আমরা মানুষরা স্তন্যপায়ী প্রাণী, বলাবাহুল্য যে পৃথিবীর আর সকল স্তন্যপায়ী প্রাণির মতই মানুষও শিশুর জন্যে অপরিহার্য এবং অসম্ভব রকমের গুরুত্বপূর্ণ মায়ের বুকের দুধ খেয়ে বড় হয় বা প্রাকৃতিকভাবে শিশুর প্রাথমিক খাদ্য হিসেবে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা থাকে বলেই আমরা স্তন্যপায়ী। তাই দুগ্ধ উৎপাদন ও তা শিশুকে তা খাওয়াবার ব্যবস্থা হিসেবেই নারীদেহে স্তন্যের অস্তিত্ব বিরাজমান। এ গেলো যুক্তিসঙ্গত একটা ব্যাপার। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছেন,
পুরুষদের মাঝে স্তন্যের স্তনবৃন্ত (Nipple) এর অস্তিত্ব থাকার কারণ কি? আর দরকারই বা কি?!
আমরা কখনো কোথাও দেখিনি যে কোনো বাবা বা কোনো পুরুষ মানুষ কোনো শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে (আরে ভাই থামেন আর ভাবা লাগবে না, ভয়াবহ ব্যাপার!)। আর কোনো পুরুষ চেষ্টা করলেও তো তা পারবে না। (অবশ্য কে চেষ্টা করতে যাবে?)
তো কাজ নাই, উপযোগীতা নাই এমন একটা অঙ্গ অযথাই কেনো প্রতিটা পুরুষ তাদের দেহে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে? বলা হয় বিবর্তনের ধারায় প্রাণিদেহের জিন নিজেদের অঙ্গ গঠনকে সেভাবেই পরিবর্তন করেছে যেভাবে তার প্রয়োজন। কিন্তু পুং স্তন্যের বা স্তনবৃন্তের তো কোনো প্রয়োজনীয়তা কারো চোখে পড়েনা। আবার হাস্যকর হলেও সত্যি (হাসবেন না) স্তনবৃন্ত ছাড়া কোনো পুরুষ মানুষ কিন্তু আমরা কল্পনাও করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করিনা। কেমন কেমন যেন লাগে। এর কারণ দীর্ঘদিন ধরে দেখে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া।
পুরুষদের স্তনবৃন্ত কেন থাকে সে জবাব হয়তো এক কথাতেই দিয়ে ফেলা যাবে, কিন্তু তাতে আমাদের এবিষয়ে অনেক জানাই আড়ালে থেকে যাবে। তো তাই চলুন এবার জেনে নেয়া যাক এই উদ্ভট ব্যাপারটি সম্পর্কে।
পুরুষের শরীরে স্তনবৃন্ত কেনো থাকে তা জানার জন্যে আমাদেরকে তাকাতে হবে গর্ভকালীন অবস্থায় ভ্রূণ বা Embryo’র দিকে। পুরুষের শুক্রাণু ও নারীর ডিম্বাণু মিলিত হয়ে যখন একটি ভ্রূণ গঠন করে তখন তার প্রাথমিক পর্যায়ের কোষবিভাজন নারী বা পুরুষভেদে অভিন্ন পদ্ধতিতে চলে। অর্থাৎ তখনও বিকশিত হয়ে থাকা কোষসমুহের জীন তাদের লিঙ্গ নির্ধারণের নির্দেশ দেয়না। মানবদেহ গঠনের প্রথম কয়েক সপ্তাহে আমাদের জীন একই ব্লু-প্রিন্ট অনুসরণ করে থাকে। সেক্ষেত্রে নারী বা পুরুষদেহ হিসেবে নয়, বরঞ্চ অভিন্ন বৈশিষ্ট্যের মানবদেহ হিসেবে বিকশিত হতে থাকে।
এসম্পর্কে American Museum of Natural History‘র paleoanthropologist Ian Tattersall বলেন, “মূলত নারী আর পুরুষ একই ধরণের জীনগত নীলনকশা (Blueprint) দিয়ে গঠিত থাকে। এরপর তারা সামান্য পরিমাণে ভিন্ন ধারায় গঠিত হয়ে যায় লিঙ্গ নির্ধারণের সময়।”
মূলত মানবদেহের গঠনগত সময়ের বৈশিষ্ট্য হল এদের ভেতরে থাকা বাইশ জোরা ক্রোমোজোম এর জীন গঠনকে প্রাথমিক পর্যায়ে কেবল মৌলিক অঙ্গগুলো গঠনের জন্য নির্দেশনা দেয়। কারণ সেগুলো একটা দেহের বিকাশের প্রথম ধাপ। সেগুলো অপূর্ণ থাকলে অন্য অঙ্গগুলোও ঠিকমত কাজ করতে ব্যর্থ হবে। এই যেমন হৃৎপিণ্ড, রক্তসংবহনতন্ত্র (Blood Circulation System), মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্র ইত্যাদি। সেগুলোর সাথে সাথে দেহের বাইরের অবয়বকেও একটা প্রাথমিক গঠন দান করাটা তখন বাহ্যিক দিক দিয়ে সবচাইতে জরুরী থাকে। তা না হলে অঙ্গসমুহের অবস্থান (Organ Placement) এ ত্রুটি হতে পারতো। ঠিক যেমন একটা মোবাইলে অতিরিক্ত সেন্সর বা সফটওয়্যার বসাবার আগে মাদারবোর্ড, ব্যাটারি, ক্যামেরার প্রাথমিক অবস্থান নির্ণয়ের জন্যে তার বাহ্যিক মডেল/কাঠামোটা আগে বানিয়ে নেয়া জরুরী হয় ঠিক তেমনি কোথায় কি অভ্যন্তুরীন অঙ্গ বসবে সেটা নির্দিষ্ট করার জন্যে জীন মানবদেহের প্রাথমিক বাহ্যিক কাঠামোটা তখনি তৈরী করে নেয়। একাজ করতে গিয়ে দেহকে একটা বাহ্যিক রূপ দেয়ার প্রয়োজন পড়ে। আর স্তন্য ও স্তনবৃন্ত যেহেতু বাহ্যিক অঙ্গ তাই সেটা গঠন প্রক্রিয়ায় তখনি প্রাথমিক রূপ পেয়ে যায়। কারণ মানবদেহ সায়েন্স ফিকশন মুভির কোনো Shapeshifter বা হিন্দি সিরিয়ালের কোনো নাগ-নাগী নয় যে ইচ্ছেমত নিজেদের অঙ্গগঠণ পরিবর্তন করবে। একবার যদি স্তন্য ছাড়া পুরো গঠন টা তৈরী হয়ে যায় পরবর্তীতে সেটা মুছে তো আর নতুন করে স্তন্য ও স্তনবৃন্তের আবির্ভাব ঘটা সম্ভব না। তাই জীন সেটাকে প্রাথমিকভাবে পূর্ণ না করলেও অন্তত বিকাশের পথ টা করে দেয়। ঠিক যেমন একটা ওয়াশরুমের কোথাও আপনি ঝর্ণা (Shower) বসাবেন কি না বসাবেন তা পরের ব্যাপার। তার আগে সেখানে অবশ্যই পানি আসার নলের অস্তিস্ত থাকতেই হবে।
ভ্রূণ থেকে দেহ বিকাশ এর চার (৪) সপ্তাহ পার হবার পর দেহের একজোড়া সেক্স ক্রোমোজোম বা লিঙ্গ নির্ধারক ক্রোমোজোম বলে পরিচিত Gonads এর X ও Y থেকে সচরচর যেকোনো একটি ক্রোমোজোম এর জীনসমূহ প্রকট হয়ে ওঠে, ও অপরটি প্রচ্ছন্ন হয়ে যায়। যখন X ক্রোমোজোম এর জীনগুলো প্রকট হয় তখন ওই দেহে নির্দিষ্ট সময়ে স্তন্য পরিপূর্ণ বিকশিত (Develop) হবার নির্দেশটা পেয়ে যায়। এটা যেন অনেকটা বাইনারী সিগনালে সুইচিং এর মত!
ঠিক তেমনি যখন Y ক্রোমোজোম বা পুংলিঙ্গের বৈশিষ্ট্য নির্ধারক ক্রোমোজোম যখন প্রকট হয়ে ওঠে তখন প্রাথমিকভাবে গঠিত স্তন্য ওইপর্যায়ের থেকে যায়। এবং সেটা ভবিষ্যতে নির্দিষ্ট সময় সুগঠিত হবার কোনো নির্দেশ আর পায়না। আর যেহেতু এটা একটা প্রাণীদেহ, এবং স্তন্য ভেতর থেকে প্রাথমিকভাবে একটা পর্যায় পর্যন্ত গঠিত হয়েই যায়, তাই তা আর বদলানো সম্ভব হয়না। Y ক্রোমোজোম এর জীনসমুহ সেই আধা নির্মিত স্তন্য ও স্তনবৃন্তকে নিয়েই তার পরবর্তী গঠন প্রক্রিয়া চালাতে থাকে। এভাবে চলতে চলতে ছয় থেকে আট সপ্তাহের মধ্যেই দেহে লিঙ্গনির্ধারণ প্রক্রিয়া তার প্রাথমিক কাজ শুরু করে ফেলে। এবং এসময়ের মাঝেই জননতন্ত্র প্রকট হওয়া Y ক্রোমোজোম সমস্তপ্রকার X ক্রোমোজোম এর বিকাশ রোধ করে ফেলে। এবং একবার বীর্য ও পুংলিঙ্গের বৈশিষ্ট্য প্রদানকারী হরমোন টেস্টোটোস্টেরন তথা টেস্টিকাল অণ্ডকোষ বিকশিত হওয়া শুরু করলে তখন আপনা আপনি শরীরের যে যে জায়গায় প্রয়োজন সে সে জায়গায় প্রাথমিক ও মৌলিক পুরুষালী বৈশিষ্ট্য বিকশিত হওয়া শুরু করে দেয়। ইস্ট্রোজেন (Oestrogen), প্রোল্যাকটিন, (Prolactine) ইত্যাদি নারীর বৈশিষ্ট্যসুচক হরমোনের ক্ষরণ তখন থেকে সীমাবদ্ধ হয়ে যাবার ফলে পুরুষদেহ আর স্তন্য বিকশিত করতে সক্ষম হয়না। এই প্রোল্যাকটিন হরমোনের নির্দিষ্ট মাত্রায় ক্ষরণের জন্যেই গর্ভকালীন সময়ে নারীদেহে স্তন্য মাতৃদুগ্ধ উৎপন্ন করে।
অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে স্তন্যদুগ্ধের ধারক ও সরবরাহক Milk Duct কিন্তু পুরুষদেহেও থেকে যায়! কোনোভাবে যদি কোনো পুরুষদেহে প্রয়োজনীয় হরমোন কৃত্রিম কোনো উপায়ে সুনিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে প্রয়োগ করা হয় বা সেগুলোর ক্ষরণ বাড়িয়ে দেয়া হয় তখন একজন পুরুষের আধাবিকশিত (Underdeveloped) স্তন্যও দুগ্ধ উৎপাদন করা শুরু করে দিবে, যাকে ক্লিনিক্যাল টার্মে Male Lactation বলে। তবে যাইহোক, এমন উদ্ভট বিষয় আশাকরি কোনো পুরুষই ভাবতে চাইবে না।
এই না গেল পুরুষদেহে স্তনবৃন্ত থাকার কারণ। তবে এখানে আরো একটা কথা কিন্তু থেকেই যায়। আমরা জানি বিবর্তনের ধারা প্রাণিদের দেহ থেকে অনেক কিছুই বাদ দিয়েছে যেগুলোর পরিবর্তন নেই। কিন্তু সবই কি বাদ পড়ে যায়?
আদতে কিন্তু তা নয়। আর তাছাড়া এব্যাপারটা এমন যে বাদ পড়লে বিকাশের জটিলতা আরো বেড়ে যেতে পারে বলেই হয়তো আমাদের জীন সেই পদ্ধতিটা ব্যবহার করেনা। জীন ঠিক কি নিয়মে কাজ করে, কোন হিসেবে সে প্রাণীদেহ সাজায় তা আমাদের কাছে এখনো গভীর রহস্যাবৃত। তবে পুরুষদেহে এমন কিছু থাকাটা নিতান্তই নিষ্প্রয়োজন হলেও তা অন্তত ক্ষতির কোনো কারণ নয়।
এপ্রসঙ্গে Ian Tattersall বলেন, “স্তনবৃন্ত থাকাতে শরীরের বিপাকীয় ক্রিয়ায় তেমন বাস্তবিক কোনো ক্ষয়ক্ষতি নেই।”
প্রয়োজন অপ্রয়োজনের ব্যাপারে বলতে গিয়ে তিনি আরো বলেন যে, “প্রাকৃতিক নির্বাচন সবসময় সেই খেয়ালেই ব্যস্ত থাকেনা যে আমাদের যা নিতান্তই প্রয়োজন নেই তা থেকে আমাদের মুক্ত করতেই হবে।”
অর্থাৎ, পুরুষ দেহে স্তনবৃন্তের প্রয়োজন না থাকলেও জীনগত প্রক্রিয়া পরিবেশ ও পরিস্থিতির স্বাপেক্ষে এটাকে এতোটাও জরুরী মনে করে না যে পুরুষদের দেহ থেকে গঠন প্রক্রিয়াতে তা বাদ করে দিতেই হবে!
তো পেয়ে গেলেন তাহলে প্রশ্নখানার জবাব। আশাকরি সবাই ব্যাপারটা অনুধাবন করতে পেরেছেন। আজকের আলাপন এখানেই শেষ করছি। পরেরবার হয়তো আবার ফিরে আসবো অন্য কোনো বিষয় নিয়ে। ততক্ষণে ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন আর নিজের খেয়াল রাখুন…
One Comment
Akif Rafat
Male breast can never produce milk even if male body is facilitated with all female hormone that helps in synthesis of milk…
But it’s true that in case of some chromosomal malfunction in male body(such as Klinefelter’s Syndrome), male breast can secret liquids that seems like milk but not milk. Male breast is rudimentary throughout the life and absence of alveoli.