X-Ray

৮ নভেম্বর ১৮৯৫, জার্মান পদার্থবিজ্ঞানের প্রফেসর উলহেলম রন্টজেন( Wilhelm R‌ontgen) তার ল্যাবরেটরিতে লিনার্ড টিউব এবং ক্রুকস টিউব নিয়ে পরীক্ষা করছিলেন, হঠাৎ তিনি একটি নতুন ধরনের রশ্মির(Ray)  উপস্থিতি লক্ষ্য করেন।   এই রশ্মির প্রকৃতি সম্পর্কে তার কোন পূর্ব ধারণা ছিল তাই এই রশ্মির নাম কি এবং এটা কিভাবে এলো কিছুই তিনি প্রথমে বুঝে উঠতে পারেন নি। তিনি বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে নিয়ে এর সম্পর্কে জানার চেষ্টা করলেন এবং এ বিষয়ে  একটি প্রাথমিক গবেষণা আর্টিকেল লিখলেন। আর্টিকেল টির নাম ছিল “ On a new kind of ray: A preliminary communication ” এবং ১৮৯৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর  Wurzburg’s ফিজিক্যাল-মেডিক্যাল সোসাইটি জার্নালে সাবমিট করেন। এটাই ছিল এক্স-রে নিয়ে লেখা প্রথম কোনো পেপার। রন্টজেন এই রশ্মির নাম দেন ” X” কারণ এটি ছিল একটি অজানা প্রকৃতির রেডিয়েশন।  এই X ই পরবর্তীতে রয়ে গেছে এই রশ্মির নাম হিসেবে যদিও তার কিছু সহকর্মী এই রশ্মির  নাম ” রন্টজেন রে ”  ডাকার প্রস্তাব করেছিলেন। এবং এখনো পৃথিবীর অনেক ভাষায় এই নামেই ডাকা হয়। রন্টজেন তার এই আবিষ্কারের জন্যে পদার্থ বিজ্ঞানে প্রথম নোবেল পুরস্কার পান।

তার আবিষ্কারের বিস্তারিত ব্যাখ্যা যদিও তার নিজের থেকে জানা যায়নি কারণ তার মৃত্যুর পর এই ল্যাব নোট গুলো পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু তার জিবনী লেখকদের মাধ্যমে এখানে কিছু তুলে ধরা হয়েছে।  রন্টজেন তখন ক্রুকস টিউব থেকে উৎপন্ন ক্যাথোড রে নিয়ে পরীক্ষা করছিলেন,  এই সম্পূর্ণ ব্যবস্থাটি ছিল কালো কার্ডবোর্ডে ঢাকা যেন কোন আলো প্রবেশ করতে না পারে এই পরিবেশে। তিনি এই কার্ডবোর্ড তৈরিতে বেরিয়াম প্লাটিনোসায়ানাইড দিয়ে পেইন্ট করা ফ্লুরোসেন্ট স্ক্রিন ব্যবহার করেছিলেন।  তিনি এই স্ক্রিনের প্রায় মিটারখানেক দুরে একটি অনুজ্জ্বল সবুজ আভা দেখতে পান। রন্টজেন বুঝতে পারেন ওই টিউব থেকে উৎপন্ন কোনো রশ্মি কার্ডবোর্ডের স্ক্রিন ভেদ করে এই আভা সৃষ্টি করছে।  তিনি লক্ষ্য করেন এই রশ্মি ডেস্কের উপরে রাখা বই এবং কাগজ ও ভেদ করে যেতে পারে। তিনি বিষয়টা নিয়ে ভাবতে থাকেন এবং সিস্টেমেটিক্যালি অনুসন্ধান শুরু করেন এবং তার প্রথম পর্যবেক্ষণের দুই মাস পর গবেষণা পত্রটি প্রকাশ করেন।

রন্টজেন এই এক্স-রের মেডিকেল ব্যবহার আবিষ্কার করেন যখন তিনি একটি ফটোগ্রাফি প্লেটে তার স্ত্রীর হাতের ছবি ধারণ করেন। তার স্ত্রীর হাতের ছবি ছিল এক্স-রে ব্যবহার করে তোলা কোনো মানুষের অঙ্গের প্রথম ছবি। তার স্ত্রী এই ছবি দেখে বলেছিলেন, “আমি আমার মৃত্যুকে দেখেছি। ”

রন্টজেন বুঝতে পারেন এক্স-রে চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে তাই তিনি ২৮শে ডিসেম্বর ফিজিক্যাল-মেডিক্যাল সোসাইটিতে গবেষণা পত্র সাবমিশন এর সাথে সাথে   ১লা জানুয়ারি ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে তার পরিচিত চিকিৎসাবিদের একটি চিঠিও পাঠিয়ে দেন। খবর দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং রন্টজেনর পর প্রথম X-Ray তৈরি করেন  স্কটিশ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার  Alan Archibald Campbell-Swinton.  ফেব্রুয়ারি নাগাদ শুধুমাত্র উত্তর আমেরিকাতেই এই কৌশল এর উপর  ৪৬ টি এক্সপেরিমেন্ট চালানো হয়।

এখন আসি এক্স-রে উৎপাদনের পিছনে কি বিজ্ঞান আছে তার বিশ্লেষণে।

বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত কুলিজ এক্স-রে ভ্যাকুয়াম টিউবে কিভাবে এক্স-রে উৎপাদিত হয় তাই বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করব এখানে। চিত্রে একটি কুলিজ এক্স-রে টিউব দেখানো হয়েছে। একটি টাংস্টেন ফিলামেন্ট ক্যাথড F এ থার্মো-আয়োনিক্যালি ইলেকট্রন উৎপাদন করা হয়।  এইন ইলেকট্রন গুলোকে একটি টার্গেট T এ আঘাত করা হয়। আঘাত করার সময় ইলেকট্রন গুলোকে উচ্চ শক্তিতে গতিশীল করা হয় এবং প্রায় আলোর ১০% গতিতে উন্নীত করা হয়।এর জন্য
ক্যাথড F এবং অ্যানোড এ উচ্চ ভোল্টেজ ব্যবহৃত হয়।  এবং এ ভোল্টেজ এর মান প্রায় ৫০ হাজার থেকে ১ লক্ষ ভোল্ট হয়।


টার্গেট T সাধারণত কোন বড় সাইজের টাংস্টেন হয় তবে মাঝে মধ্যে মলিবডেনাম ও ব্যবহৃত হয়। এখানে টার্গেটের সাথে কপারের একটি এমবেডেড সিস্টেম ও ব্যবহৃত হয় কারন এতো উচ্চ গতির ইলেকট্রন এর সংঘর্ষের ফলে বেশ পরিমাণ তাপ উৎপাদিত হয় আর এই তাপ যেন সহজে এই কপারের সাহায্যে কুলিং সিস্টেমে পরিবাহিত হতে পারে। এখানে এতো বেশি তাপ উৎপাদিত হয় যে অধিকাংশ ধাতু গলে যেতে পারে তাই টাংস্টেন, প্লাটিনাম এবং মলিবডেনামের মতো উচ্চ তাপ সহনশীল ধাতু ব্যবহার করা হয়।  যখন উচ্চগতির ইলেকট্রন এই টাংস্টেন এর তৈরি টার্গেটে আঘাত করে তখন ইলেকট্রনের গতিশক্তির কিছু অংশ ছেড়ে দেয় এবং ইলেকট্রন এর ত্যাগকৃত শক্তি এক্স-রে তে পরিনত হয়।

কাজটা অনেকটা এরকম যে ধরুন আপনি একটি লোহার তৈরি গোলক নিয়ে গায়ের সমস্ত শক্ত দিয়ে গোলকটিকে অপর একটি ধাতম বস্তুর উপর ছুড়ে মারলেন তাহলে সেখানে প্রচন্ড একটা শব্দ শুনতে পাবেন এবং একটি আলোর ঝলকানি ও দেখতে পাবেন।

এক্স-রে উৎপাদন ও অনেকটা একই রকম ইলেকট্রন যখন টার্গেটে আঘাত করে একই ভাবে সেখানে এক প্রকার আলোকরশ্মি উৎপন্ন হয় এই আলোকরশ্মি আমাদের দৃশ্যমান আলোর থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী এবং এটি কিছু সাধারন পদার্থ যেমন পাতলা কাঠ,কাগজ,কাপড় এবং শরীরের মাংসপেশি ইত্যাদি কিন্তু পুরু ধাতব বস্তু এবং হাড় ভেদ করতে পারে না।   

ফলে আমরা যখন কোনো এক্স-রে মেশিনের সামনে আমাদের শরীরের কোনো অংশ রাখি এবং এক্স-রে মেশিন চালানো হয় তখন উপরে যে ঘটানা বলা হল তাই ঘটে এবং এক্স-রে উৎপাদন হয় এই এক্স-রে একটি ছোট স্থান দিয়ে বাইরপ যেতে দেওয়া হয় এবং সেই স্থানের সামনে শরীরের নির্দিষ্ট অংশ রাখা হয়। এখন এক্স-রে যেহেতু সাধারণ পদার্থ ভেদ করে যেতে পারে তাই এটি আমাদের শরীরের মাংশাল অংশ ভেদ করে চলে যায় কিন্তু হাড়ের ঘনত্ব মাংসের তুলনায় অনেক বেশি হওয়ায় এক্স-রে হাড় ভেদ করে যেতে পারে না। ফলে হাড়ের ছায়া তৈরি হয় এবং এই ছায়া একটি ফটোগ্রাফিক প্লেটে ধারন করা হয়। যদি কারো হাড়ে কোন প্রকার ভাঙা বা ফাটল থাকে তাহল সেই ফাটল দিয়ে এক্স-রে ভেদ করে চলে যায় এবং ওই ফাটলের দৃশ্য এবং প্রকৃতি ফটোগ্রাফিক প্লেটে ধারন করা হয়ে যায়। এই ফটোগ্রাফিক প্লেট দেখে ডাক্তাররা সহজে বুঝতে পারেন এবং ব্যবস্থা নিতে পারেন।

এক্স-রে যে কেবল চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয় তা কিন্তু নয়, এক্স-রে আরো অনেক কাজে ব্যবহৃত হয় যেমন বিমান বন্দরে যাত্রীদের ব্যাগ এবং শরীর তল্লাশির কাজে,রাসায়নিক বস্তুর গঠন পর্যবেক্ষণেও এক্স-রে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া আরো কোথায় এক্স-রে ব্যবহার করা হয় তা জানতে হলে গুগলে ঢু মারতে পারেন। পেয়ে যাবেন এর বিস্তারিত ব্যবহার এবং এর পিছনের পদার্থ বিজ্ঞান।

সুত্রঃ

(i) Modern Physics -B.L Theraja.
(ii) Wikipedia.

Comments are closed.