ডিম আগে না মুরগি আগে?

একটা ধাঁধা আছে না, যেটি বছরের পর বছর এখনও আমাদের তর্কের অন্যতম বিষয় হয়ে রয়েছে। কাউকে নাজেহাল করতেই হোক অথবা কারও বিদ্যার দৌড়কে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই হোক, এই একটি ধাঁধা দিয়ে ঠিকই কাউকে না কাউকে কখনও না কখনও নাস্তানাবুদ করেননি বা নিজে হননি তা কেউ বলতে পারবেন না। শিরোনাম দেখে আপনারা হয়তো আগেই বুঝে ফেলেছেন যে আমি আসলে কিসের কথা বলছি। হ্যাঁ, আপনারা ঠিকই ধরেছেন। আজকের বিষয় হচ্ছে, কোনটি আগে এসেছে, ডিম নাকি মুরগি? এখানে আসলে একটু মাথা খাটানোর দরকার। কারণ, ডিম পাড়ার জন্য আপনার একটি মুরগি লাগবে। আবার অন্যদিকে, মুরগি কিন্তু ডিম থেকেই আসে! সারাদিন একনাগাড়ে বাকবিতণ্ডা করতে থাকলেও এর কোনও সুরাহা সহজে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
সারাদিন এই প্রশ্নে আর তা দেবার দরকার নেই। বিজ্ঞানের কল্যাণে এখন এই অসম্ভব ধাঁধারও উত্তর রয়েছে। চমৎকার ব্যাখ্যার মাধ্যমে ঠিকই এর সুরাহা করা যায়। আরও ভালভাবে বললে বলতে হয়, বিবর্তনিক জীববিজ্ঞানের মাধ্যমেই এর চমৎকার একটি সমাধান বের করা হয়েছে। তো চলুন, ডিমের খোসা ভাঙতে শুরু করি!


প্রাথমিক ডিমের চিত্র:

প্রাণিজগতের সর্বত্রই আমরা ডিমের দেখা পাই। ডিম বলতে আমরা যা বুঝি তা হল, এটি হচ্ছে পর্দাবৃত এক প্রকার ফাঁকা স্থান, যার মধ্যখানে ভ্রূণের বেঁচে থাকার জন্য জন্য সকল প্রকার ব্যবস্থা তৈরি থাকে। ভ্রূণটি এর মধ্যেই জন্ম নেয় এবং এর মধ্যেই বেড়ে ওঠে।

তার আগে চলুন আমাদের পরিচিত কিছু শ্রেণির পাখির ডিমের ওপর নজর বুলিয়ে আসি। মিলিয়ন মিলিয়ন বছর আগে সর্বপ্রথম অ্যামনিওটদের মধ্যে ঘটে যাওয়া বিবর্তনের ফলেই আজ আমাদের সামনে এমন নানা প্রকারের ডিমের দেখা মিলছে। এদের আবির্ভাবের পূর্বে, অধিকাংশ প্রাণীই তাদের প্রজননের জন্যে জলজ পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল ছিল। তারা যেকোনো জলাশয় বা আর্দ্র পরিবেশে ডিম পাড়ত যাতে করে ডিমগুলো শুকিয়ে যেতে না পারে।
এর মাঝে কোনও এক সময় একটু অন্যরকম ডিমের বিকাশ ঘটতে শুরু করে। এই ডিমগুলোর ভেতর তিনটি অতিরিক্ত পর্দা বা মেমব্রেন রয়েছে – করিয়ন (Chorion), অ্যামনিয়ন (Amnion) এবং অ্যালান্টয়িস (Allantois)। প্রত্যেক পর্দারই সামান্য আলাদা আলাদা কিছু কাজ রয়েছে। এই অতিরিক্ত স্তরগুলো একটি সুসংবদ্ধ আবদ্ধ স্থানের সৃষ্টি করে, যেখানে এক কথায় একটি ভ্রূণের জীবন ধারণের জন্য সকল ব্যবস্থা থাকে। ভ্রূণ এর মধ্যে জমা থাকা পুষ্টি উপাদানগুলো ব্যবহার করতে পারে, সৃষ্ট অতিরিক্ত বর্জ্য পদার্থ জমা রাখতে পারে, এবং বহিঃজলীয় পরিবেশের অনুপস্থিতিতেও শ্বাসকার্য চালিয়ে যেতে পারে। অ্যামনিয়নে আবদ্ধ অতিরিক্ত তরল পদার্থ এবং সাথে বাইরের কঠিন শক্ত খোসা একে আরও সুরক্ষা প্রদান করেছে।

এই অ্যামনিওটিক ডিমগুলো ছিল একটি বিরাট ব্যাপার। তারা স্থলজ পরিবেশে ডিমপাড়ার ক্ষেত্রে এক বিশাল সুযোগের দুনিয়া খুলে দিয়েছিল। এর অতিরিক্ত মেমব্রেনসমূহ আরও বড় এবং আরও উন্নত ডিমের বিকাশের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। এখন পর্যন্ত আমরা নিশ্চিত নই যে ঠিক কোন সময়ে এই ঘটনার অভ্যুত্থান হল। তার কারণ হচ্ছে, ডিমের মেমব্রেন ভাল ফসিল তৈরি করতে পারে না। ফলে বিজ্ঞানীরা এখনও পরিষ্কার নন যে ঠিক কখন এবং কীভাবে অ্যামনিওটিক ডিমের বিকাশ ঘটে। সবচেয়ে ভাল ধারণা থেকে বলা যায়, চতুষ্পদী (Tetrapods; চার পা ওয়ালা মেরুদণ্ডী প্রাণী) এবং অ্যামনিওট (চতুষ্পদী মেরুদণ্ডী প্রাণী, যারা অতিরিক্ত তিন স্তরযুক্ত ডিম পাড়ে) – এদের সর্বশেষ সাধারণ পূর্বপুরুষ ৩৭০-৩৪০ মিলিয়ন বছর আগে বেঁচে ছিল। যদিও কোনও কোনও জায়গায় বলা হয়ে থাকে, সর্বপ্রথম অ্যামনিওট প্রজাতি ৩১২ মিলিয়ন বছর আগে বসবাস করত। আজকের স্তন্যপায়ী, সরীসৃপ এবং পক্ষীকুল – সমস্ত কিছুই সেই প্রথম অ্যামনিওটদেরই উত্তরসূরি।
এখানে কিন্তু আবার সেই আগের প্রশ্নটিই ঘুরে ফিরে চলে আসে – কোনটি আগে, অ্যামনিওট নাকি অ্যামনিওটের ডিম!
ডিম নিয়ে তো দু-চার কথা হল। চলুন এবার নাহয় মুরগি বেচারির কাছে যাওয়া যাক!

প্রথম মুরগি:

সর্বপ্রথম যে মুরগির আবির্ভাব পৃথিবীতে ঘটে তা ছিল এক বা একাধিক মিউটেশনের ফসল। এই মিউটেশন ঘটেছিল দুটি প্রায়-মুরগি অথবা আদি মুরগির প্রজননের ফলে সৃষ্ট জাইগোটে। তার মানে, এই আদি-মুরগি দুটির মিলনে যে জাইগোট সৃষ্টি হয়, তার নতুন ডিএনএ বিন্যাসের ফলে সর্বপ্রথম মুরগির সর্বপ্রথম কোষের আবির্ভাব ঘটে। এই সময় প্রথম কোষটিতে মিউটেশন ঘটে, যা অনুলিপিত হয়ে ভ্রূণের বিকাশের সময় অন্যান্য কোষেও স্থানান্তরিত হয়। ফলাফল দাঁড়ায়, জিনগত সত্যিকারের মুরগি!
এখন আপনার মনে একটি প্রশ্ন আসতেই পারে, সেই প্রথম দিককার সত্যিকারের মুরগিগুলো দেখতে কেমন ছিল? এর উত্তর হচ্ছে ‘রেড জাঙ্গেল ফাউল’ (Red junglefowl); বৈজ্ঞানিক নাম – Gallus gallus। এদেরকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ভারত, দক্ষিণ চীন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর-এ দেখতে পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, এই কম হিংস্র এবং অতিপ্রজ ডিমদাতা মুরগিটি এশিয়াতেই সর্বপ্রথম মানুষের দ্বারা গৃহপালিত হয়। ডিম উৎপাদনশীল মুরগি হিসেবে রেড জাঙ্গল ফাউল বর্তমানে বিশ্বজুড়ে খুবই জনপ্রিয় একটি প্রজাতি (Gallus gallus domesticus)।

প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ বলে যে রেড জাঙ্গল ফাউল প্রায় দশ হাজার বছর আগে থেকে গৃহপালিত। তবে ডিএনএ অ্যানালাইসিস এবং গাণিতিক ব্যাখ্যা থেকে জানা যায় যে গৃহপালিত মুরগি জাঙ্গল ফাউলেরও আগে থেকেই, প্রায় আটান্ন হাজার বছর আগেই ছিল। আরও এক প্রমাণ থেকে দেখা যায় যে গৃহপালিত মুরগির উদ্ভব কিছুটা জটিল পথে হতে পারে। যেমন, অনেক মুরগির পায়ের হলুদ রঙের জন্য দায়ী জিন কিন্তু গ্রে জাঙ্গল ফাউল (Grey junglefowl; বৈজ্ঞানিক নাম: Gallus sonneratii), রেড জাঙ্গল ফাউল নয়। এখানে স্পষ্ট বোঝাই যাচ্ছে যে সংকরায়নের মাধ্যমেই এই সুনির্দিষ্ট পরিবর্তন এসেছে।
আবার আমাদের আসল বিষয়ে ফিরে যাওয়া যাক। এতক্ষণ যেহেতু বিস্তর বিবর্তনিক প্রমাণের মাধ্যমে দেখলাম যে,

অ্যামনিওটিক ডিমের আবির্ভাব ঘটে ৩৪০ মিলিয়ন বা তারও আগে এবং প্রথম মুরগির বিকাশ ঘটে ৫৮ হাজার বছর পূর্বে, সেহেতু এটা বলাই নিরাপদ যে ডিমই আগে!

প্রথম মুরগির-ডিম:

তবে থামুন! কোনও বিজ্ঞানীই কী ‘আগে মুরগি’ – এই মতের পক্ষে নেই?
এখনই খুশি বা হতাশ হবার কোনও কারণ নেই। কিছু বিজ্ঞানী কিন্তু এখনও প্রথমে মুরগির আগমন হয়েছে বলতেই বেশি পছন্দ করেন। কয়েকজন গবেষকের এমন দাবি এসেছে মুরগির ডিমের খোসার গঠন ও এর প্রক্রিয়ার উপর করা গবেষণা থেকে।
ডিমের খোলস অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ক্যালসিয়াম কার্বনেট (CaCO3) দিয়ে গঠিত। মুরগি তার ডিমের খোলসের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যালসিয়ামের সরবরাহ বিভিন্ন খাদ্য উৎস, যেমন অয়স্টার অথবা চিংড়ির খোলসের মত ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ প্রিয় সব খাবার থেকে মিটিয়ে থাকে।


খোলস তৈরির জন্য প্রথমে ক্যালসিয়ামকে ক্যালসিয়াম কার্বনেট স্ফটিকে পরিণত হতে হয়। এই প্রক্রিয়া চালুর জন্য মুরগি কয়েকটি নির্দিষ্ট প্রোটিনের ওপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে একটি প্রোটিন হচ্ছে, ওভোক্লেইডিন-১৭ (Ovocleidin-17 বা সংক্ষেপে OC-17)। উক্ত প্রোটিনটি কেবলমাত্র মুরগির ডিম্বাশয়েই পাওয়া যায়। দেখা যাচ্ছে যে, OC-17 ছাড়া মুরগির ডিম উৎপাদন সম্ভব নয়! সেই যুক্তিতে বলাই যায় যে, মুরগির-ডিম উৎপাদনের জন্য অবশ্যই একটি মুরগিকে আগে জন্ম নিতে হবে!
আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে, OC-17 প্রোটিনটি ডিমের খোলসের উৎপাদনের হার বৃদ্ধির জন্য কার্যকরভাবে দায়ী। যার জন্য, মুরগি ২৪ ঘণ্টা সময়ের মধ্যেই ডিমের সম্পূর্ণ গাঠনিক আকৃতি দান করে তা বাইরের পরিবেশে ত্যাগ করতে পারে।

তো এখন কী আমরা এই সুপ্রাচীন ধাঁধাটিকে একটু বিশ্রাম দিতে পারি?
নাকি বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকরা এখনও এর সঠিক উত্তরের জন্য হন্যে হয়ে খুঁজে মরছেন?
আমরা আসলে জানি না। দিন শেষে, এই বিষয়টি যুক্তি তর্কের পরস্পরবিরোধী আগ্রাসনে ক্রমশ জটিল হতেই থাকবে। কেউ একটি যুক্তি দিলে সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি যুক্তির দ্বারা সেটিকে নাকচ করে দিতে পারে।
ডিম অবশ্যই মুরগির আগেই এসেছে। তবে মুরগির ডিম মুরগির আগে আসে নি। একটি ছাড়া আপনি অন্যটি পাবেন না।
সে যাই-ই হোক, যদি যেকোনো একটি পক্ষকে বেছে নিতে বলা হয়, তাহলে বিবর্তনিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমি ডিমের পক্ষকেই বেছে নিব। আপনি কোন পক্ষে?

তথ্যসূত্র: https://www.science.org.au/curious/everything-else/which-came-first-chicken-or-egg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>