ দিন ন্যাট্রনের মাঝে রাখা হতো। এ সময়ের মাঝে দেহটি পুরোপুরি শুকিয়ে যেত। তবে মৃতদেহের গন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তো বলে নানা রকম শবভূক প্রাণীর আগমনও ঘটতো। এদের হাত থেকে মৃতদেহকে বাঁচাতে পাহারাদার নিযুক্ত করা হতো।

৫। শুকনো অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো লিলেন কাপড়ে পেঁচিয়ে  ক্যানোপিক জার নামক  বয়ামে ভরে রাখা হত। প্রতিটি বয়ামের ঢাকনাগুলো দেবতা হোরাসের ৪ পুত্র- ইমসেটি, হেপি, কেবেসেনাফ, দুয়ামাটেফ এর আদলে তৈরি ছিল।

৬।  শরীর থেকে লবণ পরিষ্কার করে শুষ্ক চামড়ায় তেলের প্রলেপ দেয়া হত।

৭। কাঠের গুঁড়া এবং কাপড়ের টুকরা দিয়ে শরীর প্যাঁচানো হত এবং কাটা জায়গাটিকে মোম দিয়ে আটকে দেয়া হত।

৮।  তারপর লিলেন কাপড়ের ব্যান্ডেজ দিয়ে ১৫-২০ দিন ধরে প্রায় ২০ ধাপে মৃতদেহটি প্যাঁচিয়ে রাখা হত।

৯। ব্যান্ডেজের উপরে ডেথ মাস্ক বা মৃত্যু মুখোশ বসিয়ে দেয়া হত।

১০।  ব্যান্ডেজে মোড়ানো মৃতদেহটিকে একটা বড় কাপড়ের টুকরায় আবৃত করা হত এবং পড়ে তা লিলেন কাপড়ের টুকরার সাহায্যে শক্ত করে বেঁধে ফেলা হত।

১১। সবশেষে মৃতদেহকে নকশাকৃত মমি কেস বা কফিনে স্থাপন করা হত।

এবার শুরু হতো সমাধিস্থ করার কাজ। সাধারণত কবরের চেয়ে এর আয়তন অনেক বেশি করা হতো, কেননা এতে অতিকায় কাঠের বাক্স সমেত মৃতদেহটিকে রাখতে হতো। তার ওপর মৃতদেহের সঙ্গে তার জীবিতকালে যেসব বস্তু প্রিয় ছিল সেই সমস্ত জিনিস কবরে দেওয়া হত। কারণ তাদের বিশ্বাস ছিল মৃত ব্যক্তির আত্মা পাখির আকৃতি ধারণ করে সারাদিন মনের সুখে এখানে-ওখানে উড়ে বেড়ায়। দিনের শেষে আত্মা আবার নিথর দেহে ফিরে আসে। তাই তাদের জন্য থালা, ঘটি-বাটি থেকে আসবাবপত্রাদি সবই দরকার। এরকম ধারণা থেকে জীবিত মানুষের কাছে যা কিছু অত্যাবশ্যকীয় সবই কবরের মধ্যে দিয়ে দেওয়া হত। কারো জন্য তৈরি হতো বিরাট সমাধিক্ষেত্র, কারো কবর হতো একদম সাদামাটা।

যে চারটি  ক্যানোপিক জারে  তারা শরীরের বিভিন্ন অংশ সংরক্ষণ করতো সেগুলোর শ্রেণিবিভাগ রয়েছে। এক একটা জারে এক এক অংশ থাকতো। সেগুলো হলঃ

১। মানুষের মাথার মত জারটির নাম ইমসেটি।  এই জারে যকৃত রাখা হতো।

২। বেবুনের মাথার মত জারটি হোরাসের পুত্র হোপি। এই জারে রাখা হতো  ফুসফুস।

৩। খেকশিয়ালের মাথার মত দেখতে দুয়ামাটেফ জারে রাখা হত পাকস্থলী।

৪। বাজপাখির মাথার মত দেখতে জারটি হলো   কেবেসেনাফ এর। এখানে রাখা হত অন্ত্র।

মমি বিষয়টাই  অদ্ভুত। এত প্রাচীন কালেও মানুষ বিজ্ঞানের অসাধারণ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে যেভাবে  মমি করার মাধ্যমে মৃত দেহকে সংরক্ষণ করেছে সেটা ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয়।  মমি নিয়ে যেমন অনেক গবেষণাও আছে, তেমনি আকর্ষণীয় অনেক  রহস্যও আছে অনেক মমিকে নিয়ে।  সেসব নিয়ে হয়তো আরেক দিন আলোচনা করা যাবে । তার আগ পর্যন্ত আজ এটুকুতেই সমাপ্তি।

2 Comments

  1. পিরামিডঃ সভ্যতার সবচেয়ে রহস্যময় স্থাপনা | বিজ্ঞানবর্তিকা

    […] মমি বৃত্তান্তঃ কেন এবং কিভাবে করা হত ম… […]

Comments are closed.