বর্তমান মানবসত্তা এবং পূর্ববর্তী যেসব মানুষেরা পৃথিবীতে ছিলেন, সবাইকেই এই প্রশ্নটা খুব বেশিই ভাবিয়েছে। প্লেটো থেকে লিবনিজ এবং বর্তমানে যারা আছে আর ভবিষ্যতে যারা আসবে, সবাই একসময় নিজেকে সমর্পণ করে একটি মাত্র ক্ষুদ্র কিন্তু বিশাল প্রশ্নের কাছে,
“কেন এই মহাবিশ্বে কিছু রয়েছে কোনো কিছু না থাকার চেয়ে?”
একটু বিস্তারিত আলোচনায় যাই। একটি আদর্শ বিশ্বে প্রতিটি অনন্যসাধারণ দর্শনতাত্ত্বিক প্রশ্ন আসে একটি চমৎকার ঘটনার মাধ্যমে যে কীভাবে একজন জিনিসটা চিন্তা করেছে। কেন কিছু আছে কোনো কিছু না থাকার পরিবর্তে এই জিনিসটা নিয়ে একটু বেশিই মাথা ঘামান গডফ্রই লিবনিজ (ইনি আবার ক্যালকুলাস/বাইনারি সিস্টেমেও অনেক উন্নতি সাধন করেছেন)।
লিবনিজের আগে অনেক চিন্তাবিদই প্রশ্নটা করেছিলেন যে, কেন এই মহাবিশ্ব, কী দরকার সবকিছুর? কিন্তু লিবনিজ আরেকটু গভীরে যান। লিবনিজ ভাবতেন কোনো কিছুই এত সহজ এবং সরল নয়, তাঁর মতে ঈশ্বর চেয়েছিলেন একটি মহাবিশ্ব সৃষ্টি করতে এবং সেজন্য তিনি সেটা করেছেন। লিবনিজের মৃত্যুর পরও এই প্রশ্নের প্রবাহ চলতে থাকে। তবে সেক্যুলার দার্শনিক ও বিজ্ঞানী সমাজের সংখ্যা দিন দিন বাড়ায় ঈশ্বরের মহাবিশ্ব সৃষ্টির তত্ত্বটা কেবলই উত্তরের গ্রহণযোগ্যতা হারাতে থাকে।

আবার আরেক-ভাবে উত্তর দেয়া যায় যে, অবশ্যই একটা জগতের দরকার ছিল, কারণ কোনোকিছু না থাকা এটা অসম্ভব। সতেরশো শতাব্দীর দার্শনিক Spinoza এই ব্যাপারটা চিন্তা করতেন। তিনি দাবী করেন যে মহাবিশ্ব, তাঁর সব উপকরণ নিয়ে এক্সিস্ট করছে, যেভাবে করা উচিত ছিলো। কেন করছে এখানেও কিন্তু কোনো ধরা বাঁধা উত্তর নেই।এমনকি আইনস্টাইনও Spinoza কে সমর্থন দিয়ে এই মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। অন্যান্য বিজ্ঞানীরা যেমন Laurence Krauss তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ A Universe From Nothing এ লিবনিজের এই প্রশ্নের খুব গভীর উত্তর দিয়েছেন। তাঁর মতে,
আমাদের মহাবিশ্বের জন্ম প্রাকৃতিক ভাবেই এবং সেটি হয়েছে মহাকর্ষ আর কোয়ান্টাম ভ্যাক্যুম এর মাধ্যমে; শূন্যস্থান যখন ভার্চুয়াল কণার সাথে সংস্পর্শে আসে তখন সেটা পুনঃপুন বিস্ফোরণের মাধ্যমে এক প্রকার অস্তিত্ব তৈরি করে আবার হারিয়ে যাওয়ার আগে।
Krauss এর থিওরি বলে যে, কোনোকিছুই যে ছিলনা সেটা একেবারে অসম্ভব, অবশ্যই কিছু না কিছু ছিল। প্রথমে মহাকর্ষ, তারপর কোয়ান্টাম ভ্যাক্যুম এবং অবশেষে মহাবিশ্ব যেটাতে আমরা বর্তমান।
বিশ্বসৃষ্টিতত্ত্ব বা cosmology র অন্য থিওরি সাজেস্ট করে যে আমাদের মহাবিশ্ব কোনো না কোনোকিছু থেকেই জন্ম নিয়েছে, হোক সেটা স্ট্রিং অথবা মেমব্রেন। বৈজ্ঞানিকভাবে যাচাই করতে গেলে আমাদের এই মহান প্রশ্নে একটু থমকে দাঁড়াতে হয়, যেমন কেনই বা আমরা চিন্তা করব যে আগে থেকেই মহাকর্ষ ছিল, কেনই বা স্ট্রিং থাকবে এমনকি কেনই বা এই মহাবিশ্ব থাকতে হবে! অর্থাৎ এই সমস্ত জিনিস ছাড়াও কোনো কিছু যে ছিল না এটা চিন্তা করা সম্ভব! আবার বাট্রান্ড রাসেল লিবনিজের উত্তরে বিরোধিতা করেন। তাঁর মনে এই মহাবিশ্ব ছিল এবং আছে, কারণ দরকার ছিল, সেজন্য! তিনি কোনো বর্ণনার প্রয়োজন মনে করেননি। এমনকি যারা মনে করেন আমাদের মহাবিশ্ব একটি মাল্টিভার্সের অংশ তারাও রাসেলকে সমর্থন করেন, যে আদৌ এর কোনো বর্ণনা নেই! তাহলে সবচেয়ে নিখাদ উত্তর কোনটা? আধুনিক দার্শনিকরা দিনশেষে এটাই যৌক্তিকভাবে বিশ্বাস করেন যে, মহাবিশ্ব এই কারণেই এক্সিস্ট করে কারণ সেটির অস্তিত্বের প্রবণতা বেশি অথবা এতে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ রয়েছে যা অন্য অস্তিত্বকে পূর্ণতা দান করবে।অনেকটা বলতে পারেন অনেকগুলো মহাবিশ্বের মাঝে একটা ভার্চুয়াল নেচারেল সিলেকশন! এই থিওরি সম্পূর্ণভাবে ঈশ্বরের সেই মহাবিশ্ব সৃষ্টির তত্ত্বকে অস্বীকার করে। অবশেষে প্রশ্নটা এভাবেই দোলায়মান থাকে। আগেই বলেছি অনন্যসাধারণ দার্শনিক প্রশ্নের অনন্যসাধারণ উত্তরই কেবল প্রযোজ্য!
তথ্যসূত্রঃ philosophytalk.org