পাই দিবস এবং একজন আইনস্টাইনের জন্মদিন!

সবকিছুরই শুরু আছে, শেষ হয়ে যায়!     
সত্যিই কি তাই?
এই কথাটি খাটে না যার ক্ষেত্রে
তিনিই হচ্ছেন মহামতি পাই!

আজ থেকে ৪,০০০ বছর পূর্বে পাই নামক এই সৌন্দর্য্যমন্ডিত সংখ্যার সাথে পরিচয় ঘটে আমাদের। কিন্তু আপনি যদি এই ৪,০০০ বছরে যত সেকেন্ড আছে তা হিসেব করে তত সংখ্যক স্থান পর্যন্ত পাইয়ের মান বের করতে চান তবুও আপনি পাইয়ের সঠিক মানের কাছাকাছি যেতে পারবেন মাত্র কিন্তু এর সঠিক মানটি বের করতে পারবেন না।

পাইয়ের মান দশমিকের পর অসীম পর্যন্ত যায় মানে পাই এর মানের শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। এবং এর মধ্যে কোনরকম প্যাটার্ন নেই। দশমিক এর পরে এর ডিজিট গুলো অনেকটা র‍্যান্ডমলি বা দৈব ভাবে আসতে থাকে।

ব্যবিলনীয় মিশরীয়রা পাইয়ের ব্যাপারটা জানতো। গ্রিকরা পাই নামকরণটি করেছিল। সেই থেকেই পাইয়ের মান বের করার চেষ্টা চালিয়ে আসছে মানুষ। প্রাচীন ব্যাবিলনের লোকেরা পাই এর মান বের করেছিল ২৫/৮, মিশরের লোকেরা বের করেছিল ২৫৬/৮১ হিসেবে। আশ্চর্য হলেও সত্যি যে এই মান গুলো পাই এর আসল মানের খুব কাছাকাছি।

প্রায় ৪০০০ বছর আগের প্রাচীন ব্যাবিলিয়নরা বৃত্তের ব্যাসার্ধের বর্গকে ৩ দ্বারা গুণ করে বৃত্তের ক্ষেত্রফল নির্ণয় করত। তাদের গণনা থেকে পাইয়ের মান পাওয়া যায় ৩ ।

খ্রিষ্টপূর্ব ১৭০০ সালের দিকের ব্যাবিলিয়নদের একটি ট্যাবলেটে পাইয়ের মান পাওয়া যায় ৩.১২৫ । যা সত্যই অসাধারণ । ট্যাবলেট হল প্রস্তর দ্বারা নির্মিত এক ধরণের ফলক যাতে নানা নকশা ও লেখা খোদাই করা থাকে ।

খ্রিষ্টপূর্ব ১৬৫০ সালের দিকের রাইন্ড প্যাপিরাসের মাধ্যমে প্রাচীন ইজিপ্টের গণিত সম্পর্কে জানা যায় । ইজিপশিয়ানরা বৃত্তের ক্ষেত্রফল মাপার জন্য পাইয়ের যে মান ব্যবহার করত তা হল ৩.১৬০৫ যা বর্তমান পাইয়ের মানের অনেক কাছাকাছি ।

গ্রীক বিজ্ঞানী আর্কিমিডিস পাই নিয়ে কাজ করেছিলেন যীশু খ্রিস্ট বা ঈসা (আ) এর জন্মেরও প্রায় আড়াইশ বছর পূর্বে। দূর্ভাগ্যজনকভাবে পাই তাঁর মৃত্যুরও কারণ। কথিত আছে, আর্কিমিডিস যখন পাই এর মান বের করার জন্যে জটিল গণনায় ব্যস্ত তখন তার শহরে যুদ্ধ লেগে গেলো এবং এক সৈন্য তার হিসেবের মাঝে এসে ঝামেলা করলো। আর্কিমিডিস তখন কাঠি দিয়ে মাটিতে অংক কষছিলেন। বিরক্ত হয়ে আর্কিমিডিস বলেছিলেন, আমার হিসেবের মাঝে ঝামেলা করো না তো। এই কথা শুনেই এক কোপে তার দেহ থেকে মাথা আলাদ করে দেন। এবং এরই সাথে আর্কিমিডিসের সকল হিসেব নিকেশের অবসান ঘটে।

এই মহান গণিতবিদ প্রথম পাইয়ের মান হিসাব করার জন্য একটি বৃত্তের ভেতর এবং বাহিরে দুটি ষড়ভুজ আঁকেন যেন এদের বাহুগুলো পরিধিকে স্পর্শ করে থাকে। কিন্তু ষড়ভুজের পরিধি এবং তার ব্যাসের অনুপাত কম বেশী হওয়ার কারণে পাই এর মানে গোলমেলে হয়ে যায়।

তখন তিনি বৃত্তটির ভেতরে ১২, ২৪, ৪৮ ইত্যাদি সংখ্যক বাহুবিশিষ্ট বহুভুজ অংকন করেন । যত বেশী বাহুবিশিষ্ট বহুভুজ নেয়া যায় ততই তার পরিধি বৃত্তের পরিধির কাছাকাছি আসতে থাকে। শেষ পর্যন্ত তিনি দেখান যে পাইয়ের মান ২২/৭ এবং ২২৩/৭১ এর মাঝামাঝি ।

ভারতীয় গণিতবিদ আর্যভট্ট পাই এর আসন্ন মান নির্ণয়ের সূত্র দেন । তিনি Aryabhatiyam বইয়ের ২য় খন্ড (gaṇitapāda 10) তে লিখেন :

caturadhikam śatamaṣṭaguṇam dvāṣaṣṭistathā sahasrāṇām
ayutadvayaviṣkambhasyāsanno vṛttapariṇāhaḥ.

অনুবাদটি অনেকটা এরকম “১০০ এর সাথে ৪ যোগ করে ৮ দ্বারা গুণ করে ৬২০০০ যোগ করে পাওয়া যায় বৃত্তের পরিধি। যাকে ব্যাস ২০০০০ দ্বারা ভাগ করলে পাই এর আসন্ন মান পাওয়া যাবে। “গণনা করলে যার মান আসবে ৩.১৪১৬, মানে ৬২৮৩২/২০০০০ = ৩.১৪১৬। তাঁর সূত্র থেকে প্রাপ্ত মান এখনও ব্যবহৃত হচ্ছে।

  • ৫০০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে জু চংঝি নামে একজন চীনা গণিতবিদ পাইয়ের একটি নিখুঁত মান বের করেন । তা হল ৩৫৫/১১৩ । এই মানটি বের করার জন্য তিনি একটি বৃত্তের ভেতরে ২৪,৫৭৬ টি বাহুবিশিষ্ট বহুভুজ ব্যবহার করেন।
  • ১৬১০ সালে একজন জার্মান গণিতবিদ পাইয়ের মান দশমিকের পর ৩৫ ঘর পর্যন্ত নির্ণয় করেন।
  • ১৭৮৯ সালে স্লোভেনিয়ার একজন গণিতবিদ ১৪০ ঘর পর্যন্ত,
  • ১৮৭৩ সালে একজন ইংরেজ গণিতবিদ ২০ বছর সাধনা করে ৭০৭ ঘর পর্যন্ত নির্ণয় করে। পরে দেখা যায়, তার নির্ণয়কৃত সংখ্যা ৫২৮তম ঘর পর্যন্ত সঠিক, এরপরের সবই ভুল।
  • ২০০২ সালে এক জাপানী গণিতবিদ পাইয়ের বিশাল একটা মান বের করেছে। তার সংখ্যায় মোট ডিজিট ছিল ১,২৪১,১০০,০০০,০০০টি।
  • ২০১০ সালে Nicholas Sze নামের একজন গবেষক ২,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০ তম ঘর পর্যন্ত পাই এর মান নির্ণয় করেন। এটি করতে Nicholas Sze ইয়াহুর হডোপ ক্লাউড কম্পিউটিং প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। কাজটি করতে ইয়াহুর ১০০০ টি কম্পিউটার এর ২৩ দিন সময় লাগে যে কাজটি সাধারণ কম্পিউটার এর লাগতো ৫০০ বছর।  পাই এর এক মিলিয়ন পর্যন্ত মান জানতে এই লিংকে ভিজিট করুন। 

আজ ১৪ই মার্চ। বিশ্ব পাই দিবস। পাই এর মান সাধারণত ৩.১৪ হিসেবে ধরা হয়। সেই সূত্রেই আজ পাই দিবস(৩-১৪ মানে মার্চ মাসের ১৪ তারিখ)। ১৪ই মার্চ দুপুর ১টা ৫৯ মিনিটকে পাই মিনিট নামে আখ্যায়িত করা হয়। এবং দুপুর ১টা ৫৯ মিনিট ২৬ সেকেন্ডকে বলা হয় পাই সেকেন্ড।

১৯৮৮ সালে প্রথমবারের মতো পাই দিবস পালিত হয় সানফ্রানসিসকো-এর একটি বিজ্ঞান জাদুঘরে। জাদুঘরের বৃত্তাকার স্থানে এর কর্মচারী ও দর্শনার্থীরা মিলে কেক (পাই) খেয়ে দিনটি উদযাপন করেন। ঐ জাদুঘরের কর্মকর্তা ল্যারি শ এই দিবস উদযাপনের উদ্যোক্তা বলে তাকে “পাই‌‌-এর রাজপুত্র” বলা হয়।

২০০৬ সাল থেকে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির উদ্যোগে বাংলাদেশে এই দিবস উদযাপন শুরু হয়। দেশের বেশ কিছু গণিত ক্লাব ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নানা আয়োজনের মধ্যে দিবসটি পালন করা হয়। আয়োজনের মধ্যে রয়েছে পাই শোভাযাত্রা, পাই-এর মান বলা, পাই নিয়ে আলোচনা ইত্যাদি। এছাড়া রয়েছে পাই দিবসের শুভেচ্ছা বিনিময়।

পাইফিলোলজি হল দশমিক এর পরে π এর মান স্মরণ রাখার বিদ্যা এবং যে দশমিক এর পরে সবচেয়ে বেশী ঘর পর্যন্ত বলতে পারেন তার নাম গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস এ লেখা হয়ে থাকে। Wikipedia সর্বশেষ তথ্য মতে এই রেকর্ডটি একজন ভারতীয় এর দখলে। তার নাম রাজবীর মিনা। তিনি দশমিকের পরে ৭০ হাজার ডিজিট পর্যন্ত বলতে পেরেছিলেন এবং এতে তার সর্বমোট সময় লেগেছিল ৯ ঘন্টা ২৭ মিনিট।
২০০৬ সালে, অবসরপ্রাপ্ত জাপানি প্রকৌশলী আকিরা হারাগুচি, ১০০০০০ দশমিক স্থান পড়তে পারেন বলে দাবি করেন, তবে দাবিটি গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস দ্বারা যাচাই করা হয়নি।
π এর মান মনে রাখার একটি সাধারণ কৌশল হলো একটি গল্প বা কবিতা মনে রাখা যার শব্দ দৈর্ঘ্য π এর মানের প্রতিনিধিত্ব করে।

কবিতা গুলোর প্রথম শব্দটির তিনটি অক্ষর থাকে, দ্বিতীয় শব্দটি এক, তৃতীয়টির চারটি, চতুর্থটির এক, পাঁচ ভাগের পাঁচটি এভাবে চলতে থাকে।

এটি মূলত ইংরেজি বিজ্ঞানী জেমস জিনস দ্বারা পরিকল্পিত একটি memorization পদ্ধতি।
কবিতার একটি উদাহরণ:

How I need a drink,
alcoholic in nature (or of course)
after the heavy lectures
involving quantum mechanics

প্রথম লাইনটা , How (৩) I (১) need (৪) a (১) drink (৫) এবং ২য় লাইনে alcoholic (৯) in (২)…… যাকে মূলত পাইয়ের মান নিয়ে লেখা ক্রিপ্টোগ্রাফি বলা যেতে পারে।

পাই নিয়ে এ পর্যন্ত হাজারখানেক বই লেখা হয়েছে। পাই নিয়ে যতই লিখি সেটা পাই এর মানের মতোই শেষ হবার নয়। ৩ ঘন্টা ১৪ মিনিট ১৫ সেকেন্ডে যতটুকু লিখতে পেরেছি ততটুকু দিয়েই আপাতত ইতি টানলাম।
সবাইকে পাই দিবসের শুভেচ্ছা।

সবশেষে আজকে আপেক্ষিকতার তত্ত্ব প্রদানের জন্য বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনেরও জন্মদিন।
এই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ পদার্থবিদ আলবার্ট আইনস্টাইনকে জানাই শুভ জন্মদিন।

তথ্যসূত্র :
১- Wikipedia
২- http://www.bbc.com/news/technology-11313194

2 Comments

  1. Matin Siddique

    পাই এর নাম কি করে হলো ?

  2. Shawon

    গ্রীক অক্ষর π এর ল্যাটিন নাম হলো “পাই।” গাণিতিক প্রতীক হিসাবে প্রথম অক্ষরটি ব্যবহার করেন গণিতবিদ উইলিয়ম জোনস 1706 সালে। গ্রিক περιφέρεια, অর্থ “পরিধি,” এর প্রথম অক্ষর π। এখান থেকেই π নামটির উৎপত্তি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>