ওভারক্লকিং কি ও কেনো?

কম্পিউটার প্রযুক্তির বেলায়, বিশেষ করে গ্রাফিক্স কার্ডের বেলায় আমরা প্রায়সময়েই শুনে থাকি ওভারক্লকিং শব্দটা, যাতে সংক্ষেপে OC বলেও ডাকা হয়। কিন্তু আসলে কি এই OC? এর কাজ কি? OC করলে কি সুবিধা অসুবিধা হয় বা হতে পারে? তা আমরা অনেকেই হয়তো তেমন সুস্পষ্টভাবে জানিনা। তো চলুন তাহলে আজ জেনে নেয়া যাক ওভারক্লকিং এর ব্যাপারে, জেনে নেয়া যাক এর খুঁটিনাটি নানা বিষয়সমূহ…

ওভারক্লকিং কি সেটা জানার আগে আমাদের জানা জরুরী বেস ক্লক কি। আর বেস ক্লক কি সেটা জানার জন্যে আমাদের জানা দরকার ক্লক রেট কি। তো আসুন প্রথমেই জেনে নিই ক্লক রেট (Clock Rate) এর ব্যাপারে।

একটা প্রসেসরের ক্লক রেট হচ্ছে মূলত তার ভেতরে থাকা Crystal Oscillator থেকে ছাড়া তরঙ্গের মাত্রা (Frequency Rate)। প্রতিটা তরঙ্গ বা Frequency একবার করে কোনো এক সাইকেল বা চক্রণ পুরণ করলে তাকে বলে হাটর্জ।

 

একে ঘড়ির কাটার পুরোটা একবার ঘুরে আসার সাথে তুলনা হয়। মনে করুন একটা ঘড়ির কাটা প্রতিবার ঘুরে এসে একটা করে সিগন্যাল প্রদান করছে যা On – Off সিগন্যাল বা বাইনারি সিগন্যাল বা মেশিন সিগন্যাল হিসেবে যাচ্ছে। এই একেকটা সিগন্যাল যেহেতু তরঙ্গ হিসেবে ছাড়া হচ্ছে সেহেতু একেকটা সিগন্যাল হল একেকটা হার্জ। কোনো Oscillator কোনো একটা Thread (প্রসেসরের খন্ডিত অংশ) থেকে প্রতি সেকেন্ডে যে পরিমাণ তরঙ্গ ছাড়বে তার ক্লক বা ঘড়ির কাটার হিসেবেও ততবারই ঘুরে আসবে। কোনো থ্রেড যদি সেকেন্ডে এক হাজার বার বা তার বেশি বার ক্লক পুরণ করে তাহলে তার ক্লক রেট হবে কিলোহার্টজ হিসেবে (কিলো = হাজার)। তদ্রুপ কোনো প্রসেসর এর প্রতিটা থ্রেড যদি প্রতি সেকেন্ডে দশ লাখ বা এক মিলিয়ন বার তরঙ্গ ছাড়ে মানে দশ লাখ বার তার ক্লকিং পুরণ করে তাহলে তার ক্লক রেট হবে 1 মেগাহার্টজ (মেগা = মিলিয়ন)।
সুতরাং বুঝতেই পারছেন 3.4 Gigahertz (গিগা = একশ কোটি বা এক বিলিয়ন) এর একটা প্রসেসর এর প্রতিটা থ্রেড এর প্রতি সেকেন্ড এ ক্লক রেট হল 3.4 x 1000000000 = 3400000000 হার্টজ। এরমানে সেই প্রসেসর এর প্রতিটা থ্রেড প্রতি সেকেন্ড এ সাধারণ সীমায় সর্বোচ্চ তিনশ চল্লিশ কোটিবার সংকেত বা সিগন্যাল প্রদান করছে!
প্রতি সেকেন্ড এ এই সংকেত এর হার এ কম/বেশি হলে যেহেতু কাজের সময়ও বেশি/কম লাগছে সেহেতু এই ক্লক রেটকে ক্লক স্পীডও বলা হয়। ক্লক রেট পুরো প্রসেসরের নয় বরঞ্চ প্রসেসরের প্রতিটা Thread এর হিসেবে ধরা হয়।

বেইস ক্লক

প্রতিটা প্রসেসরে ফিজিক্যাল কোর যতগুলো, থ্রেড ততগুলো বা তার দিগুণ বা তিনগুন ইত্যাদি হতে পারে। একটা প্রসেসর সবগুলো থ্রেড এর ক্লকিং মিলিয়েই কাজ করে। প্রতিটা Thread বা Core এর ক্লক রেট এর সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ সীমা থাকে যেটা প্রসেসর চলতে থাকা প্রোগ্রামের ডেটা প্রক্রিয়াকরণের উপর নির্ভর করে নিয়ন্ত্রন করে। আর ক্লক রেটের এই সাধারণ সীমাই হচ্ছে একটা প্রসেসরের বেইস ক্লক (Base Clock)। প্রসেসর একেকটা প্রোগ্রামের প্রতি সেকেন্ড এ ডেটা গ্রহণের প্রয়োজনীতা অনুযায়ী সয়ংক্রীয় বর্তনী ব্যবস্থায় তার বেইস ক্লক এর আওতার মধ্যে প্রতি সেকেন্ডে ফ্রিকোয়েন্সি সিগন্যাল প্রদান করে থাকে। এর জন্যে কোনো প্রোগ্রামে সমান পরিমাণ core ও thread এর প্রয়োজন পড়েনা।
তবে একটা প্রসেসরের ক্লক রেটই কিন্তু সব না। প্রসেসরের ক্লক রেট এর পাশাপাশি খুবই গুরুত্বপূর্ণ জিনীস হল এর IPC বা Instruction Per Cycle । মানে প্রতিটা ফ্রিকোয়েন্সি সিগন্যাল বা ক্লক সাইকেল এ একটা প্রসেসরের প্রতিটা থ্রেড কি পরিমাণ নির্দেশনা প্রক্রিয়াকরণ করছে তাই হচ্ছে একটা প্রসেসরের IPC। তার উপর রয়েছে প্রসেসরের সাইকেল পুরণের জন্যে প্রয়োজনীয় মেমোরি যাকে বলে Cache Memory। আর এসবের ভিন্নতার জন্যেই অনেকসময় প্রসেসর নির্মাতা কোম্পানী AMD তাদের প্রসেসরের Intel এর একই প্রজন্মের (Generation) প্রসেসরের চাইতে অনেক বেশি কোর, থ্রেড আর ক্লক স্পীড দিলেও অনেকসময় অনেকক্ষেত্রে Intel থেকে পিছেই রয়ে যায়।

Overclocking বা OC

এবার আসি তাহলে আমাদের আলোচনার মূল বিষয় ওভারক্লকিং এ। এবিষয়ে আসার আগে পূর্বের জিনীসগুলো নিয়ে আমরা আলোচনা করে নিলাম বলে এখন ওভারক্লকিং ব্যাপারটা আমাদের খুব সহজেই বোধগম্য হবে।

আরো ভালভাবে বললে বিভিন্ন প্রসেসর ও গ্রাফিক্স কার্ড নির্মাতারা তাদের প্রসেসরসমুহের যে সাধারণ সীমা নির্ধারিত করে দেয় সেটা উপেক্ষা করে প্রসেসরকে আরো বেশি ক্লক স্পীড পার সেকেন্ডে চালনা করা। ওভারক্লকিং করার জন্যে প্রসেসরের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট মাদারবোর্ড প্রয়োজন পড়ে এবং Overclockable প্রসেসর বা কার্ডের পাশে OC বা OC Edition লেখা থাকে।

যদিও বিভিন্ন কম্পিউটার যন্ত্রাংশে এসব দেয়া থাকে তারপরেও ওভারক্লকিং কোনো দিক বিবেচনাতেই প্রসেসরের জন্যে উপকারী নয়। একটা মানুষকে যেমন তার সর্বোচ্চ কর্মক্ষমতার চাইতে বেশি কাজ করানোতে বাধ্য করা হলে মানুষটার ভয়ানকরকমের ক্ষতি এমনকি মৃত্যুও হতে পারে, ওভারক্লকিং করলেও প্রসেসরের বেলায় তেমন অঘটন ঘটতে পারে।
যেহেতু প্রতিটা প্রসেসরই তাদের ক্লক ফ্রিকোয়েন্সি তে বৈদ্যুতিক সংকেত আদানপ্রদান করে, সেহেতু এগুলো উত্তপ্ত হয় এবং সেই তাপ সহ্যক্ষমতা ও তাপকে নিয়ন্ত্রন করার ক্ষমতার উপর নির্ভর করে প্রতিটা প্রসেসর ও সেগুলোর সাথে থাকা Stock Cooling System বানানো হয়। এখন যদি কোনো প্রসেসর বা কার্ড ওভারক্লক করা হয় তাহলে কিন্তু তা তার স্বাভাবিক ফ্রিকোয়েন্সির বাইরে গিয়ে ক্লকিং শুরু করবে। ফলস্বরুপ তাতে প্রসেসরের যেমন শক্তিও লাগবে বেশি তেমনি তা তাপও উৎপন্ন করবে বেশি। অর্থাৎ তা কোম্পানীর নির্ধারণ করে দেয়া ফ্রিকোয়েন্সির বেশি ফ্রিকোয়েন্সিতে উঠে আসার ফলে প্রসেসর তার স্বাভাবিক সহ্যক্ষমতা থেকে বেশি তাপ উৎপন্ন করে বসবে। ফলে সাথে দেয়া স্টিক কুলারের Heatsink ও Cooling Fanও পর্যাপ্ত তাপ শোষণ ও বিলীন করতে পারবেনা। ফলস্বরুপ, প্রসেসরের ভয়ানক ক্ষতি হয়ে বসতে পারে। এই ক্ষতি সবসময় হয়তো হুট করে ধরা যাবে না কিন্তু এর ফলে প্রসেসরের পিন পুড়ে যেতে পারে, চিপবোর্ডে সমস্যা হতে পারে, নানারুপ ড্যামেজ হতে পারে বা এমনকি প্রসেসর পুরোপুরি ফেইলও (কর্মক্ষম) হয়ে যেতে পারে!

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে “তাহলে বিভিন্ন কার্ড নির্মাতা কোম্পানী কেনো তাহলে তাদের কার্ডের বক্স এ OC লিখে রাখে?”

ভাই সত্যি বলতে এটা নেহায়েতই বাণিজ্যিক কৌশল বা Industrial Trick বৈ আর কিছুই নয়। কারণ হয় তারা তাদের যন্ত্রাংশের সাধারণ সর্বোচ্চসীমাকেই OC বলে চালায় অথবা ক্রেতাকে আকৃষ্ট করার জন্যে এবং প্রোডাক্ট প্রতি বেশি লাভের উদ্দ্যেশ্যেই একাজ করে থাকে। কথাটা শুনতে খারাপ লাগুক বা ভাল, সত্যিটা এমনই। বড় বড় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের পন্য বিক্রয়ের জন্যে নানারকম কলাকৌশল অবলম্বন করেই থাকে। অথচ বেইস ক্লক কে জোরজুলুম করে বাড়িয়ে OC করলে কিন্তু পার্ফর্মেন্স এ তেমন আহামরি কোনো পার্থক্যই আসেনা। অথচ আজকাল অনেককেই দেখা যায় OC এডিশন বলতেই আত্মহারা! অথচ যতবার আপনি আপনার প্রসেসিং ইউনিটগুলোকে OC করছেন, ততবারই তাকে জোরজার করে আপনি মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছেন। অথচ সে অনুযায়ী আপনি আহামরি ফলাফল কিন্তু পাচ্ছেন না। আপনার বিশ মিনিটের রেন্ডার দশ মিনিট বা পনেরো মিনিটেও শেষ হয়ে যাচ্ছেনা। আপনার গেমের গড় FPS (Frame Per Second) 40 থেকে বেড়ে 60/65 হয়ে যাচ্ছেনা। কিন্তু এদিকে আপনার প্রসেসর ক্ষতি আর ঝুঁকির সম্মুখীন ঠিকই হচ্ছে।

তাহলে কি OC করবো না?

জবাব হল “না”, করবেন না। আসলেই করবেন না। অন্তত প্রসেসরের বেলায় তো না ই। OC কোনো প্রসেসরের ব্যবহারের স্বাভাবিক বিধির মধ্যে পড়েই না। পড়লে সেটা OC না হয়ে Base Clock বা হয়তো Turbo Clock ই হত। সুতরাং অযথাই OC এর পেছনে না ছুটে আপনার কাজ ও উদ্দেশ্য অনুযায়ী ভাল, উপযোগী কোনো প্রসেসর আর কার্ড কিনুন সেটাকে তার স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা অনুযায়ী সুন্দরমত গুছিয়ে ব্যবহার করুন। কাজ করার জন্যে প্রসেসরে অস্বাভাবিক বাড়তি চাপ না দিয়ে বরঞ্চ আপনার কাজের বাইরে অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় Task এ প্রসেসরের ব্যবহার বন্ধ করে রাখুন, অন্যান্য দিকে প্রসেসরের চাপ কমিয়ে রাখুন।
মনে রাখবেন, মাত্র একবার ভুলভাল OC এর জন্যেও আপনার সাধের প্রসেসর স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। সুতরাং OC ব্যাপারটাকে এড়িয়ে চলুন, আপনার প্রসেসর, এর তাপমাত্রা (স্বাভাবিক ৪০-৮০) ও কুলিং সিস্টেমের দিকে খেয়াল রাখুন।

OC নিয়ে আজকের আলোচনা এপর্যন্তই। এরপর আবারো হয়তো কথা হবে অন্য কোনো বিষয়ে। ততক্ষণ ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন, নিজের ও আপনার কম্পিউটারের খেয়াল রাখুন…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>